বর্জ্যবান্ধব উন্নয়নের স্থানিক ও বৈশ্বিক বিপদ
অজানা বিপদ করোনাভাইরাস সারা বিশ্বকে অভূতপূর্ব মাত্রায় অস্থির করে তুলেছে। শুধু এই রোগের নয়, ভয়েরও বৈশ্বিক মহামারি তৈরি হয়েছে। উৎপাদন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, জীবনযাপন—সবই এখন ওলটপালট অবস্থায়। এর উৎস নিয়ে এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। কিন্তু এটা নিশ্চিত বলা যায় যে এটা একটা সংকেত। সামনের দিনে আমরা আরও নতুন নতুন অজানা রোগের কবলে পড়ব। বিশ্বের মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় পরস্পরের সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত, এ কারণে বারবারই তা বৈশ্বিক আকার নেবে। বিশ্বের আর্থিক প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত বিকাশ, মানুষ ও প্রকৃতিবিনাশী শানশওকতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে বৈশ্বিক আতঙ্ক বারবার।
বিশ্বে প্রতি বছর সমরাস্ত্র ক্রয়, তার গবেষণা, নজরদারি ইত্যাদিতে ব্যয় হয় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকার অঙ্কে ৮৫ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় আয়ের তিনগুণেরও বেশি। এর ১০০ ভাগের এক ভাগ খরচ করলে সারা বিশ্বের সব মানুষ বিশুদ্ধ নিরাপদ পানি পেতে পারে। কিন্তু মানুষ হত্যা ও পরিবেশ বিনাশে যত সম্পদ ব্যয় হয়, মানুষ বাঁচাতে তার এক কণাও পাওয়া যায় না। সে জন্য চিকিৎসা গবেষণাতেও খুবই অপ্রতুল বরাদ্দ। জানা অসুখ নিয়ে গবেষণাও যথেষ্ট নয়। সমরাস্ত্র খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার একাংশ যায় পারমাণবিক, জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণায়। সেগুলো বিভিন্ন প্রাণী, সমুদ্র, বায়ুমণ্ডলে কী বিষ তৈরি করে, তা অনুমান করা শক্ত নয়। শুধু তা–ই নয়, বর্তমান প্রবৃদ্ধিমুখী উন্নয়ন ও ভোগ থেকে তৈরি হয় ভয়ংকর বর্জ্যের পাহাড়, যা উৎস হয়ে থাকে বহু রকম রোগের। রাষ্ট্রীয় সীমানা দিয়ে তা ঠেকানো যায় না।
সমরাস্ত্র উৎপাদন, সামরিকীকরণ, যুদ্ধ এবং নজরদারি একদিকে মুনাফা আর ক্ষমতার অন্যতম মাধ্যম, অন্যদিকে এগুলোই হচ্ছে বিশ্বজুড়ে সম্পদ অপচয় ও বর্জ্য উৎপাদনের সবচেয়ে বড় এবং বিধ্বংসী উৎস। পারমাণবিক বর্জ্য ভয়াবহ বর্জ্যের পাহাড় তৈরি করছে বিশ্বে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ, পারমাণবিক বোমা, খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন, এসব কেন্দ্র করে সামরিক বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে যে বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তা পানি, মাটিসহ পরিবেশকে সমাধান–অযোগ্য মাত্রায় নষ্ট করছে। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অপরাধী হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, সরকারি হিসাবেই সেখানে কোটি কোটি টন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্বালানি মজুত হয়ে আছে। বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক বর্জ্য কীভাবে নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় রাখা যাবে কিংবা এগুলোর বিপদ থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে, তার কোনো সন্তোষজনক সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি। জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণার প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তা থেকে দেশে দেশে তৈরি হচ্ছে একেকটি ভয়ংকর বিপদের মজুত।
পুঁজির গতিতে যুদ্ধসহ বর্জ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হয়েছে। ১৯৫০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদন ছিল ২০ লাখ টন, ২০১৬ সাল নাগাদ তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টনে। এর মধ্যে ১৩ কোটি টন শেষ পর্যন্ত গিয়ে সমুদ্রে জমা হয়। প্লাস্টিক সামগ্রীর এই উচ্চহারে বৃদ্ধির পেছনে আছে সুপার মার্কেটে সাজানো পণ্যের প্লাস্টিক প্যাকেজিং এবং ‘ওয়ান টাইম’ সামগ্রীর অনুপাত বৃদ্ধি। ধারণা করা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৪০০ কোটি টন। বহু শিল্পোন্নত দেশ এখন রিসাইক্লিং বা পুনরুৎপাদনের জন্য তাদের প্লাস্টিক বর্জ্য প্রান্তিক দেশগুলোতে রপ্তানি করছে। ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ করার আগ পর্যন্ত চীনই ছিল এসব প্লাস্টিক পণ্যের প্রধান ক্রেতা। এখন এসব পণ্যের প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বেশির ভাগ প্লাস্টিক পণ্য নদীতে এবং সেই সূত্রে সমুদ্রে গিয়েই জমা হয়। এই চারটি দেশকেই এখন সমুদ্রে প্লাস্টিক জমার জন্য প্রথম দশটির মধ্যে গণ্য করা হয়।
এ ছাড়া দ্রুতগতিতে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে ৩ কোটি কম্পিউটার বাতিল করা হয়, ইউরোপে ১০ কোটি ফোন বাতিল হয়। এর ১৫-২০ শতাংশ পুনরুৎপাদনে যায়, বাকি পুরোটাই জমে মাটিতে, পানিতে। যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীনের স্থান। চীনে দেশের ভেতরে ই-বর্জ্য তৈরি হয় ৩০ লাখ টনের বেশি। এর পরিমাণ বৃদ্ধি শুধু চীন নয়, বিশ্বের প্রাণ–প্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। কেননা, এগুলোর বিষাক্ত প্রভাব দেশের সীমানায় আটকে থাকে না।
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক পর্যায়ের বর্জ্য নিয়ে বাংলাদেশের মতো ভয়ংকর অব্যবস্থাপনা দেখা যায় না। কিন্তু সেসব দেশে পুঁজির আধিপত্যের মধ্য দিয়ে শিল্পবর্জ্য, পারমাণবিক বর্জ্য, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিক বর্জ্যের পাহাড় তৈরি হচ্ছে। এর অনেকগুলোই তারা বিদেশি ‘সাহায্য’ আর বিদেশি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে স্থানান্তর করছে বাংলাদেশের মতো প্রান্তস্থ দেশগুলোতে। এসব বর্জ্য বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি–উন্মাদনা তৈরিতেও সহায়তা করছে।
বাংলাদেশে উন্নয়ন যে ধারায় হচ্ছে, তা অদূরদর্শী, ব্যক্তির মুনাফাকেন্দ্রিক, পরিবেশবিধ্বংসী এবং জনস্বার্থ সম্পর্কে অন্ধ। বর্তমান পর্যায়ে বাংলাদেশে শিল্পবর্জ্য ও মেডিকেল বর্জ্য প্রধান হুমকি, এর সঙ্গে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের বাজারের অনুষঙ্গ ক্রমবর্ধমান পরিমাণে প্লাস্টিক ও পলিথিন। এর প্রধান শিকার নদী ও জলাভূমি, সেই সঙ্গে বাতাস। গত দুই দশকে বাংলাদেশে শিল্প খাতের দ্রুত বিকাশ হয়েছে। এ দেশে কমবেশি ৩০ হাজার ছোটবড় কারখানা আছে। এসব কারখানার অনেকগুলোই ৪০টির বেশি ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে। গার্মেন্টস ছাড়াও ওষুধ, রসায়ন, প্লাস্টিক, জুতা, সিমেন্ট, সিরামিকস, ইলেকট্রনিকস, খাদ্যসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিনিয়োগ হয়েছে।
আমরা সবাই জানি যে এসব শিল্পের অধিকাংশের বিকাশ যথাযথ নিয়ম মেনে হয়নি। কারখানা করতে গিয়ে বন উজাড় হয়েছে, জলাভূমি ভরাট হয়েছে, কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থাও যথাযথভাবে গড়ে ওঠেনি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কারখানা বর্জ্য অবাধে নদী–নালা, খালবিল দূষণ করছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী—সব নদনদীই বর্জ্যের গন্তব্য। বুড়িগঙ্গা নর্দমায় পরিণত হয়েছে, অন্য অনেক নদীও সেই পথে। শ্রমিকের মজুরি, জীবন ও কাজের নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ কোনো কিছুই ন্যূনতম মানে পৌঁছাতে পারেনি। কারখানার দূষণ কমানোর জন্য অপরিহার্য ইটিপি বসানো বা চালু রাখার কোনো আগ্রহ নেই কারখানার মালিকদের। গড়ে উঠেছে অনেক অবৈধ কারখানা, কিংবা বৈধ কারখানার অবৈধ তৎপরতা। আবাসিক এলাকায় মজুত করা হচ্ছে বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য, অবৈধভাবে চলছে প্লাস্টিক, ফ্যানসহ নানা কারখানা। দেশজুড়ে ইটের ভাটা, বেশির ভাগই অবৈধ। সেই সঙ্গে চলছে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ অব্যবস্থাপনা। এগুলোর কারণে ঢাকার বাতাস এখন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণের রেকর্ড করেছে। পানি ও বায়ুর দূষণ এসব অনিয়ন্ত্রিত ‘উন্নয়ন’ তৎপরতার অন্যতম পরিণতি। ডেঙ্গু, শ্বাসকষ্ট, কিডনি-ফুসফুস-হৃদ্যন্ত্রের জটিলতাসহ নানা অসুখ মানুষের জীবনকে অনিশ্চিত, দুর্বিষহ করে তুলছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। তাই করোনা ছাড়াই দেশের অসংখ্য মানুষ অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে দিন পার করছে। সরকার এর সঙ্গে বিপুল উৎসাহে একের পর এক কয়লা আর পারমাণবিক প্রকল্প করছে, যার ভয়ংকর পরিণতি চিন্তা করাও কঠিন। প্রাথমিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতা সত্ত্বেও আরও ভয়াবহ বর্জ্যবান্ধব উন্নয়নের পথে যেতে তার কোনো দ্বিধা নেই।
পুঁজির গতিতে জিডিপি বাড়ছে, ধনীদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, জৌলুশ বাড়ছে আর পুরো বিশ্ব বর্জ্যের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ছে। অপচয় আর প্রাণ–প্রকৃতি–মানুষের জন্য বিধ্বংসী তৎপরতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্বব্যবস্থার আসল চেহারা। জলবায়ু পরিবর্তনসহ সমুদ্র, নদী মহাবিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বর্জ্যবান্ধব উন্নয়নে সরকারের একগুঁয়ে উন্মাদনায় বাংলাদেশে বিপদ বাড়ছে আরও বেশি। দিনে দিনে আরও অরক্ষিত হয়ে পড়ছে দেশ ও মানুষ।
আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক