তরুণদের কতটা বুঝতে পারছি আমরা
আমরা ছিলাম এ রকম আর ওরা অন্য রকম। প্রসঙ্গ এলে বলাবলি এমনটাই হয়ে থাকে। নতুন কালের মানুষেরা
আমাদের মতো হয়নি দেখে প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। দুঃখ বাড়ে। হতাশা বাড়ে।
সময় বদলের সঙ্গে মানুষেরও বদল ঘটবে—খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সেই বদলে আমরা কতটুকু সন্তুষ্ট হতে পারি বা মোটেও যদি না পারি, সে দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যায় না।
সেই আর এই সময়ের তুলনা করে কী লাভ? কী চমৎকার কেটেছে আমাদের—এই আত্মসুখ প্রকাশ করে তৃপ্ত হই বটে। কিন্তু এখন যাদের তরুণকাল, তারা আমাদের মতো জীবন পায়নি বলে তো হা-হুতাশ করে বলে মনে হয় না। অস্বীকার করা যাবে না, বহু তরুণের জ্ঞানবুদ্ধি, বিবেচনা, দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অবাক করে—বিস্মিত, আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত করে।
আনন্দ মিললে ভাগে খানিকটা মন্দও জুটবে—নিয়ম। ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকার সবই একটির সঙ্গে অন্যটি ফ্রিতে মেলে। সেই নিয়মে এ সময়ে অজস্র ভালোর দেখা মিললে আনন্দ-উৎসাহ অনুপ্রেরণা জাগে। অসংখ্য মন্দ উদাহরণও নিত্য তেড়ে আসে। আসে অস্বস্তি, হতাশা আর বেদনা ছড়াতে।
বেদনা, হতাশা, অস্বস্তির বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়াও বেশি হয়। কেন এই বেশি? কেন যা সুখকর নয়, তা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চর্চা অনুশীলনে উৎসাহ?
এবার একটু পেছনে তাকানো যাক। আমাদের কৈশোর-যৌবনকাল ছিল ব্যাপক অভিভাবকত্বে সুরক্ষিত। বাড়ির বাইরে বের হতে পারলে মুক্তি-স্বাধীনতার অনুভব ছিল। ছিল জোয়ার-ভাটার নদী, অসীম আকাশ, প্রাণখোলা মাঠ, হাসিমাখা ফসলের খেত, লাফানো ঝাঁপানোর টলটলে পুকুর। অজস্র রকম আনন্দের উপকরণে জীবন ঝলমলে ছিল। তবে উপভোগের সময় সতর্ক থাকতে হতো। মাথায় রাখতে হতো কখন কী অন্যায় হয়ে যায়, কে কখন দেখে ফেলে।
দুর্দান্ত যারা, তাদেরও অনেক বিষয়ে সামলে চলতে হতো। শিক্ষক, পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, অন্যের অভিভাবকদের বিষয়েও সতর্কতা বজায় রাখতে হতো। সে সতর্কতায় ভয় নয়, ছিল সমীহ। পাড়ার বয়সে বড়রাও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক। ক্লাব, লাইব্রেরি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা—সেই বয়সে এসবের নিয়ন্ত্রণও ছিল।
পরিবারের বাইরে যাঁদের অভিভাবকত্বের কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের বয়সের কারণে মানতে হতো, তা নয়। যোগ্যতাতে তাঁরা ছিলেন সমীহের উপযুক্ত। তখন মানে না বুঝলেও পারস্পরিক সম্মানবোধ কী, তা অজ্ঞাত ছিল না।
গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার পর যৌবন থেকে সেই অভিভাবকত্ব সরে যায়নি। গৌরবময় রাজনীতি ও সংস্কৃতি একসঙ্গে নব অধ্যায়ের সূচনা করে দিয়েছিল। নাটক, সিনেমা, সংগীত, সাহিত্য, ক্রীড়া—আত্মার খোরাকের অভাব ছিল না। শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী অসংখ্য পরিচয়ের মর্যাদা জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করেছে।
টেলিভিশন, দৈনিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল। এখন রয়েছে অনুযোগ, অভিযোগ আর হতাশা প্রকাশ। বলা হয়ে থাকে, দেখা, শোনা ও পড়ার আগ্রহ কমেছে। পাশাপাশি নতুন নানান মাধ্যমের আবির্ভাব ঘটেছে। সেসবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুল পরিমাণ মানুষ দিনরাত হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকছে। আগ্রহ ও আকর্ষণের বিষয় বদলেছে। গায়ের জোরে বলা যাবে না, এই যে হুলুস্থুল ঘাড় গুঁজে থাকা, তা কেবলই মন্দের টানে।
সময় গড়াচ্ছে। জগৎ–সংসারের খুঁটিনাটি আঙুলডগার ইচ্ছায় নিমেষেই চোখের সামনে হাজির হয়ে যায়। এমন সুযোগ কোনো মানুষ হেলায় হারাতে চায়! মানুষ নতুন বা পুরোনো যা-ই হোক, আকাঙ্ক্ষা-আগ্রহ বা কৌতূহল সর্বদা নতুনের প্রতিই। আমরা দেখতে পাই উৎপাদক ও বিজ্ঞাপন মাধ্যমের অবিরাম চেষ্টা থাকে নিত্যনতুনকে যুক্ত করা। হোক দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় পণ্য, নতুনভাবে উপস্থাপনার চেষ্টা থেমে থাকে না। চেষ্টা মানে সৃজনশীলতা। সৃজনশীলতার মধ্যে থাকে সেই শক্তি, যা উপলব্ধি করতে পারা মানুষকে আনন্দ দান করে, মনে বিস্ময় জাগায়, টিকিয়ে রাখে ভালোবাসা। সমীহ প্রকাশের ইচ্ছাও জাগিয়ে দেয়।
নতুনদের নিয়ে বহুজনের অনেক রকমের আক্ষেপ রয়েছে। জগতে তাদের আগে যাদের আগমন, সেই অভিজ্ঞদের অভিজ্ঞতা আকর্ষণহীন হলে নিশ্চয়ই আগ্রহ নিয়ে তারা তা প্রত্যক্ষ করে থাকে। সে আগ্রহ তাদের জন্য যথেষ্ট অনুপ্রেরণাদায়ক কি না!
আমাদের চর্চা, অনুশীলনের অধিকাংশ বিষয় সব সময় মন ভালো করা নয়। বিষয় অস্বস্তিকর কিন্তু পাঠক, দর্শক টানার উপাদান রয়েছে ভেবে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশনা। অন্যদিকে যা সমাজ-সংস্কৃতি, দেশ ও মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য এবং বিশেষ বৃহৎ গোষ্ঠীর কাছে তা আবেদনহীন মনে হলে সামনের হয়ে উঠতে পারে না। গুরুত্ব হারায়।
ক্রমাগত স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে তা একসময় স্বার্থপরতা হয়ে দাঁড়ায়। সাপ মরবে, লাঠি ভাঙবে না—এমন সুচতুর বুদ্ধির খেলায় লাভ হচ্ছে না। মানুষে মানুষে দূরত্ব, অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে। নতুন প্রজন্মকে তো ভরসাস্থল পেতে হবে। না পেলে তাদের আশা-ভরসাকে তো কাগজের নৌকা বানিয়ে তারা অনির্দিষ্ট পথে ভাসিয়ে দেবে না।
একসময় সংস্কৃতির জোরই দেশ ও মানুষের জোর ছিল। নগদ প্রাপ্তির কালে বাকির খাতায় চলে যায় সংস্কৃতি পালন। এখন জোর বলতে বোঝায় অন্য কিছু। সেই জোরের চর্চা পরিচর্যায় উচ্ছন্নে যাওয়াকে উন্নতি বলে। তেমন উন্নতি লাভের জন্য হুলুস্থুল কাণ্ডে সমগ্র ক্ষেত্রে অভিভাবকত্ব দিশেহারা। নতুন ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যে চারপাশ ভুলে আপন আপন ভুবনে নেশাগ্রস্তের মতো ডুবে আছে, তাকে অস্বাভাবিকতা ভাবা যায়। ভাবা হচ্ছে। সেই স্বভাব দোষের হলে নিজেরা যে একেবারেই যে দোষহীন, তার পক্ষে জোরদার যুক্তি কি অভিভাবক শ্রেণির মুঠোতে রয়েছে?
সবাই আমি বা আমরাতে আটকা পড়ে রয়েছি। কুড়ি-ত্রিশ বছরে যারা নতুন প্রজন্ম পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে, উঠছে, তারা কেউই আমি বা আমাদের মতো নয়। তারা আমাদের মতো হবে, এমন আশা কেন করা? তাদের ভাব, ভাষা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ধ্যানধারণা বুঝতে চাওয়ার, নিকটের হওয়ার কতখানি উদ্যোগ চোখে পড়ে?
অস্বস্তি বা হতাশায় ভোগার চেয়ে নতুনকে বুঝতে চাওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা শুরু হোক। হয়তো অস্বস্তি হতাশার উৎপাদনে ভাটা পড়তে পারে।
প্রক্রিয়া খানিকটা ব্যাহত হতে পারে।
আফজাল হোসেন অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক ও নির্দেশক
[email protected]