সাবেক সচিবদের বৈঠক: ধীমান প্রবীণ নাগরিকদের কাজে লাগাতে হবে
সম্প্রতি ৪২ জন সাবেক সচিব শিল্পকলা একাডেমিতে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সরকারের চিন্তনভান্ডার (থিংক ট্যাংক) হিসেবে কাজ করার অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন। সভায় যোগদানকারী সাবেক সচিবদের তালিকা থেকে দেখা যায় যে তাঁদের অনেকেই অবসর গ্রহণের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ লাভ করেছেন। এমনকি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় নিয়োগ লাভ করেছেন। এ সংবাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বিষয়টির গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মানুষের এখন গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। আগে ৫৭ বছর বয়সে অবসর গ্রহণকারী সরকারি কর্মকর্তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানাতে টুপি, জায়নামাজ, তসবিহ ও হাঁটার লাঠি উপহার দেওয়া হতো, যাতে হাঁটাহাঁটি করে রোগবালাইমুক্ত থেকে পরকালের পাথেয় সঞ্চয় করতে পারেন। বাস্তবেও তাই হতো। অবসর গ্রহণের কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁদের জীবনাবসান ঘটত। কিন্তু জনমিতির পরিবর্তনের কারণে এখন ৫৯ (মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে ৬০) বয়সে অবসর গ্রহণ করলেও অনেকেরই আরও ১৩-১৪ বছর সক্ষম আয়ু থাকে। সম্প্রতি একজন কর্মক্ষম সচিবের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপিত হলো। এ হিসাবে কারও কারও অবসর-পরবর্তী কর্মক্ষম সময় প্রায় ৩০ বছর। এ সময়টা সাবেক সচিবেরা কী করবেন? এ জন্যই বোধকরি সচিব থাকাকালে অনেকেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, বিভিন্ন সংস্থার পদ বাগানোর জন্য রাজনীতিবিদদের তোষণ করে থাকেন, তাঁদের অন্যায় কাজে সহায়তা করেন। কারণ, পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে জীবনযাপনে তাঁরা অভ্যস্ত নন।
তাই সচিবেরা অবসর-পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে তাঁরা কী করবেন এটা একটা সংগত প্রশ্ন। অতিগুরুত্বপূর্ণ এ প্রশ্নটি সামনে তুলে আনার জন্য সাবেক সচিবেরা আমাদের ধন্যবাদ পেতে পারেন। তবে সমস্যা হলো, চিন্তনভান্ডার হিসেবে কর্মে ইচ্ছুক সাবেক সচিবেরা বিদ্যমান ধ্যানধারণার বাইরে (আউট অব দ্য বক্স) কিছু ধারণা সামনে আনবেন—এটাই সবার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ব্যক্তি খাতের অর্থনীতিতেও তাঁরা সরকারের বাইরে কিছু ভাবতে পারলেন না!
সমস্যাক্লিষ্ট বিশাল বাংলা
অথচ তাঁরা সরকারের বাইরে ব্যক্তি খাতের বিশাল বাংলার কথা ভাবতে পারতেন। মোট দেশজ উৎপাদনের চাকচিক্যময় পরিসংখ্যানের আড়ালে আমাদের বৃহত্তর জনপদ নানান সমস্যাক্লিষ্ট। গত রোববার সন্দ্বীপে তিন দিনের ব্যক্তিগত সফর শেষে ফিরেছি। এখানকার যাতায়াতব্যবস্থা পঞ্চাশ বছর আগে যা ছিল, তার চেয়েও অবনতি ঘটেছে। কুমিরা ও সন্দ্বীপ ঘাটে জলযানে আরোহণ ও অবরোহণ পুলসিরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। অথচ এখন সুদিন—প্রমত্ত মেঘনা নদী এখন শান্ত। তবু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষা, দীর্ঘ লাইন ইত্যাদি নিয়ে যাত্রীদের দুর্দশা বর্ণনাতীত। বর্ষাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াতে দুর্ভোগের কথা চিন্তা করতেও গা শিউরে ওঠে। সারা দেশে এ ধরনের নানা সমস্যা, যেমন জলাবদ্ধতা, পানীয় জলের সংকট, ভূমি দখল, নদীদূষণ, বয়স্ক ও কর্মরত মায়েদের শিশুদের দেখাশোনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসম্পর্কিত নানা সমস্যায় জর্জরিত। সাবেক সচিবেরা তাঁদের অভিজ্ঞতা ও প্রভাব খাটিয়ে এসব সমস্যা সমাধানে জনগণ ও সরকারের সেতুবন্ধ হতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের আয়েশি সীমার (কমফোর্ট জোন) বাইরে যেতে চান না।
শুধু পুরোনো সমস্যাই নয়, নতুন সব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে গ্রামে। যেমন ধরুন, সন্দ্বীপের অনেকেই আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত। তাঁরা পরিবার-পরিজনদের জন্য বিদেশ থেকে নিয়মিত টাকা পাঠান। জানি না এর ফলে কি না, রবিশস্যের এ ভরা মৌসুমে মাঠের পর মাঠ খালি। শর্ষে, ডাল, আলু, শীতকালীন সবজি, কোনো কিছুরই আবাদ নেই। কেবল রাস্তার পাশে কিছু শিমগাছ ছাড়া অন্য কিছু দেখলাম না। জমি পতিত রাখা তো জাতীয় ক্ষতি। পাশেই নতুন চর জেগেছে। বাড়ির পাশের জমিই পতিত, চরের জমির কী হবে? সবকিছুর অগ্নিমূল্য। কলা বিক্রি হয় জোড়ায়। এক জোড়া ছোট বাংলা কলা ১৬ টাকা। হালি ৩২ টাকা! রিকশা, স্কুটার, মোটরসাইকেল ভাড়া ঢাকার দ্বিগুণ। শুধু পুরুষেরাই নন, নারীরাও আয়েশি হয়েছেন। সকালে দোকানে নাশতার জন্য তন্দুর রুটি ও ভাজির জন্য ভিড়। অনেকে লাইন দিয়ে বাসায় তন্দুর রুটি নিয়ে যাচ্ছেন।
বাড়ছে কেবল দোকান আর হাটবাজার। বাসাবাড়ি, মসজিদ, কবরস্থান সর্বত্র বাড়ছে টাইলসের ব্যবহার। রাস্তার পাশে, বাড়ির সামনে সর্বত্র দোকান আর দোকান। দোকানভর্তি পণ্য প্রায় সবই বাইরে থেকে আনা। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পাশের চরগুলো থেকে আসছে। ইট আসছে খুলনা থেকে। স্থানীয় উৎপাদন নেই বললেই চলে। বিদ্যুৎ আসার ফলে নতুন কোনো কার্যক্রম দেখলাম না। রেমিট্যান্স কমে গেলে এসব জনপদে কী যে হবে! সাবেক সচিবেরা এসব বিষয় নিয়ে সরেজমিনে গবেষণা করতে পারেন। সমস্যা সমাধানে কাজ করতে পারেন।
রাজনীতিবিদ ও বর্তমান সচিবদের প্রতি অনাস্থা
আরও কথা আছে। সাবেক সচিবেরা যদি সরকারের চিন্তনভান্ডার হন, তাহলে বর্তমান সচিব ও রাজনীতিবিদেরা কী করবেন? তা ছাড়া সাবেক সচিবেরা যখন পদস্থ ছিলেন, তখন সরকারের চিন্তনভান্ডার প্রয়োজন ছিল না। এখন নতুন করে চিন্তনভান্ডার প্রয়োজন হলো কেন? তবে কি বর্তমান সচিব ও রাজনীতিবিদদের চিন্তাশক্তি হ্রাস পেয়েছে? দেশে তো অনেক বেসরকারি থিংক ট্যাংক আছে। সাবেক সচিবেরা সেখানে যাচ্ছেন না কেন? আর দেশের বেসরকারি থিংক ট্যাংকগুলোই বা কেন তাঁদের লুফে নিচ্ছে না?
সাবেক সচিবেরা দ্বিধাবিভক্ত
তাঁরা সব সাবেক সচিবকে নিয়েই একটি সংগঠন সৃষ্টির কথা বলেছেন। তা কি আদৌ সম্ভব? অনেক আগে থেকেই সচিবেরা ‘জনতার মঞ্চ’ ও ‘উত্তরা ষড়যন্ত্র’ এই দুই ভাগে বিভক্ত। এর বাইরেও সচিবেরা আছেন। কিন্তু তাঁরা এ দুই দলের দাপটে কোণঠাসা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাঁদের সহায়তা নিয়ে একদল অন্য সহকর্মীদের বঞ্চিত করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এহেন দলীয়করণের শিকার হয়েছেন প্রশাসনের অনেক সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও পরিশ্রমী কর্মকর্তারা। অনেক যোগ্য কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ সততা ও যোগ্যতার কর্মকর্তারা সচিব, সিনিয়র সচিব হয়েছেন।
সরকার কী করতে পারে?
সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে সাবেক সচিবদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো প্রয়োজন। তবে তা সরকারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নয়। সাবেক সচিবদের যাঁরা উপজেলা পর্যায়ে কাজ করতে চান, তাঁদের কাছ থেকে দীর্ঘদিনের বা নতুন উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য বেসরকারি খাতের সঙ্গে একযোগে কাজ করার জন্য সরকার প্রস্তাব আহ্বান করতে পারে। এবং বাছাইকৃত সমস্যা সমাধানকল্পে তঁাদের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে পারে। যেমন ধরুন, সচিবদের সভার প্রস্তাবনাটি অত্যন্ত চমৎকার। একবার ভাবুন, সুলিখিত এ প্রস্তাবনার লেখক যদি উপজেলা পর্যায়ে স্কুল বা কলেজের ভাষাশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন, তাহলে আমাদের অনগ্রসর এলাকার শিক্ষার সংকট কিছুটা লাঘব হতো। আশার কথা, কিছু সাবেক সচিব নির্ধারিত সময়ে অবসর গ্রহণ করে নিভৃতে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন।
একটি দৃষ্টান্ত
রাজধানী ও বড় শহরের বাইরে মেধাবী ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা কাজ করলে কী হয়, তার একটি দৃষ্টান্ত দিই। বন্ধু মাহবুব হোসেন শহীদের সঙ্গে আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে থাকতাম। মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজ, ঢাকা ও সবশেষে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক হেলথে মাস্টার ডিগ্রি করে চাকরিজীবন শেষ করে তিনি তাঁর চাচাতো ভাই আবদুল মতিনকে নিয়ে নিজ গ্রাম ধামরাইয়ের শৈলানে সজাগ নামের এনজিওর মাধ্যমে জনকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে গ্রামটি অন্য সব গ্রাম থেকে আলাদা। গ্রাম হলেও সব নাগরিক সুবিধা এ গ্রামে আছে। আমাদের অন্য অনেকের মতো ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে তাঁর আবাস আছে। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন তিনি ধামরাইয়ে বসবাস করছেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
সাবেক সচিবেরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসারের কথা বলেছেন। ১৯৭২ সালের জুন মাসে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন এভাবে, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে, এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’ এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কেন্দ্রে তিনি দেখেছিলেন গ্রামকে। গ্রামকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা ভাবাই যায় না। সাবেক সচিবেরা কি তাঁদের কমফোর্ট জোন ছেড়ে এ পথে এগোবেন?
ভারত সরকারের সাবেক সচিব ও আইএএস কর্মকর্তা ড. কামাল তাওরির মন্তব্য দিয়ে শেষ করি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘৬০ বছরের বেশি কারও সরকারের বেতনভুক কোনো পদে থাকা উচিত নয়। পরবর্তী সময় ব্যয় করা উচিত আগে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে কী কী ভুল হয়েছে তা অনুধাবন ও কীভাবে তা শোধরাতে হবে সেই কাজে।’ ভাগ্যবান সাবেক সচিবদের দেশ ও জাতি অনেক দিয়েছে। এবার তাঁদের প্রতিদানের পালা। আশা করি, সাবেক সচিবেরা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণে এগিয়ে আসবেন।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব