ভুল দাওয়াই রোগ বাড়াতে পারে
একসময় এ দেশে সমাজতন্ত্র শব্দটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। বুঝে হোক কিংবা না বুঝে অনেকেই ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতেন। সে যুগ হয়েছে বাসি। এই শব্দ দুটি এখন অনেকের কাছেই অচ্ছুত। ‘সমাজতন্ত্র’ সংবিধানে ফিরে এসেছে ঠিকই। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তকচ্ছ হয়ে ঢলে পড়েছে। ফলে সমাজতন্ত্র এখন রাজনীতির হেঁশেলে দুয়োরানি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল ব্যাংক জাতীয়করণের। তখন লড়াইটা ছিল পাকিস্তানের ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে। তারাই দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। সেই সঙ্গে রাজনীতিও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ এক নীতিনির্ধারণী ভাষণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যাংক জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। দুটি ছাড়া সব ব্যাংকই ছিল পাকিস্তানিদের মালিকানায়। পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকার এগুলো ‘অধিগ্রহণ’ করে। সেই সঙ্গে বাঙালি মালিকানাধীন ব্যাংকও। অর্থাৎ পুরো ব্যাংকিং সেক্টর সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। যেহেতু সরকার ‘পরিকল্পিত অর্থনীতির’ পথ ধরেছিল, ব্যাংক জাতীয়করণ ছিল তার অন্যতম অনুষঙ্গ।
পাকিস্তান আমলে ব্যাংকগুলোর নাম ছিল ইংরেজি। স্বাধীন দেশে এর বাংলা রূপান্তর হয়। বেছে নেওয়া হয় চমৎকার সব নাম—সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, পূবালী ও উত্তরা। পঁচাত্তরের পালাবদলের পর বেসরকারি খাতে ব্যাংকিং সেক্টর উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বাঙালি উঠতি ধনিকেরা ব্যাংক বানানোর দৌড়ে শামিল হন। একে একে অনেকগুলো ব্যাংক গজিয়ে ওঠে। সবগুলোই ইংরেজি নামে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা ক্রমে হয়ে ওঠেন সাবালক, ক্ষমতাশালী ও কর্তৃত্বপরায়ণ। এগুলোকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেকগুলো ‘বিজনেস হাউস’। অথবা বলা চলে, কোনো কোনো বিজনেস হাউস নিজস্ব ব্যাংক বানানোর পথ ধরে। মনে হয় ব্যবসা-শিল্প যত বড় হোক না কেন, নিজেদের ব্যাংক না থাকলে অর্থনীতি ঠিক কবজায় আসে না। এখন তো শুধু ব্যাংক নয়, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ও বানাচ্ছেন। বেসরকারি খাতে ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির এক উর্বর জমি হলো বাংলাদেশ।
আমজনতার কাছ থেকে আমানত রাখে ব্যাংক। জনগণের প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের লাভ কিংবা উদ্বৃত্ত টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে। সেই টাকা ধার নেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। যাঁরা ব্যাংকে টাকা রাখেন, তাঁরা বিনিময়ে কিছু লাভ চান। আবার ব্যাংক থেকে যাঁরা টাকা ধার নেন, ব্যাংক তাঁদের কাছ থেকেও কিছু লাভ চায়। আমানতের সুদ আর ধারদেনার সুদের তারতম্যের ওপর ব্যাংকের মুনাফা নির্ভর করে। কথা হলো ব্যাংক কী পরিমাণ মুনাফা করবে, এর কোনো সাধারণ মানদণ্ড নেই। অভিযোগ আছে যে ব্যাংকগুলো চলছে খেয়ালখুশিমতো।
অনেকেই রাতারাতি ধনী হতে চান। সে জন্য তাঁরা ব্যাংকের দ্বারস্থ হন। ব্যাংক যখন তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন তাঁরা ইচ্ছেমতো সেখান থেকে ধার নিতে পারেন। ধার নিলেই যে শোধ দিতে হবে, এমন নয়। ব্যবসায় মন্দা থাকে। রুগ্ণ শিল্প বলে একটা কথা বেশ চাউর হয়েছে। ব্যাংকের ধার শোধ না করার অনেক বাহানা। কিন্তু তাই বলে তো গলায় গামছা দিয়ে টাকা আদায় করা যায় না। যাঁরা ব্যাংকের ‘মালিক’, তাঁরা বা তাঁদের পেয়ারের লোকেরাই তো ব্যাংক থেকে টাকা নেন। সুতরাং ঋণগ্রহীতাকে একটু আরাম দেওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে ‘লোন রি-শিডিউল’ করতে হয়। অর্থাৎ শোধ দেওয়ার মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অনেক বকেয়া ঋণ থাকলেও তখন তা আর খেলাপি ঋণ হিসেবে কাগজে-কলমে ধরা হয় না। এ এক মজার খেলা।
সরকারি ব্যাংকগুলোর মালিক তো জনগণ। সরকার হলো তার জিম্মাদার। তো সেখানে নয়ছয় করার নানান ফন্দি আছে। সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হলো পছন্দের লোককে তার চেয়ারম্যান-পরিচালক বানিয়ে দেওয়া। ব্যাংকিং বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা না থাকলেও চলে। তাঁরা তো টাকা চেনেন। তাঁরা অনুমোদন দিলে বিশিষ্ট লোকেরা ঋণ পান। ব্যাংক সরকারি কিংবা বেসরকারি যে খাতেই থাকুক না কেন, এ এক কামধেনু। তাকে দোহন করার প্রক্রিয়া একই রকম। খুবই স্থূল এবং নির্মম।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো যাতে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে চলে, সে জন্য দরকার আইনকানুন, বিধিবিধান। এক পরিবারের কয়জন এবং কয় মেয়াদে পরিচালক থাকতে পারবেন, তার একটা উচ্চসীমা ছিল। সেটি বদলানো হয়েছে। ফলে ব্যাংকে পারিবারিক মালিকানা আরও সুরক্ষিত হয়েছে।
সম্প্রতি ব্যাংকের সুদের হার নিয়ে বেশ কথা চালাচালি হয়েছে। যাঁরা ঋণ নেন, তাঁদের দাবি ঋণের সুদহার কমাতে হবে। তাঁরা অনেক ক্ষমতাবান। তো একজোট হয়ে তাঁরা সুদের হার কমাতে পেরেছেন। এটি হবে শতকরা ৯ ভাগ। আমরা জানতে পেরেছি, আগামী এপ্রিলে এটি কার্যকর হবে। ফলে আমানতের ওপর যে লভ্যাংশ দেওয়া হয়, সেটিও কমবে। জানা গেছে, এটি হবে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। ইতিমধ্যে এটি কার্যকর হয়ে গেছে। প্রশ্ন এখানেই।
মানুষের উদ্বৃত্ত টাকা ভোগে খরচ হবে, নয়তো তা সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকে থাকবে। সঞ্চয় মানে হলো একজন বর্তমানে ভোগ না করে টাকা জমিয়ে রাখবেন ভবিষ্যৎ ভোগের জন্য। তিনি কেন এটা করবেন? দুটি কারণে তিনি তা করবেন। প্রথমত, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সে জন্য পাথেয় থাকা দরকার। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকে লগ্নি করলে যে মুনাফা পাওয়া যায়, তার আকর্ষণে। এখন যদি আমানতকারীর প্রাপ্য মুনাফা কমে যায়, তিনি ব্যাংকে টাকা রাখবেন কেন?
গত সপ্তাহে পাওয়া কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। এটাকে আমরা এক শব্দে বলি মূল্যস্ফীতি। খরচ যদি বাড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে আর ব্যাংকে সঞ্চয় রেখে যদি বছরে পাওয়া যায় ৬ শতাংশ, তাহলে মানুষ কেন ব্যাংকে টাকা রাখবে? নিতান্ত নিরুপায় না হলে সে তার ভোগ বাড়িয়ে দেবে, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদে বিনিয়োগ করবে, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু ব্যাংকে টাকা রাখবে না। মূল্যস্ফীতির এই হার যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে ব্যাংকে টাকা রাখলে বছরে ওই টাকা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কমে যাবে। তার ওপর অন্যান্য ব্যাংকিং খরচ তো আছেই। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ব্যাংকে তারল্যসংকট বাড়বে। আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।
এখনকার অবস্থা হলো যাঁরা বাংক থেকে ঋণ নেন, তাঁরা সংগঠিত। তাঁরা সরকারকে চাপে রাখতে পারেন। অথবা বলা যায়, তাঁরাই সরকার। অন্যদিকে অগুনতি আমানতকারী হলেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। অসংগঠিত। তাঁরা বড় ধরনের কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেন না। একবার যদি তাঁরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর তার অভিঘাত হবে প্রবল। নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখতে হবে, উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য আর কোনো উপায় বের করা যায় কি না।
সুদের হার কমে গেলে ঋণখেলাপি হওয়ার মাত্রা কমবে, এমন একটা মোক্ষম যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে। একই ব্যবস্থায় কেউ সময়মতো ঋণ শোধ করেন, কেউ খেলাপি হন। এটা কতটুকু অর্থনৈতিক কারণে আর কতটুকু খাসলতের কারণে, তা ভেবে দেখা দরকার। ভুল দাওয়াই রোগ বাড়াতে পারে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]