বড় যুদ্ধ এড়িয়ে জয়ের ইরানি কৌশল
ইরানিরা তাদের বীর জেনারেলকে হত্যার জন্য ট্রাম্পকে যতই অভিশাপ দিক, একটা ধন্যবাদ ট্রাম্পের পাওনা। ট্রাম্পের কারণেই ইরাকের আরও নিকটজন হয়েছে ইরান। ইরাকে আমেরিকার বেশির ভাগ কাজই বুমেরাং হয়েছে। যেমন জর্জ বুশ ইরাক দখলে নিলেও দেশটির নেতৃত্ব চলে গেছে ইরানপন্থী শিয়া গোষ্ঠীগুলোর কাছে। এদিকে সুলেইমানিকে হত্যা করে তাঁর আরাধ্য কাজ সেরে দিচ্ছেন ট্রাম্প। বর্তমান ও বিগত তিন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যে শয়তান চক্রের (অ্যাক্সিস অব এভিল) ভয় মার্কিন নাগরিকদের দেখাতেন, সুলেইমানির মৃত্যুর বদলায় সেই চক্র এবার সত্যিই সংগঠিত হয়েছে। এক সারিতে আমেরিকার মুখোমুখি ইরান-ইরাক-সিরিয়া-হিজবুল্লাহ এবং তাদের অধীন অজস্র ছোট-বড় যোদ্ধা গোষ্ঠী। মরণেও সুলেইমানি তাঁর কাজ করে যাচ্ছেন। ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের মুখস্থ হুমকির বুলি এখন ইরাকের বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। কারণ ইরানের হয়ে ইরাকও এখন তার দেশ থেকে মার্কিন সেনা সরানোর দাবিতে সোচ্চার। ইরাকের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের পর জার্মানি ইরাক থেকে কিছু সৈন্য ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে পুতিন সফর করছেন তুরস্ক, বসেছেন এরদোয়ানের সঙ্গে। তার আগে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সঙ্গেও তাঁর বৈঠকের খবর গণমাধ্যমে এসেছে।
মৃত্যুতেও সুলেইমানি সফল
সুলেইমানির হত্যার অভিঘাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে ইরাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকে দখলদারির আইনগত ভিত্তি যে চুক্তি, ইরাকি পার্লামেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে তা বাতিলে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের জন্য এই আহ্বান যদিও বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু ঘটনাবলি সেদিকেই যাচ্ছে। অন্তত এই প্রস্তাব পাশের পর ইরাকে আমেরিকান সেনারা রাজনৈতিকভাবে অবৈধ হয়ে গেল। আইনগত অবৈধ ঘোষণার আগেই যদি কোনো ইরাকি আমেরিকানদের ওপর হামলা করে, তাকে বিচারের মুখোমুখি করা রাজনৈতিক চাপের কারণেই কঠিন হবে। আর চুক্তি বাতিল হওয়া মাত্রই ইরাকের মাটিতে প্রতিটি আমেরিকান প্রাণ আক্রমণের বৈধ ও আকর্ষণীয় নিশানা বলে গণ্য হবে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও চমকপ্রদ। ইরাকের প্রভাশালী ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল সদর তাঁর সদর-সেনাদের আবার সক্রিয় করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ব্যক্তি ইরাকে বিপুল জনপ্রিয়। তাঁর হুকুমে চলে বিরাটসংখ্যক যুবকের এক বাহিনী। সুলেইমানির ইরাকি সহযোদ্ধা মোহানদিস নিহত হলেও মোহানদিসের মিলিশিয়া বাহিনী এখন সদর-সেনাদেরও পাশে পাবে। সুলেইমানি আরবজুড়ে যে মার্কিনবিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক জোট গঠনের কাজে অনেক দূর এগিয়েছিলেন, তাঁর লাশ সামনে রেখে সেই জোট আরও শক্তিশালীই হলো।
বিশ্বাসঘাতকতার শিকার সুলেইমানি
সবারই প্রশ্ন ছিল, সুলেইমানি কেন এ রকম প্রকাশ্যে ইরাকে চলাফেরা করছিলেন? এতই দুর্ধর্ষ যদি তাঁর নেটওয়ার্ক, তাহলে কেন বিপদের কোনো আভাসই ইরানিরা পায়নি? গুমরটা ফাঁস করেছেন ইরাকের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদুল-মাহদি। কোনো সামরিক নেতা হিসেবে নয়, সুলেইমানি ইরাকে এসেছিলেন কূটনৈতিক পাসপোর্টে, রাষ্ট্রীয় সফরে, সাধারণ বিমানে অতিথি হিসেবে। এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধে। ট্রাম্প ইরাকি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যাতে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেন। সুলেইমানির জন্য সৌদি আরব সমঝোতার বার্তাও পাঠিয়েছিল। তাই তিনি সশরীরে বাগদাদে এসেছিলেন ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে। ঘটনাটা ঘটেছে অনেকটা সৌদি সাংবাদিক খাশোগি হত্যার কায়দায়। সৌদি আরব আলোচনার জন্য জামাল খাশোগিকে তুর্কি দূতাবাসে ডেকে এনে হত্যা করেছিল।
ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগেই তাঁকে হত্যা করে শান্তির এই চিকন সুতাটি ছিঁড়ে ফেলা হয়।
সুতরাং সুলেইমানি ছিলেন ইরানের সরকারি বার্তাবাহক। যুদ্ধ শাস্ত্রে এবং কূটনীতিতে চিরায়ত একটা নৈতিকতা হলো, বার্তাবাহককে হত্যা না করা। সুলেইমানিকে হত্যা করে আসলে শান্তির বার্তাকেই হত্যা করা হলো। ইরাক জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক আইনের এই ন্যক্কারজনক লঙ্ঘনের প্রতিবাদ জানাবে। তবে আমরা জানি, তাতে কিছুই হবে না।
ট্রাম্প যদি হত্যার নির্দেশই দেবেন তাহলে শান্তির উদ্যোগ কেন নিতে বললেন? নাকি সেটা ছিল এক পাতা ফাঁদ। নির্দেশ তিনিই দিন বা দিক রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র, বা ইসরায়েল—ইরানের সঙ্গে শান্তি তারা চায় না। আমেরিকার যে মধ্যপ্রাচ্য-নির্ভরতা, ইরান তাকে কোনোভাবেই মানতে চায় না।
সৌদি তেল ও মার্কিন ডলারের অবিচ্ছেদ্য প্রণয়
মধ্যপ্রাচ্যের তেল শুধু আগুনই জ্বালায় না, তা শান্তিরও শত্রু। ওপরে ওপরে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, দেশপ্রেম, গণতন্ত্র রপ্তানি ইত্যাদির আড়ালে প্রায়ই চাপা পড়ে যায় সব সমস্যার মূলের এই জিনিস। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যে যুদ্ধের উসকানি চলে, তারও কারণ সেসব গণমাধ্যমের পেছনে ক্রিয়াশীল আন্তর্জাতিক তেল-লবির স্বার্থ। তারা কোনোভাবেই চাইতে পারে না মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসুক বা কোনো বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতে সৌদিদের সঙ্গে ইরানের সমঝোতা হোক।
তাই ট্রাম্প সাহেব ইমপিচমেন্ট থেকে দৃষ্টি সরাতে ইরান-যুদ্ধ চান; তা বোধ হয় সঠিক নয়। সুলেইমানিকে হত্যা করে যুদ্ধোন্মাদনায় চাপিয়ে নিজেকে পরের বারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট করার যে সমীকরণ টানা হয়, সেটা দৃশ্যমান কারণ হলেও মূল কার্যকারণ না। তেল আর ডলার হলো আমেরিকার সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির দুই ডানা। এক ডানায় পাখি ওড়ে না। জটিল আলোচনার সংক্ষেপ: সৌদি আরবের মতোই আমেরিকার অর্থনীতি তেলনির্ভর। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দখলে থাকা তেলের খনিগুলি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত তেলের মূল্য ডলারে রূপান্তরিত করে আমেরিকান ট্রেজারিতে পাঠায়। আমেরিকা ডলারকে বিনিময় মুদ্রার বদলে পণ্যের মতো করে ব্যবহার করে। অন্যদিকে গোটা দুনিয়া তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় মার্কিন ডলারের আকারে করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ ডলার ছাপানোয় যেহেতু তারাই একচেটিয়া, সেহেতু এই পণ্যের দাম তারা যেটা ঠিক করবে সেটাই মানতে হবে সবাইকে। আর দুনিয়ার সব দেশ ডলারে তাদের রিজার্ভ রাখে বলে, ডলারের চাহিদা সব সময় থাকে বলে, এর দরপতন খুব একটা মারাত্মক হয় না। আন্তর্জাতিক তেল-বাণিজ্য ডলারে করার ফলে ডলার সবাইকেই কিনতে হবে। চীনও করে, রাশিয়াও সেটা করে।
আমেরিকার অর্থনীতি ঋণ-নির্ভর। আমেরিকান ট্রেজারির বন্ড কেনার মাধ্যমে দুনিয়ার প্রায় সব দেশ তাদের ঋণ দেয়। রাষ্ট্রীয় এই ঋণ মার যাবে না বলে এমনকি চীনও এটা করাই লাভজনক মনে করে। তাই একদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের আধিপত্যে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমৃদ্ধ হয়, আবার আমেরিকার ট্রেজারি ব্যাংকের বন্ড কেনার মাধ্যমে বিদেশি রাষ্ট্র আসলে আমেরিকাকে সুদের বিনিময়ে ঋণ দেয়। তেল ও ডলারের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমেরিকা তার অর্থনীতিকে সবল রাখে। আর এটাই ঠিক করে দেয় তার পররাষ্ট্রনীতি তথা যুদ্ধনীতি। তেল যেখানে ডলার সেখানে। তেলের পেছনে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো আর ডলারের শক্তিসামর্থ্য ধরে রাখার জন্য আছে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ডলারে বাণিজ্য করা থেকে সরে যাওয়ার শাস্তির উদাহরণগুলো দেখলে এটা বোঝা যায়।
তেল ও ডলারের এই অসম বিবাহের ইতিহাস ও কার্যকারণ ব্যাখ্যা করেছেন আমেরিকার এই তেল-ডলার নীতির অন্যতম প্রবক্তা মাইকেল হাডসন।
১৯৫০-এর কোরীয় যুদ্ধ এবং আরও বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকা দেখে, বিদেশে যুদ্ধ চালাতে গেলে তার ব্যালান্স অব পেমেন্টে সমস্যা হয়। এর সমাধান তারা বের করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সোনার বদলে ডলার মজুত করার বিধান। কিন্তু এটা তো একা করলে হবে না, তাই সব দেশকে বাধ্য করা হয় সোনার বদলে ডলারে সম্পদ সঞ্চয় করতে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করতে। এর সুফল নিয়েই আমেরিকা দুনিয়াজুড়ে ছড়ানো তার ৮০০ সামরিক ঘাঁটির খরচ মেটায় ব্যালান্স অব পেমেন্টে গোলমাল না লাগিয়েই। এ জন্যই মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনিগুলো তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার নীতি হলো পোড়ামাটির নীতি। তারা মধ্যপ্রাচ্যের তেল নিঃশেষ না করা পর্যন্ত নিজেদের দেশের তেল-গ্যাস তুলবে না। অন্যদিকে কম খরুচে ফ্রেকিং প্রযুক্তিতে তোলা তেল যুদ্ধ-অর্থনীতিতে চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফাও বাড়ায়। এই লোভে পড়েই খনিজ জ্বালানি-নির্ভর অর্থনীতি তারা বদলায় না; আর সেকারণেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়লেও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কিছু করতে তারা নারাজ।
তেল যেখানে, পছন্দের সরকার বসাও সেখানে; জনগণের যা হয় হোক। এটা হলো পোড়ামাটি নীতির রাজনৈতিক দিক। তার জন্য নিয়ন্ত্রণ করতে হয় ওই সব দেশের সরকারকে। বেয়াড়া হলে করতে হয় বোমাবর্ষণ কিংবা সামরিক অভ্যুত্থান এবং সরকার-বদল। যেহেতু সৌদি আরব ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো তথা ওপেক এই তেলের মজুত ও ব্যবসার খুঁটি, সেহেতু এই খুঁটিটা নিজের আওতায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এই পরিকল্পনায় সৌদি আরব, ওপেক-ওআইসি এবং ইসরায়েলই হলো আসল ভিত্তি। নজর আরও তীক্ষ্ণ করে আনলে দেখা যাবে, তেল-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক সৌদি আরবই বিশ্বময় আমেরিকার সামরিক খরচ জোগায়, বিনিময়ে পায় নিজের নিরাপত্তা। আমেরিকা ছাড়া যেমন সৌদি আরব অনিরাপদ, তেমনি সৌদি অর্থায়ন ও ওয়াহাবি মতাদর্শ পুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি ছাড়া মার্কিন-সৌদি ভূরাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখাও কঠিন। কেননা, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আমেরিকার পক্ষে আপন তার নাগরিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বিদেশে দখলদারি বজায় রাখার পথ প্রায় বন্ধ। নতুন যুদ্ধ ও দখলদারির জন্য হাজার হাজার মার্কিন যুবককে ভিয়েতনামের সময়ের মতো করে বিদেশে পাঠাতে গেলে ব্যাপক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন মার্কিন দেশে হবে। কোনো প্রেসিডেন্ট সেটা করে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার আশা করবেন না।
সুতরাং সৌদি তেল আর মার্কিন ডলার দুজনে দুজনের। সহমরণ ছাড়া তাদের বিচ্ছেদ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমেরিকার প্রাণভোমরার হুমকি ইরান
এই যে মূল নকশা, এটা বদলাতে চেয়েছিলেন সাদ্দাম হোসেন এবং মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তাঁরা নিজেদের বিরাট তেল মজুতের স্বাধীন ব্যবহার করতে গিয়েই থামেননি, ডলারের জায়গায় আবার সোনাকে ফিরিয়ে আনতে গেছেন। তার শাস্তি তাঁরা পেয়েছেন। কিন্তু ইরানকে থামানো যায়নি। ইরান-সিরিয়া-ইরাক জোট শুধু বিপুল পরিমাণ তেলের মজুতই নিয়ন্ত্রণ করছে না, তারা চাইছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনিগুলি থেকে আমেরিকাকে সরাতে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সেনাঘাঁটি সরে যাওয়া মানে সৌদি ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর তেলের মজুত এবং তার ফলে ডলারের একচেটিয়া ব্যবসা আমেরিকার হাতছাড়া হওয়া। এমনকি ইরান যদি কোনোভাবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আওতাধীন তেলক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন ধ্বংস অথবা কয়েক মাসের জন্য বন্ধ করতে পার—অভিযোগ মতে যেটা তারা ইয়েমেনি যোদ্ধাদের দিয়ে সৌদি আরবের আরামকো কোম্পানির তেলক্ষেত্রে সম্প্রতি করেছে—তাহলে ডলার-তেলের এই উড়াল মুখ থুবড়ে পড়বে। সেটার ফল আমেরিকার জন্য ভয়াবহ। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাই আর থাকবে না, ইউরোপ তেল-ডলার এবং সামরিক সমর্থনের বিকল্প উপায় খুঁজবে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সামরিক পশ্চাদপসরণ কিংবা তেলবাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো তাই মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রাণভোমরার মৃত্যুর শামিল।
ইরান ৪০ বছর ধরেই আমেরিকার প্রাণভোমরা হত্যাকেই তার রাষ্ট্রীয় নীতির অন্যতম ভিত্তি করে রেখেছে। ৫০-এর দশকে ইরানের মোসাদ্দেক সরকারকে আমেরিকা উচ্ছেদ করেছিল এ জন্যই যে, তিনি ইরানের তেলসম্পদের জাতীয়করণ করে তেল-ডলারের খেলা থেকে তাঁর দেশকে বের করে আনতে চেয়েছিলেন। ঠিক এ কারণেই আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে গণতন্ত্র চায় না, কারণ গণতন্ত্রের মধ্যে এভাবে কোনো দেশকে তার জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল আটকে রাখা যায় না, সম্পদ লুট করা যায় না।
ইরানের এই পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হলো সৌদি রাজতন্ত্রের ধ্বংস। কেননা সৌদি আরবকে তার জায়গায় রেখে আমেরিকার তেল-ডলারের খেলা বন্ধ করা যাবে না। সৌদি অর্থে পরিচালিত সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর জন্ম ও পুনর্জন্মের চক্র বন্ধ করতে হলেও সৌদি তেলের টাকার জোগান থামাতে হবে। ইরানের সঙ্গে কোনো যুদ্ধ হলে তাই প্রথমেই আক্রান্ত হবে ওপেকভুক্ত তেলক্ষেত্রগুলি। তা হলে ডলারের আধিপত্যও হুমকিতে পড়বে। আর তা হলে, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ দ্রুতই ডলার কেনার অর্থনৈতিক চক্র থেকে বেরিয়ে আসবে। সেটাই হবে মার্কিন শতকের সমাপ্তি। আমেরিকা কোনোভাবেই এটা হতে দেবে না। আর ইরানের এই পরিকল্পনায় চীন ও রাশিয়াকে তার মিত্র করে তুলছে। এই বিপজ্জনক পরিকল্পনার রূপকার হিসেব সুলেইমানি তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আমেরিকার নেমেসিস।
ইরানি রাষ্ট্রের ওপর ভরসা রাখা যায়, এই বিশ্বাস যদি সোলাইমানি প্রতিষ্ঠা করতে না পারতেন, তাহলে ইরাক বা সিরিয়ার ওপর কর্তৃত্ব করতে পারত না ইরান। আর ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেন-লেবাননকে হাতে রাখার কারণেই চীন-রাশিয়া-তুরস্কও ইরানকে গুনতে বাধ্য হয়েছে। ইরানের টিকে থাকা ও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে চীন-রাশিয়া-তুরস্কের মতো উচ্চাভিলাষী রাষ্ট্রগুলোর কোনো কারণ ছিল না ইরানের পাশে থাকার। এই সবকিছুর অন্যতম প্রধান কারিগর কাশেম সুলেইমানি। ঠিক এ কারণেই ইরানের সঙ্গে শান্তি ছাড়া আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান কিংবা সম্মানজনক প্রস্থান কোনোটাই সহজ হবার নয়। সুলেইমানি এটা জানতেন বলেই সৌদি আরবের শান্তির বার্তা এবং ট্রাম্পের সমঝোতার আশ্বাসকে বিশ্বাস করে প্রকাশ্যে ইরাক সফরে গিয়েছিলেন। বিস্তারিত দেখুন এই লেখকের ‘সোলাইমানিকে হারিয়েও ইরানই এগিয়ে’ কিন্তু মৃত্যুতেও তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার বদলে আরও এগিয়েই গেছে। ট্রাম্পীয় খামখেয়াল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অবস্থানকে যতটা নাজুক করেছে, ইরাক থেকে বিদায়ের যে ক্ষেত্র তারা তৈরি করেছে, তা ইরানের নীলনকশাকেই বাস্তবায়িত করছে। এই লড়াই দীর্ঘ ও কঠিন। আপাতত, অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি ইরানের পক্ষে।
পারস্য সাগরের বোতল-ফাঁদ
কিন্তু প্রচলিত সর্বাত্মক যুদ্ধের পথে এর মীমাংসা হবে বলে মনে হয় না। কোনো রকমের আক্রমণ হলেই ইরান বিশ্বের তেলবাণিজ্যের অন্যতম প্রধান পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। পারস্য সাগর হলো একটা বোতলের মতো। এই বোতলের চিকন গলাটাই হলো ইরানের হরমুজ প্রণালি। ভূমি-থেকে-সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত সাধারণ মিসাইলই এই বোতলগলা সমুদ্রপথ বন্ধ রাখার জন্য যথেষ্ট। উপসাগরে আমেরিকার বিরাট বিমানবাহী জাহাজ এখানে ঢোকা মানে বোতলের মধ্যে জাহাজ ঢুকিয়ে বানানো অ্যান্টিক উপহারসামগ্রীর মতো হবে ব্যাপারটা। আমেরিকার শক্তিমান যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে এই প্রণালি খোলা রাখা সম্ভব হবে না। সেজন্য দরকার হবে কয়েক মাসের স্থলযুদ্ধের ঝুঁকি। সেই দীর্ঘ এবং ইরাকের চাইতে রক্তাক্ত যুদ্ধ করার মতো লোকবল এবং আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থান আমেরিকার এখন নেই, তার মিত্ররাও সেটা চাইবে না। কেননা সেই যুদ্ধ দুনিয়ার অর্থনীতিকে এমন তলানিতে নামাবে যে, কোটি মানুষ বেকার হবে, সেই বেকারদের বিক্ষোভ সামলানো আরেকটা ঝুঁকির কাজ হবে।
ট্রাম্প পাগল কিন্তু খ্যাপাটে নন, নেতানিয়াহু খ্যাপাটে কিন্তু পাগল নন
সুতরাং যুদ্ধের ঝুঁকি মানেই তেলের দাম আকাশে ওঠা। তা হলে আমেরিকার ব্যালেন্স অব পেমেন্টে যেমন সমস্যা হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির ফটকা ব্যবসাও ধরা খাবে। বলা হয় সেই ব্যবসা পৃথিবীর তাবৎ জিডিপির অন্তত ২৮ গুণ বড়। মুখে যা-ই বলুক ইসরায়েলও এই যুদ্ধ চাইবে না। কোনো কারণে আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে যাবতীয় দোষ আসবে ইসরায়েলের ওপর। দেশটির পশ্চিমা মিত্ররাও তাদেরই দুষবে। ইতিমধ্যে ইসরায়েলিরা এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে বলে জনমত জরিপে দেখা গেছে, অনবরত ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে মুখিয়ে থাকা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর মন্ত্রীদের মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে বলেছেন। ইরানের সামরিক ও গোয়েন্দা প্রধানও যুদ্ধের বিরুদ্ধে। এর অন্য একটি কারণ এই যে, আগে ইসরায়েল ইরানকে ঘিরে সামরিক পরিকল্পনা করত এখন ইরান ইরাক-সিরিয়া-লেবাননের মাধ্যমে ইসরায়েলের তিন সীমান্তেই তীব্র গেরিলা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষমাণ।
সুতরাং কোনো দিক থেকেই সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনা কম। ট্রাম্প পাগল কিন্তু খ্যাপাটে নন, নেতানিয়াহু খ্যাপাটে কিন্তু পাগল নন। আর ব্রিটেনর প্রধানমন্ত্রী বরিস তো বলেই দিয়েছেন, আমেরিকা যুদ্ধে গেলে যাক, তারা যাবে না। ইতিমধ্যে ইরান ইরাকের দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে কিছু রকেট নিক্ষেপ করেছে বটে, কিন্তু কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জানিয়েছে আপাতত হামলা শেষ। ট্রাম্পও জানিয়েছেন, ‘সব ঠিক আছে, ‘অল ইজ ওয়েল’’।
ইরান লম্বা-চওড়া হুমকি দিয়ে গেলেও কাজের বেলায় অনুসরণ করবে জেনারেল কাশেম সুলেইমানির আন্তঃরাষ্ট্রীয় ভূরাজনৈতিক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা। সম্ভবত, সুলেইমানি যে মাটিতে নিহত হয়েছেন, সেই ইরাকের চোরাবালিতে ইরাককে দিয়েই আমেরিকাকে আটকাতে চাইবে ইরান। ইরাকের সরকার, সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, শিয়াপ্রধান জনগোষ্ঠীই এখানে ইরানের হয়ে কাজ করবে। আর ইরাক থেকে যদি সরে আসতে হয়, তাহলে সিরিয়াতে কয়েক হাজার মার্কিন সেনার কী কাজ? এভাবে পর্যায়ক্রমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য করার দীর্ঘ, কৌশলী খেলার জন্যই বলা হয় আমেরিকা যদি চেকার খেলে তো ইরান দিচ্ছে দাবার চাল।
বাকিটা লিখবে ইতিহাস।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]