শিক্ষক সমিতি, নির্বাচন আর দলীয় আনুগত্য
>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ২০২০ সালের কার্যকরী পরিষদ নির্বাচন আজ সোমবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৷ এই প্রেক্ষাপটে লিখেছেন গীতি আরা নাসরীন, কামরুল হাসান মামুন, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, কাজী মারুফুল ইসলাম, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, সামিনা লুৎফা, ফাহমিদুল হক, মোশাহিদা সুলতানা, সাজ্জাদ এইচ সিদ্দিকী, সায়মা আহমেদ, তাহমিনা খানম, কামাল চৌধুরী, আশীক মোহাম্মদ শিমুল ও মো. আব্দুল মান্নান।
শিক্ষকদের পেশাগত অধিকার, আত্মমর্যাদা রক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মান উন্নয়নে সরকার ও নিজস্ব প্রশাসনের সঙ্গে ‘দর–কষাকষির পর্ষদ’ হিসেবে শিক্ষক সমিতির অপরিহার্যতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এসব লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই কাজ করে যাচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির সফলতা ও ব্যর্থতা দুই-ই কমবেশি আছে। সফলতার জন্য শিক্ষক সমিতিকে সাধুবাদ কখনো কখনো দেওয়া গেলেও মোটা দাগে এমন কিছু বিপরীত প্রবণতা গত দুই দশকে খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা নিশ্চিত করছে, এ সংগঠন সরকার ও নিজস্ব প্রশাসনের সঙ্গে দর–কষাকষির চেয়ে তাদের সহমত-পক্ষে পরিণত হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষে এক বছর পরপর ডিসেম্বর মাসে দুরঙা প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে দেখা গেলেও নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির নেতাদের যোগাযোগ আর হয় না বললেই চলে। এমনকি ইউজিসি উচ্চশিক্ষা নিয়ে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করে তা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেললেও শিক্ষক সমিতি নীরব থেকে যায়—যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষকেরা নিজেরাই সংগঠিত না হন! তাহলে শিক্ষক সমিতি কেন? শুধুই কি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য? দল, সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহমত-পক্ষ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার জন্য? নির্বাচনী প্রচারণায় ঢাবির নীল দল তাদের বেশ কিছু অর্জন (যেমন বঙ্গবন্ধু ওভারসিজ স্কলারশিপ চালু) এবং বেশ কিছু প্রতিশ্রুতির কথা (সরল সুদে গৃহঋণ) উল্লেখ করে থাকে। এগুলোর মধ্যে শিক্ষক সমিতির অর্জন কোনটি আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অর্জন কোনটি, তা পৃথক করা মুশকিল। আর এখানেই রয়েছে সংকটের মূল, যার মধ্য দিয়ে স্বার্থের সংঘাতের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
স্বার্থের সংঘাত বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তার উদাহরণ হিসেবে এবারের ঢাবির শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের প্যানেল দুটির দিকে তাকানোই যথেষ্ট। নীল দল থেকে এবার যাঁরা শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন পদে নির্বাচন করতে চাইছেন, তাঁদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো প্রশাসনিক পদে রয়েছেন। ১৫ জন প্রার্থীর মধ্যে কেবল একজন কোনো প্রশাসনিক পদে নেই। বাকি ১৪ জনের মধ্যে ৪ জন ডিন, ৫ জন প্রাধ্যক্ষ, ২ জন সিন্ডিকেট সদস্য, ৬ জন সিনেট সদস্য ও ১ জন টিএসসির উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। সাদা দলের ১৫ জন প্রার্থীর মধ্যে একজন ডিন এবং একজন প্রাধ্যক্ষ। এতে স্পষ্ট, যাঁরা শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে আসতে চান, তাঁদের বেশির ভাগ প্রশাসনিক পদে আসীন।
প্রশাসনিক পদের শক্তির মাধ্যমেই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ভোট পাওয়ার সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমন, প্রাধ্যক্ষ পদ থেকে শিক্ষক সমিতি বা অন্য কোনো নির্বাচন করলে অন্তত সব হাউস টিউটরের ভোটপ্রাপ্তিটা নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া শিক্ষক সমিতির নেতৃত্ব অল্প কিছু ব্যক্তির ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে, নতুন নেতৃত্ব বিকশিত হচ্ছে না। প্রতিনিধিত্ব বিবেচনা করলেও দেখা যায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ৩০ জন প্রার্থীর কেবল দুজন ছাড়া সবাই অধ্যাপক। অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের বাইরে প্রতিনিধিত্ব নেই। আবার শিক্ষকদের মধ্যে নারী শিক্ষকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলেও নির্বাচনে নারী পদপ্রার্থীদের সংখ্যা ৩০ জনের মধ্যে মাত্র ৪।
সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ শিক্ষকেরা কোনো দাবিদাওয়া নিয়ে গেলে, সমিতি নেতারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদাধিকারের জায়গা থেকে সেসব দাবিকে বিবেচনা করেন। কোনো শিক্ষক অন্য কোনো শিক্ষককে হত্যার হুমকি–সংক্রান্ত অভিযোগ জানালেও শিক্ষক সমিতি হুমকিদানকারীর দলীয় পরিচয়ের বিবেচনায় নীরব থাকে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একপর্যায়ে শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে প্রহার করেন এবং পাশাপাশি কয়েকজন শিক্ষককেও তাঁরা লাঞ্ছিত করেন। লাঞ্ছিত শিক্ষকেরা শিক্ষক সমিতির কাছে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চিঠি দেন। কিন্তু সমিতির দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি, নেতারা শিক্ষকদের কোনো খোঁজখবর নেননি। এ ছাড়া অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, মনোবিজ্ঞানের নাসরীন ওয়াদুদ বা আইবিএর শিক্ষক খালিদ মাহমুদের বিরুদ্ধে ঘটা অন্যায়ের ব্যাপারে শিক্ষক সমিতির নির্লিপ্ত নীরবতাই বলে দেয় শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের প্রেশার গ্রুপ নয় বরং ক্ষমতাবলয়ের অংশে পরিণত হয়েছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে এ রকম দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্যের বাইরে দেখতে চাই। আশা করি, শিক্ষক সমিতি স্বাধীনভাবে সাধারণ শিক্ষকদের স্বার্থে কাজ করবে। শিক্ষার্থীদের সংকটেও তাঁদের পাশে দাঁড়াবে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দাবি, বিবেচনা ও নিবেদন:
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে যাঁরা যুক্ত আছেন (প্রাধ্যক্ষ, ডিন, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, উপদেষ্টা) নির্বাচনে জয়ী হলে প্রশাসনিক পদ থেকে তাঁরা পদত্যাগ করবেন এবং শিক্ষক সমিতির নতুন নেতৃত্ব বিভিন্ন প্রশাসনিক পদের কাউকে ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করবেন।
২. নারী শিক্ষকদের সংখ্যা বিবেচনায় আনুপাতিক হারে তাঁদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পদের সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সমিতির সদস্যরা সারা বছর ধরে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন এবং তাঁদের গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে দরকার মতো বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে দর–কষাকষি করবেন। অপারগ হলে পদত্যাগ করবেন।
৫. শিক্ষক সমিতির বড় পদে (সভাপতি, সহসভাপতি, কোষাধ্যক্ষ, সাধারণ সম্পাদক) একই ব্যক্তি যেন দুবারের বেশি নির্বাচিত না হতে পারেন, সে বিষয়ে নীতিমালা গড়ে তুলতে হবে।
৬. শিক্ষার্থীদের বড় ইস্যুগুলো শিক্ষক সমিতি এড়াতে পারে না। শিক্ষার পরিবেশ, ছাত্রাবাসে বসবাসের পরিবেশ এবং বিশেষত তাঁদের ওপরে প্রায়ই যে নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, তা নিয়েও সমিতিকে কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির নির্লিপ্ততাও ডাকসু ভবনে ভিপি ও অন্যান্যের ওপর সাম্প্রতিক আক্রমণ ও হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা ঘটার সুযোগ পরোক্ষভাবে তৈরি করছে।
লেখকেরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে লেখাটি লিখেছেন।