সর্বাত্মক যুদ্ধের পথে ইরান
ইরানি কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সারসংক্ষেপ তাঁর ৩ ডিসেম্বরে দেওয়া বিবৃতির মধ্যে ছিল। সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পরদিন ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ বন্ধ করতে গত রাতে হামলা চালিয়েছি। যুদ্ধ শুরু করার জন্য হামলা চালাইনি। …আমরা সরকার পরিবর্তন চাই না।’
ট্রাম্পের বক্তব্য দেওয়ার আগেই তেহরান থেকে পাওয়া প্রতিবেদনগুলো এই ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র সুইস মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একই ধরনের বার্তাই পাঠিয়েছিল।
ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন: ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বের সেরা সামরিক বাহিনী রয়েছে।...আমাদের কাছে বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা বাহিনী রয়েছে। যদি আমেরিকানদের কোথাও হুমকি দেওয়া হয়, সে জন্য আমাদের টার্গেট ইতিমধ্যে সম্পূর্ণরূপে চিহ্নিত হয়ে গেছে এবং যা যা পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা গ্রহণের জন্য আমি প্রস্তুত এবং প্রস্তুত।’
ট্রাম্প বক্তব্য দেওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠী পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেসের গাড়িবহরের ওপর দ্বিতীয় দফা হামলা চালায়।
এদিকে পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৮২তম এয়ারবর্ন ডিভিশনের গ্লোবাল রেসপনস ফোর্সের ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ সেনা কুয়েতে যাবে। আরও প্রায় ১৪ হাজার সেনা এ বছর মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে মোতায়েন করা হয়েছে। এই অঞ্চলে আগে থেকেই প্রায় ৬০ হাজার মার্কিন সেনা ছিল। মোতায়েন করা সেনার সংখ্যা এখন ৭০ হাজার ছুঁয়েছে, তবে এই সংখ্যা ইরানে আগ্রাসন চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির তুলনায় এখনো অনেক কম।
মোট কথা, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তবে তারা ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলতে রাজি নয়, কারণ, তা ইরান হয়তো পছন্দ করবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এ-জাতীয় খেলা ইরানে প্রতিরোধের রাজনীতির ধরনের কারণে কেবল তেহরানের পক্ষেই কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় দেখানোর জন্য ইরান সম্প্রতি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া চালালেও বাস্তবে সেখানে ইরানের লাভ কম ছিল। তবে এসব মহড়া মস্কো এবং বেইজিংকে ওয়াশিংটনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশে সাহায্য করেছে।
যদিও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি খুব দ্রুততার সঙ্গে কাশেম সোলাইমানির স্থলে একজনকে নিয়োগ করেছেন, তবে এটা ঠিক যে তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভূত হবে। একজন সামরিক নেতা ছাড়াও তিনি ব্যতিক্রমভাবে রাজনৈতিক নেটওয়ার্কিংয়ে একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। অসাধারণ ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব তাঁকে অন্যদের থেকে সব সময় আলাদা করে রেখেছিল।
এ ধরনের ব্যক্তির জন্ম খুবই বিরল ঘটনা। তেহরান তাঁর অনুপস্থিতি পলে পলে অনুভব করবে। তাঁর মৃত্যুর ফলে বিশেষত, বাগদাদে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেহরানের প্রভাবিত করার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে হ্রাস পেয়েছে। এটি এখন বলার অপেক্ষা রাখে না যে তেহরান এ হত্যাকাণ্ডের ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবে।
বিগত চার দশকের ইতিহাস বলে যে যুদ্ধের ব্যাপারে ইরানের খুব একটা আগ্রহ নেই। দেশটি মোটামুটি যুদ্ধবিরোধী বলে পরিচিত। তবে এখন পরিস্থিতি যে আর আগের মতো নেই, তা বলাই বাহুল্য।
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশন গার্ডস কোরের ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল আলী ফাদাভি বলেছেন, ‘আমেরিকানদের উচিত হবে একটি গুরুতর প্রতিশোধের জন্য অপেক্ষা করা; প্রতিশোধ কেবল ইরানই নেবে না…। বিরাট ভৌগোলিক অঞ্চলজুড়ে থাকা দুর্দান্ত প্রতিরোধ ফ্রন্ট প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং তা নিশ্চিত ঘটবে।’
আলী ফাদাভি বলেন, ‘উপযুক্ত সময়ে এবং সর্বোত্তম পদ্ধতিতে এই প্রতিশোধ নেওয়া হবে এবং শিগগিরই আমরা দেখতে পাব যে আমেরিকানরা এই অঞ্চলে আর নেই।’
ওপরের মন্তব্যগুলোতে বোঝা যায় যে সোলাইমানি হত্যার বিষয়ে ইরানের প্রতিক্রিয়া হবে নিশ্চিতভাবে ভয়াবহ এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা চালানো, যাতে করে তারা বেশি সংখ্যায় হতাহত হয়। এতে করে যা হতে পারে তা হলো ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
ইরানের পছন্দ হলো একটি অসম যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তেহরান এই অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চেয়ে কম কিছু করতে চাইবে না। একটা সর্বাত্মক যুদ্ধ হতে চলেছে, যেখানে কিনা যুদ্ধের স্বীকৃত সব নিয়মকানুনকে অবজ্ঞা করা হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
এমকে ভদ্রকুমার: ভারতের সাবেক কূটনীতিক