কেজরিওয়ালের পেছনেও সেই লোক?
ভারতের দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টির বিজয়ের পেছনেও রয়েছেন এক রহস্যমানব—প্রশান্ত কিশোর। ভারতের কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক অনেক নেতার ভোটে বিজয়ের পেছনে।
কেজরিওয়ালের জন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ফাঁদ পেতেছিল বিজেপি। সেই ফাঁদ এড়িয়ে কীভাবে জিতলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল? হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের চক্রে না পড়ে, জাতীয় ইস্যুতে ছটফটানি না দেখিয়ে নাগরিক সেবার ওপর জোর দিয়ে জিতে গেলেন তিনি। এসব বুদ্ধি তাঁকে দিয়েছিলেন ভারতের ভোটগুরু বলে খ্যাত প্রশান্ত কিশোর বা পিকে। ভারতে ভোট জয়ের এই জাদুকর যাঁর পক্ষে, তিনিই নাকি জেতেন, এমন মিথ তৈরি হয়েছে তাঁকে ঘিরে।
তালিকাটা দেখা যাক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার, কংগ্রেসপ্রধান রাহুল গান্ধী, পাঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা কাম মুখ্যমন্ত্রী অমেরেন্দ্র সিং আর হালের চমক অন্ধ্রের জগন (জগন মোহন রেড্ডি)—সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। রাজীব গান্ধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কথা পুরোপুরি না শোনার ফলে পুরো ফল পাননি বলে বলা হয়। মোদি ও নিতীশের সঙ্গে কাজের সময় প্রশান্ত যে স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, উত্তর প্রদেশ কংগ্রেসের কাছে সেই স্বাধীনতা পাননি। কংগ্রেস জিতে ফিরতে পারেনি।
এককথায় প্রশান্ত কিশোর এখন ভারতের ভোটগুরু। মোদি তখন গুজরাটে বারবার তিনবার ফেরত আসার যুদ্ধে হালে পানি পাচ্ছিলেন না, সেই ২০১২ সালে মোদির গুজরাট বিধানসভা ভোটের হাল ধরেন প্রশান্ত কিশোর। সবাইকে তাক লাগিয়ে জিতিয়ে দেন হারের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্তিত মোদি আর তাঁর দল বিজেপিকে।
লোকসভার ভোটে ইজ্জত খোয়ানোর পর আম আদমি পার্টির ভেতর প্রশান্ত কিশোরের সাহায্য নেওয়ার পক্ষে চাপ তৈরি হলেও অরবিন্দ তেমন একটা গা করেননি। কিন্তু বিজেপির মার মার কাট কাট প্রচারে একরকম ভড়কে গিয়ে প্রায় শেষ মুহূর্তে রাজি হয়ে যান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তখন হাতে মাত্র দেড় মাস সময়। প্রায় নিরুপায় হয়ে তিনি তাঁর কুরসি রক্ষার দায়িত্ব তুলে দেন প্রশান্ত কিশোরের হাতে। দায়িত্ব পেয়ে পিকে অরবিন্দকে বলেন, তাঁর বোল–চাল পাল্টাতে হবে। চরম মোদিবিরোধী ভাবমূর্তির বদলে নরম এক ভাবমূর্তির লেবাস পরতে হবে। কেন্দ্রবিরোধী, সংঘাতমূলক, আপসহীন কথাবার্তার লাগাম টেনে নগরের বিকাশ আর নাগরিকদের স্বস্তি তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা আর অর্জনের বার্তার ভলিউম বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রশান্ত কিশোরের মতে, বিজেপি তাঁকে গরম করার চেতানোর কৌশল নেবে। চটলেন তো হারলেন। বিজেপি আক্রমণ করলেও অরবিন্দ যেন তা উপেক্ষা করার নীতি নেন। না চটে, না চিল্লিয়ে নিজের উন্নয়নের ছবি তুলে ধরতে হবে। কেজরিওয়াল সে কথা মেনে নেন।
বিজেপি যতই আক্রমণাত্মক হয়েছে, আম আদমি ততই হয়েছে বিনয়ী। মানুষের সহানুভূতির পাল্লা তাদের দিকেই গড়িয়েছে। বিজেপি জোর দিয়েছিল মেরুকরণের রাজনীতিতে, সে রাজনীতির সামনাসামনি জবাব না দিয়ে আম আদমি পার্টি মেরুকরণের পরিবর্তে উন্নয়নকে প্রধান ইস্যু হিসেবে সামনে আনতে পেরেছে।
ভোট–কুশলী প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁর শাসনামলের এক আমলনামা বা রিপোর্ট কার্ড তৈরি করে ২৫ হাজার পরিবারের কাছে নিজের হাতে সে আমলনামা পৌঁছে দেন। আম পার্টির হয়ে ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন দিল্লির প্রায় ১৫ হাজার গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে। তাঁদের অনেকে তাঁর চিঠির জবাব দিয়েছেন, প্রশ্ন করেছেন, সেসব প্রশ্নেরও উত্তর তাঁকে দিতে হয়েছে। জবাবদিহির এমন আয়োজন দিল্লিবাসী আগে দেখেনি। পিকের আরেক পরামর্শ ছিল বিজেপির বাইরে ধর্মকর্মের প্রতি অন্য মানুষদেরও যে সম্মতি আছে সেটা দেখানো, প্রচার করা। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের যে ধর্মে মতি আছে, সেটা প্রমাণের জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে হনুমান মন্দির দর্শন করতে হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, প্রচারের মঞ্চ থেকে পাঠ করেছেন হনুমান চল্লিশা। আশীর্বাদ চেয়েছেন ভগবানের কাছে সবার সঙ্গে বিজেপির জন্যও। দিল্লির কয়েক হাজার বয়স্ক মানুষকে বিনা খরচে তীর্থ করানোর বিষয়টিও বড় করে প্রচারে নিয়ে আসেন। এভাবে জনতাকে প্রকাশ্যে কিন্তু কৌশলে জানিয়ে দেওয়া হয় হিন্দুত্ব বিজেপির একার সম্পত্তি নয়, অন্যরাও ধর্মচর্চা করেন।
প্রশান্ত কিশোরের আরেক ফরমান ছিল অরবিন্দ কেজরিওয়াল আর তাঁর দলবল যে পারিবারিক মানুষ; সেটাও মানুষের নজরে আনতে হবে। তাই কেজরিওয়াল মন্দিরে গিয়েছেন দারাপুত্র পরিবার নিয়ে। ভোটের ফলাফল জানাজানি পরে, কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে যখন কেজরিওয়াল প্রথম সাক্ষাৎ করতে আসেন, তখনো তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী–পুত্র-কন্যা।
বিহারের রথাস জেলার করানে ১৯৭৭ সালে জন্ম নেওয়া প্রশান্তের পড়াশোনা বক্সার জেলায়। জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি করতেন জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচিতে। সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট (নির্বাচন কৌশলী) হিসেবে নির্বাচনপ্রত্যাশীদের কোচিং সেন্টার খুলে মিডিয়ায় জোরশোর প্রচার শুরু করেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদি তাঁকে ডেকে পাঠান। প্রশান্ত মোদিকে শেখান কীভাবে প্রেসের সঙ্গে বাতচিত করতে হয়, কীভাবে হাসিমুখে না রেগে জবাব দিতে হয় অস্বস্তিকর প্রশ্নের। একেবারে ওয়ান টু ওয়ান কোচিং। মোদি ছিলেন খুবই সিরিয়াস অনুগত ছাত্র। ফলও পান হাতেনাতে। ২০১৪ লোকসভার নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরকে সঙ্গে রাখেন মোদি। তবে সাথিদের বলে দেন প্রশান্ত কিশোরের মগজের ফটোকপি করে রাখতে। তিনি যা যা বলেন, তা ব্যাখ্যাসমেত অক্ষরে অক্ষরে টুকে রাখতে। প্রশান্ত কিশোর না থাকলে যেন তাঁর অভাব অনুভব না করেন। আমিত শাহ তাঁর দলবল নিয়ে সেই কাজটা করেন পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে।
এরপর তাঁকে ডেকে নেন বিহারের নিতিশ কুমার। নিতিশ এখন বিহারের একচ্ছত্র রাজা বলা চলে। প্রশান্ত কিশোরের কোচিংয়ে পাঞ্জাব রাজ্যে ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে ওয়াইএসআর কংগ্রেস। সেখানকার ওয়াইএসআর কংগ্রেস প্রধান অমেরেন্দ্র সিং তাঁকে বিহার থেকে নিয়ে যান নির্বাচনী উপদেষ্টা হিসেবে।
গত লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশে যখন মোদি–হাওয়া, তখন ব্যতিক্রম ছিল অন্ধ্র প্রদেশ। অন্ধ্রের কংগ্রেসের প্রধান জগন মোহন রেড্ডি রাজ্যের ১৭৫টি বিধানসভা আসনের ১৫২টি আসনেই জয় পেয়েছিলেন। ২৫টি লোকসভা আসনের বেশির ভাগই নিজেদের দখলে রেখেছিলেন।
সামনে পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর বিধান সভার নির্বাচন। শোনা যাচ্ছে, ওই দুই রাজ্যেও দায়িত্ব পেয়েছেন ভোটকুশলী প্রশান্তের ভোট কোচিং সেন্টার। দেখা যাক হোমওয়ার্ক করতে না শেখা রাজনীতি কোচিং সেন্টার দিয়ে কতটা আর কতক্ষণ চলে।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।
[email protected]