নদী নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ও উপেক্ষিত
২০১৯ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের নদ-নদীর জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ঐতিহাসিক একটি রায় প্রদান করেছেন। ২৮৩ পৃষ্ঠার এই রায় অনুযায়ী দেশের সব নদী এখন জীবন্ত সত্তা। রায়ে নদীর ক্ষতি করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’কে দেশের সব নদীর অভিভাবক ঘোষণা করা হয়েছে।
আমরা যারা নদীকর্মী হিসেবে নদীর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছি, তারা ওই রায়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। কিন্তু রায় প্রদানের প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেলেও সেই রায়ের বাস্তবায়ন কিংবা প্রতিপালন আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। অথচ এই রায়ের পূর্ণ প্রতিপালন থাকলে বাংলাদেশের সব নদীকে যেমন রক্ষা করা সম্ভব, তেমনি নদীবিষয়ক একটি দায়িত্বশীল প্রজন্ম গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু বাস্তবে সেই সম্ভাবনা সুদূরপরাহত বলেই মনে হচ্ছে।
দেশের নদীগুলো সুরক্ষার জন্য রায়ের শেষাংশে আছে ১৭টি নির্দেশনা। এর দশম নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সকল সরকারি বেসরকারি স্কুল, স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিতে এবং বিভাগে প্রতি দুই মাস অন্তর এক দিন এক ঘণ্টা নদীর প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা, রক্ষা, দূষণ, সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্লাস পরিচালনা এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্ব স্ব এলাকার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদী নিয়মিতভাবে পরিদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এ ছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নদীবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আরও নির্দেশনা রয়েছে। এসব কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা তদারক করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উচ্চ আদালত দায়িত্ব প্রদান করেছে। পাঠ্যপুস্তকে নদী বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করেছেন আদালত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘুম ভাঙছেই না। আমাদের দেশের তরুণসমাজের অনেকেই নদী সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাও রাখে না। উল্লিখিত রায়ের বাস্তবায়ন থাকলে তরুণ প্রজন্ম নদী সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারত। রায় প্রদানের পর আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই রায়ের বাস্তবায়ন হয়েছে বলে জানা নেই।
শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের নিয়ে প্রতি দুই মাসে একবার করে নদীবিষয়ক যে আলোচনা করার কথা বলা হয়েছে, সেসবেরও কোনো প্রতিপালন নেই। সরকারি–বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে নিয়মিতভাবে নদী ও পরিবেশ নিয়ে সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টার একটি করে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা বলা হয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ কোনো বাস্তবায়ন নেই। এই রায় কার্যকর করলে টেলিভিশনগুলোতে নদী নিয়ে প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। যার মাধ্যমে নদীসংকট এবং নদীর উপযোগিতা গণমানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত।
ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভার প্রতিনিধিদের প্রতি নদীর দখলদার চিহ্নিত করে তাদের তালিকা উন্মুক্ত স্থানে টাঙিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা আছে। এই নির্দেশনা পালন করলে দখলদারেরা লজ্জায় পড়ে হলেও দখলদারি ধরে রাখার চেষ্টা করতেন না। ইউনিয়ন-উপজেলা-পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের প্রতি তিন মাসে একবার নদীবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দিনব্যাপী ‘নদীবিষয়ক র্যালি, চিত্র প্রদর্শনী ও বিভিন্ন প্রকার প্রতিযোগিতা, আলোচনা এবং সেমিনার’ করার নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। ‘কাজীর গরু’র মতো নির্দেশনা কাগজেই আছে, বাস্তবে নেই। এই নির্দেশনা পালন করলে সাধারণেরাও নদীর প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠত।
যারা নদীর দখলদার, তারা যাতে জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য নির্বাচন করতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যারা নদীর দখলদার হিসেবে চিহ্নিত, তাদের ঋণ দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। এই রায় বাস্তবায়িত হলে জনপ্রতিনিধিরা নদীর দখলপ্রক্রিয়া থেকে সরে আসতেন। ঋণ নিতে অসুবিধা হলে অনেকেই নদীর দখলদারি ছেড়ে দিতেন। নদীবিষয়ক যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ করার সময় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অনাপত্তি গ্রহণ করতে বলা হলেও তা মানছে না কেউ।
উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষা করা কি সম্ভব? রায় না মানা তো আদালতের প্রতি অবমাননা। আদালতের রায় অবমাননা হলে কি কোনো শাস্তি নেই? উচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনা পালন করা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর বাধ্যবাধকতা নেই? ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’কে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করার কথা বলা হলেও কার্যত সেই চেষ্টাও খুবই ধীরগতিসম্পন্ন।
উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী। এ রায় মানতে হবে, দেশের নদীগুলো রক্ষা করার জন্য নদীর প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করতে হবে। শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবাই নদীকে ভালোবাসবে। শিক্ষার্থী, কর্মজীবী, সাধারণ মানুষ—সবাইকে নদীর প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলার জন্য এ আইনের বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
আমরা বছরখানেক ধরে নদীপারের কিছু কিছু উচ্ছেদ কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু দখলদারের তুলনায় তা খুবই নগণ্য। নদী কমিশনের কাছে প্রেরিত জেলা প্রশাসকদের তথ্যের ভিত্তিতে নদী দখলদার অর্ধ লক্ষাধিক। যদিও বাস্তবে এর চেয়ে দখলদার অনেক বেশি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দখলদার চিহ্নিত হলেও উচ্ছেদ অভিযান তুলনামূলক খুবই ধীর প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। বর্তমানে যে উচ্ছেদ চলছে, এর ব্যয়ভার সরকারকে বহন করতে হচ্ছে। উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী যারা নদীর দখলদার ও দূষণকারী, তারাই নিজস্ব টাকা ব্যয় করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো।
সাধারণ মানুষ যদি আত্মোপলব্ধি থেকে নদীর প্রতি দায়িত্বশীল হতো, তাহলে আজ এই রায়ের প্রয়োজন হতো না। সরকারিভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে কেউই যেহেতু নদী রক্ষায় তৎপর নন, তাই রায়ের বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
নদী নিয়ে আমাদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা আর অবহেলার শেষ নেই। নদীর মতো বন্ধুকে আমরা ক্রমাগত দূরে ঠেলে দিচ্ছি। এমন বাস্তবতায় ঐতিহাসিক রায়ে শাস্তির বিধানের পাশাপাশি অনেক বড় করে দেখানো হয়েছে নদীর প্রতি দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করা। ১৭টি নির্দেশনার দিকে তাকালে অন্তত সেই সত্যই উপলব্ধি করা যায়।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও নদীর প্রতি পরিচর্যার যথেষ্ট অভাব। প্রকৃতির এত বড় আশীর্বাদ সত্ত্বেও আমরা নদীবিমুখ জাতিতে পরিণত হয়েছি। দেশের অসংখ্য নদী দখলদারেরাই ভোগ করছে। আইন ও রায়ের বাস্তবায়ন করলে নদীখেকোদের হাত থেকে নদী রক্ষা করা কঠিন হবে না।
তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক