বড় আদর্শ নিয়ে কাজে কর্তব্যবোধ থাকতে হয়
বাংলাদেশের উন্নয়নের বড় একটি দিক হলো, এই দেশের সরকারের সঙ্গে এনজিওগুলো খুব সাবলীলভাবে কাজ করেছে। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংকের কথা উল্লেখ করতে হয় বিশেষভাবে, বাংলাদেশের উন্নয়নে এদের ভূমিকা অসাধারণ। সব দেশে কিন্তু এনজিওগুলো এভাবে কাজ করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি পরিকল্পনা বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে, সেটা হলো সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন। মনে পড়ে, একসময় আমাদের মানিকগঞ্জের বাড়ি থেকে মামাবাড়ি বিক্রমপুরে যেতে দেড়-দুই দিন সময় লেগে যেত, এখন সেখানে লাগে কয়েক ঘণ্টা। এটি একটি বড় ব্যাপার। মানুষে মানুষে যোগাযোগ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করে। অ্যাডাম স্মিথ এ নিয়ে গবেষণা করেছেন।
ব্যাপারটা হলো, বাংলাদেশের এই উন্নয়নের পেছনে সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেটা আবার সব জায়গায় এভাবে হয়নি। ভারতে হয়নি, পাকিস্তানে হয়নি। আবার বাংলাদেশ যত দিন পূর্ব পাকিস্তান ছিল, তত দিনও কেন হলো না—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, ভারত-পাকিস্তান যেভাবে স্বাধীন হলো, আর বাংলাদেশ যেভাবে স্বাধীন হলো, তার মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। নানা কিছুর পর ১৯৪৭ সালে সাহেবরা চলে গেলেন। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলো। ভারতের তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে অনেক কিছু ছিল, তা ঠিক। কিন্তু ১৯৭০ সালে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের পর যে লড়াই-সংগ্রাম-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, সেটা একটা ব্যাপার বলে আমি মনে করি। ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের মেয়েদের ভূমিকা এবং নেতৃত্ব স্বীকার করার পেছনে রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিল কি না, তা দেখা দরকার। এর উত্তর আমি জানি না। এসব বিষয় ধর্তব্যে নেওয়া হলে বাংলাদেশের প্রগতির কারণ বোঝা সহজ হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে এনজিওগুলোর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। মেয়েদের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যেও বিশেষ চেতনা কাজ করেছে। এটি সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত করেছে।
>স্কাইপের মাধ্যমে শান্তিনিকেতন থেকে দেওয়া বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন বলেছেন বাংলাদেশের সাফল্যের কথা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মধ্যকার পার্থক্যের কথা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশে যে একদলীয় প্রাধান্যের সরকার গড়ে উঠেছে, সেখানে সরকারের জবাবদিহি কীভাবে থাকবে। এই প্রসঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মধ্যকার পার্থক্যের কথা বলব। জবাবদিহি হলো নিজের নির্ধারিত কাজের জন্য জবাব দেওয়া। রেসপনসিবিলিটি হলো অথবা যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তা পালন করা। অর্থাৎ আমি যদি অফিসে সময়মতো না যাই বা গেলেও ঠিকঠাক কাজ না করি, তাহলে আমি ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করলাম না। কিন্তু বড় আদর্শ নিয়ে কাজ করতে হলে কর্তব্যবোধ থাকতে হয়। এই প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কথা বলা যায়। খুবই সফল একটি প্রকল্প এটি। আমার তো দুবার ক্যানসার হয়েছে। এখনো সেই ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। আমি এই ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার চিকিৎসার আগের রেকর্ড আছে কি না। এটা খুঁজে বের করা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ঠিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। চিকিৎসক আমাকে বললেন, ‘আমার অফিস তো সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। এরপর এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। তবে এর মধ্যে আমি চেষ্টা করব।’ ব্যাপারটা হলো, আমি তাঁর পুরোনো রোগী। ২০০৪ সালে তিনি আমাকে দেখেছেন। ফলে পুরোনো রোগীর রেকর্ড বের না করলে কেউ বলতে পারত না, তিনি দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু তিনি কর্তব্যবোধ থেকে সেই রেকর্ড বের করে সেদিন রাত নয়টার সময় আমাকে ই-মেইল করলেন, ওসব পাওয়া গেছে। এটাই হলো কর্তব্যবোধ।
এবার এই প্রসঙ্গে আমার বাবার কথা বলি। তাঁর একবার কালাজ্বর হয়েছিল। তখন কালাজ্বর কেবল আবিষ্কৃত হয়েছে। এর ওষুধ কী, তা–ও লোকের কাছে পরিষ্কার নয়। তখন বাবার চিকিৎসার জন্য অনেকেই তাঁর সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। এটি তো দায়িত্বের প্রশ্ন নয়, কর্তব্যের। দুটির মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে।
এই কর্তব্যবোধের প্রসঙ্গে ফজলে হাসান আবেদের কথা বলি। তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। ১৯৭১ সালে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তখন তিনি যা করছিলেন, সেটা তাঁর নিছক দায়িত্ব ছিল না। পরবর্তীকালে তিনি যা করলেন, সেটাও নিছক দায়িত্ব ছিল না। কর্তব্যবোধের তাগিদে তিনি এসব করেছেন। আমি মনে করি, আমাদের যে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রগতি, তা নিহিত আছে আমরা নিজেদের দায়িত্ব কতটা পালন করি এবং মানবিক কর্তব্য আমরা কতটা পালন করতে পারি, তার মধ্যে। বাংলাদেশের সফলতার পেছনে এই কর্তব্যবোধের বিশেষ ভূমিকা আছে। এ বিষয়ে আমি এখনো কাজ করিনি। জঁ দ্রেজের সঙ্গে এ নিয়ে কাজ করছি। তবে একটা ব্যাপারে আমি পরিষ্কার, এটা মানবিকতার প্রশ্ন নয়, মানবিক কর্তব্যের প্রশ্ন।
আমাদের বাংলা সাহিত্যের মধ্যেও এই দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের দেখা পাওয়া যায়। নজরুলের যে ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতা—সেই কবিতায় কান্ডারির যে করণীয়, তা দায়িত্ব বা জবাবদিহির ব্যাপার নয়, মানবিক কর্তব্যবোধের ব্যাপার। আবার অভাবমোচন কীভাবে করা যায়, কীভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনার ঐতিহ্যও বাংলা সাহিত্যে আছে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যর প্রধান চরিত্র ফুল্লরার বারোমাস্যা। ফুল্লরা বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত বারোমাসের যে কাহিনি দেবী চণ্ডীর কাছে বর্ণনা করেছে, সেখানে নিম্নবিত্ত সমাজজীবনের প্রাত্যহিক বাস্তব চিত্র ধরা পড়েছে। এটি ফুল্লরার বারোমাসের জীবনচর্যার সুখ–দুঃখের আত্মবিবরণী।
যাহোক, বাংলাদেশ আমার প্রিয় জায়গা। এবার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আসতে পারলাম না। সারা পৃথিবীতেই এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। আমার আরেক প্রিয় দেশ ইতালিতেও এই রোগ ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ বছরের আগস্ট মাসে আসার আরেকটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। সমস্যা না থাকলে অবশ্যই আসব। তখন এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
(৯ মার্চ বাংলার পাঠশালা আয়োজিত অমর্ত্য সেন পাঠচক্র উদ্বোধন করার কথা ছিল অমর্ত্য সেনের। আসতে না পারায় স্কাইপের মাধ্যমে তিনি শান্তিনিকেতন থেকে বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতার অনুলিখন করেছেন প্রতীক বর্ধন।)