গ্রামে গ্রামে শিশুমনে আপন শহীদ মিনার
ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমির চত্বরে তখন মাইকে তারস্বরে গান বাজছে। চলছে ত্রয়োদশ জাতীয় পিঠা উৎসব। জাতীয় চিত্রশালায় ঢোকার মুখে কংক্রিটের রাস্তায় দিন শেষে ঝুড়ি-কোদাল সামনে রেখে বিশ্রাম করছেন খেটে-খাওয়া কয়েকজন মানুষ।
তাঁদের পাশে বড়সড় সাদা সাইনবোর্ড জানান দিচ্ছে তিন নম্বর চিত্রশালায় চলা একটি প্রদর্শনীর কথা। হলদে ওড়নায় মাথা-মুখ মুড়ে উবু হয়ে বসা ছোট একটি মেয়ের গেরুয়া মাটিতে আঙুল দিয়ে শহীদ মিনার আঁকার ছবিটায় চোখ আটকে যায়।
ছবিটার নিচে লাল অক্ষরে লেখা, বাংলার আপন সৌধ—শিশুদের বানানো শহীদ মিনার নিয়ে শিল্পী খুরশিদ আলম আলোকের ছবির প্রদর্শনী।
শেষবেলায় তিন নম্বর গ্যালারিতে ঢুকে বোবা নীরবতা আর ভুতুড়ে হলুদ আলোয় মনটা একটু দমে যায়। তারপর সাদা দেয়ালে সারি সারি টাঙানো আলোকচিত্রগুলোর কাছে গেলে অনেক অনেক না-জানা গল্পের না-শোনা কথা মনকে উৎসুক করে তোলে।
খড়ের ঘর বা টিনের ঘরের আঙিনায়, ঘরগুলোর আনাচকানাচে, খোঁটায় বাঁধা খড়খেকো গরুটির পেছনে মাটির ঢিবিতে, ভিটা-লাগোয়া জঙলায়, কখনো নদীর পাড়ে গাছের নিচে, বাঁশবনের ছায়ায়, কখনোবা অনাবাদি পড়ে থাকা খেতে অথবা ফসলি জমির ধারে অনন্য একেকটি শহীদ মিনার দেখি।
বাঁশের অথবা কলাগাছের কাঠামোয় খবরের কাগজ, নির্বাচনী পোস্টার অথবা রঙিন কাগজ সেঁটে মিনার তৈরি হয়েছে। কখনো কাঠামোটি মাটি দিয়ে গাঁথা ইটের। কখনো শুধুই মাটির। কোনোটিই খুদে নির্মাতাদের হাতের নাগালের চেয়ে বেশি উঁচু নয়।
সাদা মিনার আছে, তবে বেশির ভাগই রঙিন। লাল, নীল, বেগুনি, সবুজ, গোলাপি—ছোট মানুষের মনের রং যত দূর যায়, আর যতটুকু তারা জোগাড় করতে পারে।
মিনারে মিনারে নানা রঙে ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘মহান একুশে ফেব্রুয়ারি’, কখনো শুধুই এলোমেলো আঁকাবাঁকা অ-আ-ক-খ লেখা। কখনো হয়তো রঙের অভাবে শুধু কালো বা লাল কালিতে। মিনারগুলো ঘিরে লাল-সবুজ পতাকার ঝালর, সামনে নানা রঙের অল্পবিস্তর ফুল ঢালা।
একটি মিনারের পটভূমিতে লাল রং করা ইটের কোঠা দেখলাম। তবে প্রায় সব ছবিই বলছিল, মিনারের স্রষ্টারা গ্রামের সাধারণ গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। পটভূমি সাজাতে অনেকগুলো মিনারের পেছনে শাড়ি টাঙানো হয়েছে। মায়েদের সাধারণ শাড়ি।
ঝাঁকড়া চুলের যে মেয়েটি গোড়ালির ওপরে বসে শহীদের নতমুখী মায়ের মাথায় হাত রেখে তার ইটের কাঠামোয় মাটি লেপছে, সে হতে পারত ‘পথের পাঁচালী’-এর ছোট্ট দুর্গা। খালি গা, খালি পা অপুকেও যেন দেখি। ফেব্রুয়ারির শেষে গ্রামে শীত থাকে, কিছু ছেলেমেয়ের গায়ে সোয়েটার।
বিরান গ্যালারিতে এসব দেখতে দেখতে সামনে একজনকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করি, আলোকচিত্রগুলোর শিল্পীকে কোথায় পাব। খয়েরি-লাল পাঞ্জাবি পরা লোকটি বললেন, ‘আপনার সামনে!’
তারপর খুরশিদ আলম, ডাকনাম যাঁর আলোক, আমাকে তাঁর আর ছবিগুলোর গল্প বলেন। ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়তেন, একুশে এলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আর রাস্তায় আলপনা আঁকতেন। ১৯৯৭ কি ৯৮ সালে একুশের আগ দিয়ে তাঁকে একটা কাজে গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়েছিল।
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় আলোকের গ্রামের নামটি কাউটিয়া। সকালবেলা গ্রামের পথে যেতে শিশুদের এক জটলা দেখে কাছে গিয়ে তাদের বানানো শহীদ মিনারের দেখা পান। ছবি তোলেন।
আলোকের মনে হলো, এমন নিশ্চয় অনেক শিশু বানায়। তারপর থেকে প্রতিবছর একুশ এলে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। মানিকগঞ্জেই বেশি। রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরাতেও ঘুরেছেন।
আর ছবি তুলেছেন বরগুনায়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর আলোক প্রথম সেখানে গিয়েছিলেন ত্রাণ দিতে। পরের বছর একুশের আগে গিয়ে দেখলেন, ঝড়ে বিপর্যস্ত সেই জনপদেও শহরের বস্তিতে আর কাছাকাছি গ্রামে বাচ্চারা শহীদ মিনার বানাচ্ছে।
সিডর-পরবর্তী সেই ছবিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। বিরান খেতে, ছন্নছাড়া উঠানে বানানো সেসব শহীদ মিনারে রঙের কী বাহার! করাতকল থেকে জোগাড় করা কাঠের গুঁড়ো রং করে ফুলের অভাব পোষানো হয়েছে।
নিজের গ্রামে কালীগঙ্গা নদীর একেবারে তীরে পতাকার ঝালরঘেরা একটি মিনারের ছবি দেখিয়ে আলোক বলেন, ২০১৫ সালের সেই একুশের পর জায়গাটাই নদীতে চলে গেছে। ওই নদীরই পাড়ে এক সকালে একটি মেয়েকে দেখেছিলেন আপনমনে মাটিতে আঙুল টেনে শহীদ মিনার আঁকতে। অতি দরিদ্র পরিবারের সেই মেয়ে, প্রেমা, এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে।
একটি ছবিতে পাশাপাশি বড় আর ছোট দুটি শহীদ মিনার। বড় ছেলেমেয়েরা নাকি কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিল না, তাই ছোটরা নিজেদের মিনার বানিয়ে নিয়েছে! একজনেরটা দেখে অন্যরাও শহীদ মিনার বানাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে—এই উৎসাহ আলোকের চমৎকার লাগে।
আমাকে আলোক বলেন, ‘এই যে ছোট শিশুরা, এরা কোনো দিন শহীদ মিনারে আসতে পারেনি, পারবেও না। কোথাও হয়তো ছবি দেখে আবেগ দিয়ে এই শহীদ মিনারটা তৈরি করেছে, এটা আমার কাছে অসাধারণ লাগে।’
আরও বলেন, ‘এটার একটা প্রাণ আছে। গ্রামে গ্রামে যারা বানাচ্ছে, এইখানে গেলে আপনি একটা প্রাণ খুঁজে পাবেন। বিশাল একটা প্রাণ।’
চোখ, কান, মন—দেখে তিনজন। আলোক দেখতে পেরেছেন। গত বছর থেকে চাইছিলেন, সবাইকে দেখাতে। এ বছর সে সুযোগ পেলেন।
একুশেতে ২১ পারসেন্ট ছাড়, দেখনদারি আর সিন্দুকে কোটি কোটি টাকার এই জমানায় ছবিগুলো দেখে মনে আরাম হলো। আপনার দেখার সুযোগ আছে আজ বিকেল থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা: সাংবাদিক