যে শহর 'বাড়ি' দেয় না, মাটিও দেয় না
সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে ৫ দিনের, স্বাধীনতা দিবসের ছুটি, শুক্র–শনিবার মিলিয়ে মোট ১০ দিনের বিরতি। ছুটি মানেই এই দেশে ‘বাড়ি’ যাওয়া। হয়েছেও তাই, সোমবার বিকেল থেকে বাসস্ট্যান্ডে, ট্রেন টার্মিনালে উপচে পড়া ভিড়। সেসব ছবি ভাইরাল। আর রাত না হতেই ট্রেনের বগিতে দাঁড়িয়ে বসে শত শত মানুষের যাত্রার ভিডিও, যেখানে নিরাপদ দূরত্ব তিন ফুট তো নেই-ই, একেক যাত্রীর মুখ থেকে আরেক যাত্রীর মুখের দূরত্ব তিন ইঞ্চিও হবে না কিছুতেই। আমরা দেখলাম এক তরুণ যাত্রী ভিডিও করে বগির ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী’ অবস্থা দেখাচ্ছেন আর তিনি আর তাঁর সহযাত্রীরা মিলে করোনার ভয় নিয়ে হাসিঠাট্টা করছেন। ওই ভিডিও আর পরদিন ফেরিবোঝাই মানুষের ছবি দেশের মানুষের ‘অসচেতনতা, ‘বোকামো’ ‘বিপদ না বুঝে হলিডে যাওয়া’র জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারে হাজারে শেয়ার হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষার যথেষ্ট কিট নেই, হাসপাতালে বেড নেই, আইসিইউ নেই, ডাক্তারদের নিরাপত্তা পোশাক (পিপিই) নেই। করোনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোনো দেশই পারছে না। লন্ডনে সুরক্ষা পোশাক ছাড়াই ডাক্তার বন্ধু চিকিৎসা দিচ্ছেন, যথেষ্ট ভেন্টিলেটর নেই, তাই যাদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি মানে, তরুণতরদেরই বাছাই করে নিতে হচ্ছে অনেক সময়। পরীক্ষা ব্যবস্থার অভাব সব দেশে। আমেরিকাতে শুধু পরীক্ষা করার সুবিধা অপ্রতুল তাই নয়, দোকানে সাবান, মাস্ক, স্যানিটাইজার নেই, আবার স্কুল বন্ধের সঙ্গে স্কুলের দেওয়া খাবারও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক দরিদ্র পরিবারে শিশুদের অভুক্ত থাকার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এমন অবস্থায়, পরীক্ষার কিট আবিষ্কার নিয়ে দেশে দেশে কথা, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লক্ষ্যে অবিরাম প্রচেষ্টা, অন্য কোনো রোগের ওষুধ করোনায় কাজ করে কি না, তা নিয়ে অব্যাহত নিরীক্ষার মধ্যে এক বিষয়ে সবাই এখন একমত যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে লকডাউনে যাওয়া, অর্থাৎ সবাই মিলে যে যার বাসায় ঢুকে পড়ে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার গতি কমিয়ে আনাই আপাতত সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। সংক্রমণের চক্র ভেঙে দিয়ে নিজে বাঁচা, নিজের পরিবার, সমাজকে বাঁচানোই একমাত্র লক্ষ্য। বিষয়টা তাই ভয়াবহ যে সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাত্র ৪০০–এর মতো আইসিইউ–সুবিধা (সব কটির ভেন্টিলেটর কার্যকর কি না আমি জানি না) আর সর্বোচ্চ জনঘনত্বের ১৭ কোটির দেশে লাখখানেক ডাক্তার নিয়ে আমরা এখনো লকডাউনে যেতে পারিনি।
কিন্তু আমার তবু কেন জানি হাসি আসে না বা রাগ হয় না ভিডিওতে গাদাগাদি করে ‘বাড়ি’ যেতে থাকা ট্রেনযাত্রীদের ভিডিও দেখে। আমার মনে হয়, ভিডিওকারী যাত্রীও আসলে দম বন্ধ হয়ে আসা ভয় ঠেকাতেই ঠাট্টার সুরে করোনাকে তাচ্ছিল্য করছেন। গত কয়েক দিনে যেসব তরুণ–তরুণী ভাবছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ, টিউশনি বন্ধ, কী খেয়ে কোথায় থাকবেন তাঁরা, ওঁরা আছেন ওই ভিড়ে। যে মেয়েটি এই শহরে একা থাকে, বিরান শহরে ফ্ল্যাট বাড়িতে অতি আগ্রহী দারোয়ান আর প্রতিবেশীর সঙ্গে থেকে যাওয়া কি ঠিক হতো তাঁর?
কিংবা পরিচিত ইলেকট্রিশিয়ান মোস্তফা, কয়েক দিন আগে যে স্মার্টফোন কিনে এনে দেখাল, মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করার আনন্দে যে গত মাসের শুরুতেও টগবগ করছিল? তাঁর হাতে কাজ নেই এরই মধ্যে ১০ দিন হতে চলল। কেউ বাড়িতে ঢোকাতে চায় না, আগামী কয় সপ্তাহ, কয় মাস এমন চলবে মোস্তফা জানেন না। তাই কাউকে কিছু না বলে ছোট্ট মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে চুপেচাপে রওনা হয়ে মুন্সিগঞ্জের বাড়ি পৌঁছে আমাকে ফোন করেন মোস্তফা। বলেন, বাড়িতে অন্তত খাওয়ার টেনশন নেই, সব ঠিক না হলে আর ঢাকা ফিরবেন না, কারণ বাড়িভাড়া দেবেন কীভাবে!
মুদি দোকানদার মোতালেব সাহেব স্কুল ছুটির পরেই একবার গিয়ে বউ–বাচ্চা গ্রামে রেখে আবার ফিরেছেন ঢাকায়। স্কুল–কলেজ ছুটি দিয়ে দেওয়ায় লঞ্চে ভিড় ছিল ঈদের সময়ের মতো। নিজের দোকানেই দেখেছেন মাল আসতে না আসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে, করোনা ছড়িয়ে পড়লে বাড়িতে তিন তিনটি বাড়ন্ত বাচ্চা নিয়ে স্বামী–স্ত্রী কী করবেন? তাই জানতেন ভিড় ঝুঁকিপূর্ণ, তবু ওদের দিয়ে এসেছেন গ্রামেই। পাড়ায় বিক্রি এত কমেছে যে পরশুদিন দোকানের দুই সহযোগীকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করেছেন, তারাও ‘বাড়ি’ গেছে।
বাড়ির ছুটা বুয়াদের আমরা অনেকেই এ মাসের বেতন পুরো দিয়ে বলেছি আবার ফোন করলে আসতে। আগামী মাসে তাঁর চলবে কী করে? ড্রাইভারকে আগামী মাসের বেতনটা, স্কুল অফিস বন্ধে বাসা থেকে গাড়ি না বের করলেও, দেব তো আমরা? ঢাকা শহরে একেক ঘরে ৪ জন ৫ জন করে থাকেন এঁরা, বস্তির বাইরেও নিম্ন আয়ের মানুষের বাড়ি মানেই অন্তত তিন-চার পরিবার অথবা ৮-১০ জনের এক টয়লেট। এখানে কোনো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারবেন তাঁরা? তাই তাঁরা শহর ছেড়েছেন, ছাড়ছেন। এ পোড়ার শহরে কাজ আর রোজগার ছাড়া আর তো কোনো আরাম–আয়েশের ব্যবস্থা নেই এর ২ কোটির বেশি বাসিন্দার জন্য। এমনতো নয়, এখানে সবাই হোম কোয়ারেন্টিনে থাকলে ঘরে ঘরে খাবার ওষুধ পৌঁছে যাবে, রাজধানী শহর বলে উন্নত চিকিৎসা মিলবে!
এ জন্যই কি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেমন তাৎক্ষণিক কার্যকর বাধ্যতামূলক ঘরে থাকা আদেশ জারি করলেন, আমাদের সরকার কিছু সময় দিল? মঙ্গলবার রাত থেকে অবশ্য যাত্রীবাহী ট্রেন, নৌযান আর বুধবার থেকে বাস চলাচল বন্ধ হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাধারণ ছুটির ঘোষণার সঙ্গে যুক্ত করেন যে করোনাভাইরাসের কারণে নিম্ন আয়ের কোনো ব্যক্তি শহরে জীবনযাপনে অক্ষম হলে সরকার তাঁকে ঘরে ফেরা কর্মসূচির অধীনে নিজ গ্রাম বা ঘরে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।
মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ভাসানচর, হতদরিদ্র গোষ্ঠীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ারও ঘোষণা এসেছে। তার মানে এ আবার এমন এক দেশ আর বিশেষত এমন এক শহর যে নদী ভেঙে বা ঝড়ে সব হারানো এমন পরিবারও তো আছে লাখে লাখে, যাদের যাওয়ার মতো ‘বাড়ি’ও নেই। ভাবতে হচ্ছে তাদের কথাও। এত দশকেও সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা কিংবা সুরক্ষার বলয় কীভাবে শহরের নিম্ন আয়ের ছিন্নমূল মানুষ পর্যন্ত টেকসইভাবে বিস্তৃত করা যায় তাও তো আমরা বের করতে পারিনি। কাজেই এবার তাদের করোনার চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও গ্রামে গিয়ে খেয়ে বাঁচার ব্যবস্থা অন্তত করা গেল! ঠিক সেই ভরসাতেই কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়া প্রবাসীরাও ফিরেছেন দলে দলে।
আর দুই–আড়াই কোটি মানুষের এই শহরে আসলে কতজনের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে? আছে কয়জনকে মাটি দেওয়ার সক্ষমতা? এসব আমরা বিচার করেছি কখনো? দেশ মধ্য আয়ের হলো, তবু কেন সামান্য কাশির কারণ অনুসন্ধানেও জমি বাড়ি বেচে আর কোথাও যাওয়ার সামর্থ্য না থাকলে মানুষ কলকাতা যাচ্ছেন, কলকাতার হাসপাতালে আলাদা বাংলাদেশ ডেস্ক খোলা হচ্ছে, আমরা ভেবে দেখেছি? এ কি শুধুই সক্ষমতার বিলাসিতা, নাকি প্রতি ১ হাজার ৭০০ জন রোগীর জন্য একজনেরও কম ডাক্তার থাকার অক্ষমতার উদাহরণ?
এবার হয়েছে মজা! গুরুতর অসুখবিসুখ করলে নিশ্চিতভাবে আমরা যারা ধারদেনা করে হলেও সিঙ্গাপুর–ব্যাংকক যাব ঠিক করে রেখেছিলাম তারা, যাঁরা রাজপ্রাসাদ থেকে সরাসরি এয়ারলিফটেড হয়ে পৌঁছে যাবেন ভেবেছিলেন মাউন্ট এলিজাবেথে তাঁরা এবং যাঁরা কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি বানিয়ে দেশে ছিলেন একে ছিঁবড়ে বানিয়ে আরও টাকা বের করে নিয়ে যেতে, তারা সবাই এই ঘোরতর অনিশ্চয়তার যাত্রায় এক কাতারে শামিল হয়েছি।
আর ঢাকার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ঢাকাকে বাসযোগ্য করার যাত্রায় কিছুমাত্র অগ্রসর না হয়ে আমরা যারা ঢাকাকে সিঙ্গাপুর লন্ডনের সঙ্গে তুলনা করে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছিলাম, তারা জলাবদ্ধতা, যানজটের পর এবার সংক্রমণ, অসুখ, মৃত্যু আর কবরও বোধ হয় ছড়িয়ে দিলাম ছোট ছোট শহর থেকে গ্রামে গ্রামে। তবু ভালো, গ্রামে তবু ঘর আছে, জমিতে ধান আছে, ভাগ করে নিয়ে খাওয়ার প্রিয়জন আছে, আছে মাটি দেওয়ার জমিও। এবার ঘরে পৌঁছে অন্তত যে যার ঘরে থাকি আর প্রার্থনা করি। সামনে লম্বা পথ। টিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমাদের।
নবনীতা চৌধুরী: একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত