প্রতিবেশীর ঘর বাঁচলে নিজের ঘরও বাঁচে
দিল্লি অনেক দূরে, আবার কাছেরও। যখন সেখান থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংসতার খবর আসে, তখন মনে হয় দিল্লি অনেক দূরে। আবার যখন শুনি সেখানেও মানুষ বাঁচাচ্ছে মানুষকে, আগলে রাখছে প্রতিবেশীদের, আশ্রয় দিচ্ছে আপন ঘরে বা মন্দিরে, তখন এই দিল্লিকে প্রতিবেশী মনে হয়। প্রতিবেশী যখন প্রতিবেশীর পাশে থাকে, তখন জীবন নিরাপদ। প্রত্যেকে আমরা যদি প্রতিবেশীর ঘরের নিরাপত্তা হই, তাহলেই নিজের ঘরের নিরাপত্তা নিশ্চিত। দিল্লিতে যেসব মানুষ প্রতিবেশীর ঘর বাঁচাতে লড়ছেন, তাঁরা তাঁদের দেশ বাঁচাচ্ছেন, তাঁদের মানবতা বাঁচাচ্ছেন, ধ্বংস ঠেকিয়ে নতুন দিনের আভাস জাগিয়ে রাখছেন।
খবর জানাচ্ছে, দিল্লির অশোকনগরে বিপদে পড়া ৪০ জন মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছে হিন্দুরা। গত মঙ্গলবার যখন তাদের বাড়িঘর ও দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা দিয়ে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁরা। দিল্লির শিখ গুরুদুয়ারাগুলো প্রাণভয়ে পালানো মুসলমানদের ভরসার জায়গা। প্রেমকান্ত বাঘেল নামের এক ব্যক্তির গল্প সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানায়। মুসলিম প্রতিবেশীর ঘর পুড়তে দেখে তিনি এগিয়ে যান। তাঁর চোখে শিববিহার এলাকা হিন্দু-মুসলমানের এক শান্তিপূর্ণ আবাস। বাইরের লোক এসে সেখানে মুসলমানদের বাড়িতে পেট্রলবোমা ফেলে। আগুনের ওই নরকে তিনি ঢোকেন। একে একে বাঁচান ছয় প্রতিবেশীকে। কিন্তু বন্ধুর মাকে তুলে আনতে গিয়ে পুড়ে যায় তাঁর শরীর। কিন্তু যে মানুষটি মানবতার সমান উচ্চতায় উঠে গেলেন, নিচু মানসিকতার কেউ তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এল না। একটা কোনো গাড়ি পাওয়া গেল না তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। ডাকলেও অ্যাম্বুলেন্স এল না। শরীরের ৭০ ভাগ পুড়ে যাওয়া মানুষটি তাঁর মুসলিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভুগলেন। সকালে কোনোমতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
এ রকম অজস্র গল্পের জন্ম হচ্ছে, সন্তানকে শেখানোর মতো মানবতার মৌলিক দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে। সাহায্য চেয়ে ১৩ হাজার ফোনকলের একটিতেও সাড়া দেয়নি দিল্লির পুলিশ। আবার সেখানেই সীমান্তে দায়িত্ব পালন করা এক পুলিশ কর্মকর্তা গুলির আওয়াজ শুনে পোস্ট ছেড়ে দাঙ্গাকারীদের মোকাবিলায় ছুটে যান। অথচ সীমান্তে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের কর্মস্থল ছেড়ে যাওয়া মানে কঠোর শাস্তি। অথচ জেনেশুনে তিনি তা করেছেন এবং হামলাকারীদের গুলির মুখে এলাকাটিকে রক্ষা করেন। উচ্চ আদালতের এক বিচারক মধ্যরাতে নিজের বাড়িতে আদালত বসিয়ে পুলিশের গাফিলতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেন, হামলায় উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়েরের নির্দেশ দেন। মহানুভবতার চেয়েও এটা বেশি। এর নাম জনকল্যাণের সাহসিকতা। অনেকেই মহানুভব, মানুষের জন্য আমাদের মন কাঁদে ঠিকই, কিন্তু নিজের ক্ষতির ভয়ে কিছু করি না। দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিশ্চয়ই জানতেন তাঁর সাহসের মূল্য দিতে হবে। হয়েছেও। পরদিনই তাঁকে বদলি করা হয় আরেক রাজ্যে।
এসব ঘটনাই হলো সেই রুপালি রেখা, খুব দুঃসময়ে যখন আর আলো নেই, তখন কালো মেঘ চিরে একটা রুপালি রেখা দেখা যাবেই। হতাশার মধ্যে ওইটুকু রেখাই আশার রজ্জু। ওই রজ্জু ধরে এগোলে আশা আছে, বিশ্বাস আছে, আস্থা আছে। এটুকুই হলো মানবতার বীজ, যখন রাষ্ট্র, সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়, তখন এই বীজ থেকেই গজিয়ে ওঠে মানবতার বৃক্ষ। মানবতার এই বীজ থাকা মানে সমাজ আবারও জাগবে।
দিল্লি যখন পুড়ছে, তখন যাঁরা ওই রুপালি জাগিয়ে রেখেছেন, তাঁরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন সমাজটাকে। রাষ্ট্র ছাড়াও মানুষ বাঁচে, কিন্তু সমাজ ছাড়া মানুষ কল্পনা করা যায় না। প্রতিবেশিতা ছাড়া সমাজ অসম্ভব। যদি মুখ দেখাদেখি না থাকে, যদি উৎসবে বা শোকে সহমর্ম না হই, যদি বিপদের দিনে পাশে না দাঁড়াই, তাহলে সমাজের মৃত্যু ঘটবে। দিল্লির সাম্প্রদায়িক নিধনবাজরা জানে যে মুসলমান মেরে তারা শেষ করতে পারবে না। তাহলে কেন এসব করছে? কিছু মানুষ মেরে, বাকিদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে বা পায়ের নিচে রেখে দেশ চালাবে। সংখ্যাগুরু যাতে তাদের এসব কাজ মেনে নেয়—অন্তত যেন চুপ থাকে। সেই নীরবতাকেই সম্মতি বলে প্রচার করে তারা দেশের সহায়-সম্পদের নিয়ন্ত্রণ হাতিয়ে নেবে। সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতনের শেষ লক্ষ্য তাই সংখ্যাগুরুকেও নিস্তেজ করে বশ করা। সংখ্যাগুরুকে সংখ্যালঘুর প্রতি ঘৃণায় মাতাল না করতে পারলে তো তা সম্ভব নয়। তাই তারা হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সমাজটাকেই ভেঙে দিতে চাইছে।
কয়েক পুরুষের তিল তিল ভালোবাসা ও শ্রমে-ঘামে যে ‘ঘর’ বা ‘হোম’ তৈরি হয়, যেখানে ফিরলেই নিরাপদ ভাবে ঘরের মানুষ। বাইরে মার খেয়েও মানুষ ফিরতে চায় ঘরে। শত শত বছরে যে এলাকাকে ‘দেশ’ বলে ভাবা হয়, যেখানে থাকে কয়েক পুরুষের কবর, কয়েক প্রজন্মের নাভি যে মাটিতে পোঁতা হয়, সেই দেশের মানুষ মানে ‘দেশীয়’। এই ঘরের নিরাপত্তা শেষ হয়ে যায়, যখন বাইরের লোক ঘরে এসে আগুন দেয়, হত্যা বা ধর্ষণ চালায়। দেশের দেশীয়তার শান্তি শেষ হয়ে যায়, যখন এক নাগরিক আরেক নাগরিকের পাশে দাঁড়ায় না, এক সামাজিক আরেক নাগরিককে সমাজের বাইরে বলে মনে করে।
সাম্প্রদায়িকতা এ জন্যই জঘন্য যে তা মানুষকে অমানুষ বানিয়ে ফেলে, সমাজকে পরিণত করে হিংস্র প্রাণীর অবাধ অভয়াশ্রম। মানবজাতির সবচেয়ে পুরোনো ও নিকৃষ্ট ব্যাধি এই সাম্প্রদায়িকতা। মানবজাতির অশুভ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বীভৎস এটা। মানুষের ধারণাটাই বদলে দেয় এই হিংসা। সাধারণ ভালো মানুষটিকেও এই হিংসা খুনি বানিয়ে ফেলে। মানুষ যে কারণে মানুষ তা হলো তার সমাজ, সেই সমাজ তখন নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিবেশিতার এই রূপ আমি পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দু বাড়িঘরে হামলার পরে সরেজমিনে দেখেছি। ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সেখানে কয়েক শ লোক বাইরে থেকে এসে স্থানীয় এক হিন্দু ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলা চালায়। আক্রান্ত হন তাঁর হিন্দু প্রতিবেশীরাও। ২০১৩ সালের নভেম্বরের সেই ঘটনা দেখে এসে লিখেছিলাম, ‘নিতাই (ছদ্মনাম) পেশায় নরসুন্দর। বৃদ্ধা বিষ্ণুপ্রিয়া বৈষ্ণব। সরকার ফার্মেসির যুবক ও তাদের বাড়ির বাসিন্দাসহ এ রকম অনেকেই সেদিন আশ্রয় পেয়েছিলেন প্রতিবেশী মুসলমানদের বাড়িতে। বাবলু সাহার গুদাম যাঁরা বাঁচান, তাঁরাও মুসলমান। নিতাইয়ের বাড়ির মেয়েরা আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী জয়নাল মুহুরির বাড়িতে। প্রায় সব হিন্দু পরিবারের মেয়েদের সেদিনের আত্মরক্ষার গল্প এটাই। মুহুরি ভদ্রলোকটির চেহারায় পরহেজগার; অথচ তাঁর মতো মুসলিমদের সামনেই তাঁকে বুক চিতিয়ে বলতে হয়েছিল, ‘বাড়িতে ঢুকতে হলে আমাকে মেরে ঢুকতে হবে।’ ...বনগ্রামের হিন্দু-মুসলমানের যে মিলিত সমাজটা এখনো বেঁচে আছে; সেটাই দেশের আত্মা। সেই আত্মাটাই যেন বাজারের এক দিনমজুরের মুখ দিয়ে কথা বলে উঠল। তিনি চান না, কেউ ভয়ে থাকুক বা দেশ ছেড়ে চলে যাক। তাঁর ভাষায়, ‘হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে না থা’লে দ্যাশে শান্তি থাহে না।’
এই একসঙ্গে থাকাটাই সমাজ। আর সমাজ মানে বাড়ির পাশে বাড়ি, ঘরের পাশে ঘর, মানুষের পাশে মানুষ। একটি ঘর পুড়ে গেলে অন্য ঘরটিও অনিরাপদ হয়ে যায়। প্রতিবেশীর ঘর বাঁচলে তাই দেশও বাঁচে, মানুষও বাঁচে। প্রতিবেশীর ঘর নিরাপদ মানে সমাজ নিরাপদ। প্রতিবেশীর ঘরে যতক্ষণ আশ্রয় আছে, ততক্ষণ মানুষ আছে।
কিন্তু প্রতিবেশী শত্রু হয়ে গেলে নিজের ঘরও আর ঘর থাকে না। এটা সব দেশের সংখ্যালঘুর জন্য সত্য। সংখ্যাগুরু যদি হিংস্রতার পক্ষে চলে যায়, সেখানে সংখ্যালঘুর আর ঘর থাকে না। আমরা কোনোভাবেই চাই না, বাংলাদেশের কোনো মানুষ তার প্রতিবেশীর জন্য হুমকি হোক। এই দায়িত্ব রাষ্ট্রেরও যেমন, সমাজেরও তেমন। বঙ্গবন্ধু তো ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে হুঁশিয়ার করেই গেছেন, ‘শুনুন, মনে রাখুন শত্রু পিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু–মুসলমান যারা আছে আমাদের ভাই, বাঙালী, অ-বাঙালী তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ (৭ মার্চের ভাষণ/ শেখ মুজিবুর রহমান)
আরও আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গিয়েছেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না। ...পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে সেই ম্লেচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবে।’ (রবীন্দ্র–রচনাবলী, প্রবন্ধ, সমাজ, ব্যাধি ও প্রতিকার, ১৩১৪) যিশুও বলে গিয়েছিলেন, প্রতিবেশীকে ভালোবাসুন। প্রতিবেশীর ঘরই মানবতা। তাকে সম্মান করুন।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]