ফেসবুকের ভবিষ্যৎ কি ডিজিটাল কবরস্থান হওয়া?
খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে ফেসবুক। হঠাৎ ফেসবুকের টাইমলাইনে ঘোষণা আসে, ‘অন দিস ডে ইউ হ্যাভ মেমোরি উইথ...।’ হয়তো এই দিনে কারও সঙ্গে ঘুরেছি বা ছবি তুলেছি। হয়তো এই দিনে আমরা ফেসবুকে বন্ধু হয়েছি। হয়তো যার স্মৃতির কথা ফেসবুক বলছে, সে আর কোথাও নাই। আমরা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-টুইটারে অনেক বেশি মানুষকে চিনছি, জানছি। নিয়মিতভাবে এই অনেকের থেকে কেউ কেউ চিরবিদায় নেন। এক তরুণ বন্ধু হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেল। আমরা তার স্মরণসভাও করলাম। অন্য আরেক বন্ধুর মৃত্যুতে শোকবার্তা জানালাম। তারপর হয়তো ভুলেই গিয়েছি; কিন্তু ফেসবুক কিছু ভুলতে দেয় না। মৃত্যুর পরেও তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তো থেকেই যায়। তারা বলে, ‘আমারে দেব না ভুলিতে’। সেসব অ্যাকাউন্টের কোনো লেখা বা ছবিতে হয়তো নতুন করে কেউ লাইক দিল। সেটা ভেসে এল তার বন্ধুদের কাছে। আবার মনে পড়ল, আবার মন খারাপ হলো।
যে চলে গেল হয়তো তার অ্যাকাউন্টটি কেউ বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করেনি ফেসবুককে। সব তেমনই আছে। অনেক ছবি, অনেক কথা, অনেক পোস্ট। না থেকেও এভাবে সে আছে। ফেসবুক হয়ে থাকছে অক্ষয় স্মৃতির জাদুঘর। মানুষ ভোলে, ডিজিটাল মেমোরি ভোলে না কিছুই। ফেসবুকে রয়ে গেছে তার স্থায়ী ডিজিটাল উত্তরাধিকার। অনলাইনে আমরা যা-ই করছি, তারই চিহ্ন থেকে যাচ্ছে, চিহ্নগুলো ডেটা বা তথ্য হয়ে যাচ্ছে। এভাবে আমরা জেনে বা না-জেনে রচনা করে যাচ্ছি আমাদের ডিজিটাল আত্মজীবনী।
মৃত ফেসবুকারদের সম্পর্কে তথ্য মুছতে চায় না ফেসবুক। ফলাফল এই: ৫০ বছরের মধ্যে মৃতেরা ফেসবুকে জীবিতদের চাইতে সংখ্যায় বেশি হয়ে যাবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিটউটে করা এক গবেষণা বলছে, ফেসবুকের সদস্য সংখ্যা যদি নিম্নতম হারে বাড়ে তাহলে ২১০০ সালের মধ্যে প্রায় ১০০ চল্লিশ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী মারা যাবে। আর ফেসবুক যদি বর্তমান হারে বড় হতে থাকে তাহলে সেই সংখ্যা হবে প্রায় ৫০০ কোটি। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ডিজিটাল স্মৃতির তথ্য সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি ও নৈতিকতাকে প্রভাবিত করবে। এই তথ্যের মালিকানা যার, তারা এসব ক্ষেত্রে একচেটিয়া সুবিধাও পাবে বলে আশংকা করেছেন ওই গবেষকেরা। ভবিষ্যতের ইতিহাস ও সমাজ গবেষকদেরও এসব তথ্য দরকার হবে।
এভাবে ফেসবুক করে চলছে আমাদের স্মৃতির ব্যবস্থাপনা। স্মৃতি তো শুধু মনে করা না, স্মৃতি মানে হলো কিছু ভুলে কিছু মনে রাখা। স্মৃতি তাই এক ভুলে যাওয়ার ব্যবস্থাপনাও। সেই ব্যবস্থাপনা এখন চলে গেছে ফেসবুকের হাতে। তাদের বিগ ডেটা অলগরিদম আমাদের স্মৃতি, অনুভূতি, মনে-পড়াকে প্রভাবিত করে চলেছে।
অনলাইন তথা ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির এই বাস্তবতায় মৃত্যুর অর্থও বদলে যাচ্ছে। শারীরিকভাবে মরে গেলেও আপনি বাঁচিয়ে রাখতে পারেন আপনজনের ডিজিটাল অস্তিত্ব। ফেসবুককে অনুরোধ করে, মৃত্যুর সনদনামা দেখিয়ে একটা ফরম পূরণ করে তার অ্যাকাউন্টটি বন্ধও যেমন করতে পারেন, তেমনি চালুও রাখতে পারেন। ওটাকে বানিয়ে ফেলতে পারেন তার স্মৃতির স্মারক, নয়তো যেমন ছিল, তেমনই রাখতে পারেন। শুধু ওই না-থাকা মানুষটির নিজের কোনো সাড়া মাথা কুটলেও আর মিলবে না। কেবল বৈধ উত্তরাধিকারই পারবে ওই অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে। আউটলুক ম্যাগাজিনে দিলীপ বব লিখেছেন, ‘এখন এই ডিজিটাল যুগে, সব সময়ই অতীতও বর্তমান। মরে গেলেও আমরা সবাই জীবিত, যদিও তারা পারবে না আপনার প্রশ্নে সাড়া দিতে ।’ তারপরও হয়তো অনেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবে, তার পোস্টে মৃতকে ট্যাগ করবে। পোক করবে কেউ, কিন্তু যে চলে গেল সে টেরটি পাবে না। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আছে, ‘আমি কবে মরে গেছি, আজও মনে করো?’
কেউ মরে গেলেও তার স্মৃতি জীবন্ত রাখতে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সক্রিয় রাখা যায়। তাকে করা যায় ডিজিটালি অমর। এখান থেকেই একদল গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন, ফেসবুক কি ক্রমেই সামাজিক মাধ্যম থেকে বৃহত্তম গোরস্থানে পরিণত হচ্ছে? ফেসবুক কি সেই পবিত্র নদী, যেখানে অসংখ্য মানুষের দেহভস্ম ভাসিয়ে দেওয়া চলছে? বিগ ডেটা অ্যান্ড সোসাইটি নামের জার্নালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ুক বা কমুক, ২০৬০ সালের আগেই ফেসবুকে কয়েক শ কোটি মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থাকবে। কী বিশাল এক কবরস্থানই তা হয়ে উঠবে, ভাবা যায়?
স্বজন-বন্ধুর কবরে গিয়ে ফুল দেওয়া বা দোয়া করার মতো করে অনেকে সেসব ‘মৃতদের’ ওয়ালে ঘুরে আসবে। মৃতের মৃত্যুকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখছে ফেসবুক। এ থেকে এক চিন্তা এসেছে। মৃত্যুর পর ফেসবুক অ্যাকাউন্টের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সুযোগ আছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মতো কাউকে করা যাবে ব্যক্তির ডিজিটাল স্মৃতির উত্তরাধিকারী। জন্মদিনে-মৃত্যুদিনে অনেকে হয়তো ফেসবুকের সেসব পৃষ্ঠায় বিষণ্ন মনে ঘুরে বেড়াবে, যেখানে যেখানে আমাদের স্মৃতি, কথা, ছবি ধরে রাখা ছিল। হয়তো পুরোনো কোনো কথা বা ছবি থেকে আমার সম্পর্কে নতুন কোনো উপলব্ধি জন্মাবে তার। আমি নিজে যেমন ভাবতাম না নিজেকে, আমার অতীত তার সামনে তেমন কোনো রূপে হাজির হবে হয়তো। কিংবা জেনে যাবে কেউ যা জানেনি, তা-ও। তখন আমার কিছুই করার থাকবে না। হয়তো, এটাই একধরনের ডিজিটাল অমরত্ব।
তখন আর কষ্ট করে দূরের কোনো কবরস্থানে গিয়ে মুছে যাওয়া সমাধিলিপিগুলো থেকে কারও নাম খুঁজে বের করতে হবে না। তা ছাড়া কবরের ওপর যখন কবর উঠছে, তখন কজনারই বা নিজস্ব কবর কিনে রাখার সামর্থ্য থাকবে? বরং ফেসবুকের সমাধিটা হবে একদম নিজস্ব। আমার স্মৃতির উত্তরাধিকারী চাইলে সেটাকে আমার নামেই রেখে দিতে পারবে। সেটাই হয়তো হয়ে উঠবে মৃতকে স্মরণ করার নতুন প্রথা। হয়তো সে সময়ের মানুষ কারও স্মরণে ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে এক তোড়া ডিজিটাল-পুষ্প দিয়ে আসবে। কে জানে?
বিষয়টার জটিল দিক নিয়েও কথা বলা দরকার। মানুষের জীবন, মৃত্যু, সমাজ নিয়ে যে বিপুল তথ্যের অধিকারী হয়ে উঠছে ফেসবুক, সেগুলোর কি নিরপেক্ষ মানবতাবাদী ব্যবহার তারা নিশ্চিত করবে? নাকি ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে আমাদের জীবনচিত্রকে পুঁজি করে ব্যবসা চালাবে। কথায় বলে, অতীত যারা নিয়ন্ত্রণ করে ভবিষ্যতের দখলও তাদের হাতেই থাকবে। এভাবে কোটি কোটি মানুষের যাবতীয় তথ্য ব্যক্তিমালিকানার কোনো কোম্পানির জিম্মায় রাখা আসলে কতটা নিরাপদ?
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বেলজিয়ামে অবস্থিত ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস একটা রায় দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষিত ইউরোপীয় নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য খারাপ উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হতে পারে। এই যুগান্তকারী রায় ফেসবুক, গুগল, আমাজনসহ অনেক প্রাযুক্তিক কোম্পানিকে জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
দুদিনের এই দুনিয়ায় একদিন আমরা যার যার জায়গায় মরে যাব। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মেনলো পার্ক নামের জায়গায় ফেসবুকের কোনো সার্ভারে আমি বেঁচে থাকব ডিজিটাল তথ্যপুঞ্জের ভেতর। এই তথ্য আমাকে বিষণ্ন না সুখী করে? জানি না। এক অর্থে ফেসবুক ক্রমেই কবরস্থান হয়ে উঠছে। ফেসবুক চালু হয়েছে এক যুগের বেশি হলো। এর প্রথম ১২ বছরে ৫ কোটি ফেসবুকার মারা গেছেন। প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন প্রায় ৮ হাজার জন। সুতরাং, কোনো একদিন অবশ্যই আসবে যখন জীবিতদের চেয়ে মৃত ফেসবুকারের সংখ্যা বেশি হবে। ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমির পেছনে এশিয়ার বৃহত্তম কবরস্থান নির্মিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল এক বিলবোর্ড। ফেসবুক তাদেরও ছাপিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তা হয়ে উঠেছে দুনিয়ার বৃহত্তম ডিজিটাল কবরস্থান।
ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবসায়ী কোম্পানি ও রাষ্ট্রকে সরবরাহ করে যাচ্ছে ফেসবুক। এতে করে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হলো না? জীবিতর মতো মৃত ব্যক্তির তথ্যেরও দাম আছে। একেকজনের আস্ত জীবনের সব তথ্য, ছবি, কথা, আবেগ কত দামে বিক্রি হবে? কিংবা কোনো রাজনৈতিক চক্রান্তে সেসবের ব্যবহার হবে, আমরা জানি না। শুধু এটুকু জানি, এই বিশ্বে জীবনে যেমন মরণের পরও মানুষ বড়ই অনিরাপদ।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]