খালেদা জিয়ার সব এখন নিয়তির হাতে
রাজনীতিময় বাঙালি জীবন থেকে রাজনীতি মনে হয় উবে গেছে কিংবা ডুবে গেছে। রোববারের দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় আঁতিপাঁতি করে খুঁজে পেলাম দুটি শিরোনাম, যেখানে রাজনীতির লেবেল নেই, কিন্তু গন্ধ আছে। দুটোই এক কলামের ছোট খবর (প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০২০)। একটি হলো ‘সাংসদের দখলে মধ্যবিত্তের ৩২টি প্লট’। অন্যটি ‘এক মাস আগে জামিন, গতকাল জানাজানি’। দুইয়ের পাতায় ছোট্ট খবর দুটি। কিন্তু বেশ মজার। একটি খবরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য সারা জীবন লড়াই করেছেন। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি এখনো জেলে আছেন। তাঁকে কারাগারে রেখে কোনো উৎসব সফল হবে না।’ অন্যটিতে আছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বক্তব্য। ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি’ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদ যখন জেলে ছিলেন, বিভিন্নভাবে সরকারি হস্তক্ষেপ আমরাও লক্ষ করেছি।’
খবরগুলো মজার এ জন্য যে, কোন কাজটি কোন সময় জায়েজ আর কোন সময় নাজায়েজ, তা এখানে বেশ পরিষ্কার। আমাদের কথায় কথায় ম্যাকিয়াভেলির দরজায় টোকা দেওয়ার দরকার নেই। ঘরেই আছে পুরাণ এবং তা থেকে উৎসারিত প্রতীকী বয়ান—লঙ্কায় যে যায় সে-ই হয় রাবণ। হিন্দু পুরাণ রামায়ণে রাবণ হলেন রাক্ষসরাজা, ভীষণ খারাপ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখলেন মেঘনাদ বধ কাব্য। সেখানে রাবণ একজন দেশপ্রেমিক বীর। তিনি বলছেন:
রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে, ভীরু সে মূঢ়; শত ধিক তারে!
পুরাণের ভাষ্যমতে, রাম-রাবণ হলেন দ্বাপর যুগের চরিত্র। এখন ঘোর কলি। কলিকালে অনেক কিছুই উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। তবে একটি বিষয় আগে যেমনটি ছিল এখনো তেমনটিই আছে। এটি একটি বহুল-ব্যবহৃত বচন—জোর যার মুলুক তার। অতীতের এবং বর্তমানের রাজনীতির গলি-ঘুপচি ঘাঁটলে এই বচনের সত্যতা এবং যথার্থতা মেলে। তারপরও আমরা চার অক্ষরের একটি শব্দে বুঁদ হয়ে আছি—গণতন্ত্র। আমি ক্ষমতায় থাকলে ওটা থাকবে বাক্সবন্দী। আমি বিরোধী দলে গেলে ওটা হবে পরম আকাঙ্ক্ষার ধন। ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয়, ক্ষমতায় থেকে এটা বোঝেন কোন সাধুজন? ক্ষমতার নেশা বড় নেশা, চোলাই মদের চেয়েও বেশি।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নিয়মিত বিরতিতে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে। রাজনীতি নিয়ে সেখানে কথাবার্তা কমই হয়। একটি দলের একচেটিয়া দখলে এখন সংসদ। নবাব সিরাজউদ্দৌলা দরবারে ঢোকার সময় নকিব যে সুরে নবাবের আগমনবার্তা ঘোষণা করত, এখন ওই রকম সুরেই স্পিকারের আগমনবার্তা দেওয়া হয়। তিনি কারুকার্যময় একটি আসনে বসার পর শুরু হয় কথাবার্তা। সদস্যরা একের পর এক বলতে থাকেন তাঁদের কথা। শুরুটা হলো প্রথমে বন্দনা করি...জাতীয় একঘেয়ে বয়ান। টেলিভিশন খুলে অন্যান্য রম্য চ্যানেল বাদ দিয়ে একই শিবের গীত শোনার ধৈর্য কার আছে, কে জানে? বিরোধী দলের নামকাওয়াস্তে যাঁরা আছেন, তাঁদের তো ওই এক কথা—পঞ্চাশ বছর আগে তোমরা হেন করেছ তেন করেছ, আমরা এই করেছি, সেই করেছি। তারপর প্রমিত ভাষায় কিছু গালিগালাজ দুই পক্ষ থেকেই। এভাবে জাতীয় সংসদ হয়ে উঠেছে ‘গণতন্ত্রচর্চার কেন্দ্রবিন্দু’।
টিভির টক শোতে রাজনীতির কথাবার্তা হয়। অধিকাংশ চ্যানেলে দেখা যায়, এক পিস আওয়ামী লীগ আর এক পিস বিএনপি ধরে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার এবং আস্ফালন করতে থাকেন। দর্শকেরা এখানে একটু বিনোদন পান। তবে কথাবার্তা হাতাহাতির পর্যায়ে গেলে সঞ্চালক তাৎক্ষণিক বিজ্ঞাপন বিরতিতে চলে যান। বিরতি শেষ হলে কেউ কেউ আর ফিরে আসেন না।
আরেকটি কথা টক শো শোনার আগেই অংশগ্রহণকারীদের সুরত দেখলেই বোঝা যায়, কে কী বলবেন। সুতরাং না শুনলেও চলে। অবশ্য কথার চেয়ে বিনোদনের আকর্ষণেই দর্শক-শ্রোতা পুরো সময়টা বসে থাকার ধৈর্য পরীক্ষা দেন।
দেশে গোনার মতো রাজনৈতিক দল দুটি, আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। আওয়ামী লীগের এখন রাজনীতি না করলেও চলে। তারা ক্ষমতায় আছে, থাকবে। উন্নয়নের যে মহাসড়ক চালু হয়েছে, তা না থামা পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় থাকতে চায়। আরও দুটি মেয়াদ যে থাকবে, তা তো আগেই ঘোষণা দিয়েছেন দলের কোনো কোনো মুরব্বি। এখন তৈরি হচ্ছে রূপকল্প ২০৪১। এটাও একটা বার্তা।
বিএনপি নিয়ে এর আগে অনেক কিছু বলেছি, লিখেছি। নতুন করে বলার তেমন কিছু নেই। দুই বছরের বেশি সময় তাদের দলের প্রধান নেতা কারাগারে বন্দী। তিনি অসুস্থ। জেলখানায় তিনি যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, আমার মতো অয়ারাম-গয়ারাম যদি হতো, তাহলে পেত না। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তারপরও জেল তো জেলই। দুই বছর আগে দলের নেতা-কর্মীরা খালেদা জিয়াকে কোর্ট থেকে জেলে নেওয়ার সময় স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আমার নেত্রী আমার মা, বন্দী হতে দেব না’। বেশ ছন্দময় বাক্য। কিন্তু তাঁরা কথা রাখেননি। দুই বছর পার হয়ে গেল। সবাই যাঁর যাঁর কাজকর্ম নিয়ে আছেন। খালেদা জিয়া জেলখানায় নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তিনি কি বন্দিদশা কাটাতে পারবেন? তাঁকে বের করানো যে দলের কম্ম নয়, এটা দলও জানে, তিনিও বোঝেন। বিএনপি বলছে, এটি রাজনৈতিক মামলা। সরকারের ইন্ধনে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে। সরকার আদালতের ওপর খবরদারি করছে। এ কথাই জি এম কাদের বলেছেন। তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে যে, ‘বিভিন্নভাবে আমরাও সরকারি হস্তক্ষেপ লক্ষ করেছি।’
খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর স্বজনেরা গত শনিবার দেখা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে। তাঁর বোন সাংবাদিকদের কাছে আক্ষেপ করে বলেছেন, খালেদা বাঁচবেন কি না, এই তাঁর শঙ্কা। মানবিক কারণে মুক্তি দিয়ে তাঁকে বাঁচানোর আবেদন করেছেন তিনি।
আমার প্রশ্ন বিএনপির নেতা-কর্মীরা কই? তাঁরা তাঁদের প্রিয় নেত্রীকে মুক্ত করতে কী করছেন? তাঁদের ৪২ লাখ নেতা-কর্মীর নামে নাকি মামলা! তাঁরা কোথায়? তাঁদের ভয় কিসে? তাঁদের উদ্দেশে রাবণের উক্তি—যে ডরে, ভীরু সে মূঢ়; শত ধিক তারে!
এটি যদি ‘ন্যায়যুদ্ধ’ হয়, তাহলে তাঁরা গণমানুষকে পাশে পাবেন। যদি ক্ষমতায় যাওয়ার খায়েশ হয়, তাহলে মানুষ তাঁদের কেন সমর্থন করবে? মানুষ তো স্থিতাবস্থা চাইবে। একদল ঠিকাদারের বদলে আরেক দল ঠিকাদার কাজ পাবেন, এ জন্য মানুষ কেন রাস্তায় নামবে?
খালেদা জিয়ার জন্য মমতা হয়। তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ছিল। ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এখন আর কাজে আসছে না। আদালতের কাছে তাঁর আর কিছু পাওয়ার নেই। নিয়তিই এখন ভরসা। মধুসূদন দত্তের কথায় বলা যায়:
বিষাদে নিঃশ্বাস ছাড়ি কহিলা সুরথী
লঙ্কেশ,—বিধির বিধি কে পারে খণ্ডাতে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]