যৌন হয়রানি চেপে রাখা যাবে না
যৌন হয়রানি নিয়ে কথা বলাকে আমরা যারা রীতিমতো পাপ বলে মনে করি, তাদের সবচেয়ে আগে এটা অনুভব করতে হবে যে এটা পাপ নয়। এটা ভুক্তভোগীর জন্য লজ্জার নয়। এটা প্রকাশে কোনো সংকোচ-দ্বিধা থাকা এই যুগের মেয়েদের অন্তত থাকা উচিত নয়। এ লজ্জা-ভয় তার বা তাদের হওয়া উচিত, যে বা যারা ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। যৌন হয়রানি নিয়ে আমাদের দেশে দণ্ডবিধির পাশাপাশি বিশেষ আইন আছে। তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা আছে। তারপরও এই হয়রানি ঘরে বা বাইরে কমছে না। কিছু কিছু আমরা জানতে পারি, বেশির ভাগই জানতে পারি না, কারণ যাঁরা এই হয়রানির শিকার, তাঁরা বিষয়টা বলতে সংকোচ বোধ করেন।
এই যে বলতে না পারা বা সংকোচ বোধ করা অথবা দ্বিধান্বিত হওয়া—এই সবকিছুর পেছনেই আমাদের সমাজব্যবস্থা, মানসিক গঠন কাজ করে, তা আমরা জানি। কিন্তু আপনার চুপ করে থাকা বা চেপে যাওয়ার অর্থ যে ভিন্ন হচ্ছে, সেটার দিকেও লক্ষ রাখা জরুরি। এই সমাজে কেবল আমি বা আপনি একা বাস করি না; আমরাই যদি এসব হয়রানি চেপে যাই বা চুপ করে মেনে নিই, যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে, এভাবে ভাবি, তাহলে ভাববেন না এখানেই ঘটনার শেষ।
আসলে এখানেই ঘটনার শুরু।
নিপীড়ক সাহস পেয়ে গেল পরবর্তী সময়ে আরও কারও সঙ্গে অপরাধটি করার, ঘটনাটি ঘটানোর। এমনকি এটা ছত্রাকের আকার ধারণ করল, যার জন্য কমবেশি আপনি বা আমিও দায়ী। কারণ প্রতিবাদ না করা বা না বলাও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া, বেড়ে উঠতে আরেকভাবে সাহায্য করা।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা বিভাগ প্রস্তুত থাকলেও মূলত এ ধরনের ঘটনা অহরাত্র ঘরে বা বাইরে ঘটার পরও আমরা কয়জন আইনগতভাবে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছি বা করতে পারছি?
আমরা নিত্যদিন যেভাবে নানা মামলা-মোকদ্দমা আদালতে বা থানায় দায়ের হতে দেখছি, তার মধ্যে যৌন হয়রানির মামলা কতগুলো? মামলা হচ্ছে না মানেই আমরা ধরে নিতে পারি না যে ঘটনা ঘটছে না বা যৌন হয়রানি বিষয়ে আমরা সচেতন নই? অবশ্যই আছি।
আমরা বলছি না, বলতে পারছি না, কারণ আমাদের পরিপার্শ্ব অবস্থা আমাদের বলতে সহযোগিতা করছে না। সামাজিক অবকাঠামো এখনো সেই পর্যায়ে আমাদের বলার সুযোগ করে দিচ্ছে না।
যারা মনে করে, এই হয়রানি বিষয়ে কমবেশি আমরা সচেতন নই, তারা ভুল। ঘটনার ভিকটিম একা সচেতন হলেই তো আর চলবে না; পারিপার্শ্বিক সবার সহযোগিতারও দরকার আছে। এই হয়রানিমূলক ঘটনা যাঁর সঙ্গে ঘটে, একমাত্র তিনিই জানেন অনুভূতি কতটা ঘৃণ্য। কিন্তু তারপরও আমরা বলতে পারি না। আমরা বলি না। আমরা সংকোচ বোধ করি। আগামী দিন কী হবে, সেটা নিয়ে ভাবি। আমরা লজ্জা পাই, ভয় পাই। কারণ, এই অভিযোগগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করতে গেলেই তাঁরা আমাদের থামিয়ে দেন, ‘এই কথা যেন আর কেউ জানতে না পারে!’ এই যে থামিয়ে দেওয়া, এটাই অপরাধীকে সাহস জোগায় আরও বেশি অপরাধ করতে। এই যে বলতে না দেওয়া বা বলতে না পারা, সেটাও এসব অপরাধ সংঘটনে কমবেশি ভূমিকা রাখে।
বলতে দিতে হবে। শুনতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক, তার অপকর্মের যেন বিচার হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে এর মাত্রা দিনে দিনে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
আমাদের মগজেই পচন ধরে আছে। যেখানে যাব বিচার চাইতে, তাদের সচেতনতা ও সহযোগী মানসিকতার অভাব। থানা-পুলিশ এখনো আমাদের এসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শই দেয়। যদিও আমলে নেয়, তারপর শুরু হয় হয়রানি—নানামুখী প্রশ্নবাণে আবারও সেই শ্লীলতাহানি। বিষয়টা গড়াতে গড়াতে যখন আদালতে যায়, সেখানে ক্যামেরা ট্রায়ালের বিধান থাকার পরও প্রকাশ্য আদালতে যখন ভিকটিমকে জিজ্ঞাসা বাদ করা হয়, তখন তাঁর ওপর চলে আরেক দফা হয়রানি। মানসিক চাপে আক্রান্ত নারী ক্লান্তি বোধ করেন। তাঁর আর ইচ্ছা করে না অভিযুক্তর নিযুক্ত আইনজীবীর নোংরা প্রশ্নের উত্তর দিতে। নিরাপত্তাহীন সাক্ষী অধিকাংশ সময়ই চান না আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে।
বিশেষ সময়ে বা দিনে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেশকে আমরা ঢেকে দিই, তবে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা আসলে আজ অবধি কেবল আইনই পাস করেছি। প্রয়োগে সফলতার মুখ খুব বেশি দেখিনি। আইনের সঠিক বাস্তবায়নের পদ্ধতি কি আমাদের জানা নেই?
এ রকম হয়রানি বন্ধ করে, নারী ও শিশুর জন্য ভয়মুক্ত দেশ তৈরি করা নিশ্চয়ই অসম্ভব না। ভিকটিমের মৌনতা ভাঙতে সাহায্য করা বা এই নীরব নির্যাতনের সরব প্রতিবাদ করতে পারাও দায়িত্বর মধ্যে পড়ে। যৌন হয়রানি করা যে একটা জঘন্য অপরাধ এবং মানসিক অসুস্থতা, সে কথাও আমাদেরই বোঝানোর দায়িত্ব নেওয়া দরকার। সেই দায়িত্ব পালন করতে হলে সবার সহযোগিতা দরকার। প্রয়োজন নানামুখী সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া এবং গভীর আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা। নইলে বাংলাদেশ কোনো দিন নারী বা শিশুবান্ধব রাষ্ট্রে পরিণত হবে না।
একের পর এক আইন পাস করাই শেষ কথা নয়, আইন বুঝতে সবাইকে সাহায্য করা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ, এসবের ইতিবাচক ভূমিকা রাখাই আসল।
দিলরুবা শরমিন: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী