সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রিত্ব একসঙ্গে যায় না
>আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন শুরু হচ্ছে আজ। এ বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ-এর সঙ্গে কথা বলি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন সফররত অধ্যাপক হারুনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় টেলিফোনে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের কাউন্সিল নিয়ে কী ভাবছেন?
হারুন-অর-রশিদ: শত্রু–মিত্রনির্বিশেষে এ কথা সবাই স্বীকার করে যে আওয়ামী লীগের শাসনামলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট উন্নতি হয়েছে। এই কাউন্সিল সামনে রেখে মনে রাখতে হবে যে এই দলের সঙ্গেই জাতির রাষ্ট্রের সৃষ্টির ইতিহাস। সুতরাং দলটিকে মুখ্যত এই আঙ্গিকেই বিবেচনা করতে হবে। বিএনপি একসময় দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল, কিন্তু সেই দলের আজকের কী অবস্থা, সেটা কমবেশি আমরা সবাই জানি। অনেক দল হারিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ৭০ বছর ধরে বলিষ্ঠভাবে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। কারণ, দলটির নেতৃত্ব সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। দলটির একটা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে। বিশাল নিজস্ব ভবনে আওয়ামী লীগ আজ তথ্যপ্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা চালু করেছে। এটি গতানুগতিক রাজনৈতিক দল নয়। এটি গতিশীল, ক্রিয়াশীল ও ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
প্রথম আলো: সাধারণত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে একটি পদের দিকে সবার মনোযোগ থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। আপনি কি মনে করেন যে ওবায়দুল কাদেরই থাকছেন, নাকি নতুন মুখ আসবে।
হারুন-অর-রশিদ: প্রথমত আমি বলব, কাউন্সিলরদের চিন্তাভাবনা এবং দলের স্বার্থে যাঁকে উপযুক্ত তাঁকেই বেছে নিতে তারা সক্ষম হবে। তবে মিস্টার এক্স না মিস্টার ওয়াই আসবেন, সেটা আমি বলতে পারব না। তবে আমি বলব, যিনিই হোন না কেন, তিনি অবশ্যই দলের আদর্শ, লক্ষ্য ও দর্শন, সেটা এগিয়ে নেবেন।
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনে দেখিয়েছেন যে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে থেকে মন্ত্রিত্ব না নেওয়া। এটা তো মনে হয়, আজকের বাংলাদেশে সম্ভব নয়।
হারুন-অর-রশিদ: সম্ভব নয়, সে কথা আমি মনে করি না। আপনি যেমনটা ইঙ্গিত করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ছাপ্পান্ন-সাতান্ন সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায় ৯ মাসের জন্য মন্ত্রী হয়েছিলেন। ওই মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন, বাঙালি জাতির মুক্তি চাইলে মন্ত্রিত্ব করে তা পারা যাবে না। বরং সংগঠনকে সুসংহত করতে হবে। তৃণমূলে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগকে বাঙালি জাতির মুক্তিমঞ্চে পরিণত করতে হবে। আবার স্বাধীনতার পরে তাঁকে যখন আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হলো, তখন তিনি বারবার বলেছিলেন, এটা গণতন্ত্রসম্মত নয়। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করা হয়েছিল, এককালীন ব্যতিক্রম হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য। সব সময়ের জন্য নয়। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তখন তা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে যখন দলের কাউন্সিল হলো, তখনো তাঁকে এই পদে থেকে যাওয়ার জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা অগ্রাহ্য করেন। জিল্লুর রহমানকে দলের সাধারণ সম্পাদক ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান সভাপতি হয়েছিলেন। আমিও মনে করি, যিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকবেন, তাঁর মন্ত্রীর পদ গ্রহণ না করাই ভালো। কারণ, তাতে দল বা মন্ত্রণালয়—কোনোটার প্রতিই পুরোপুরি সুবিচার করা যায় না। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এ ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেটি আবার ফিরিয়ে আনার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। তবে দলের যাঁরা কাউন্সিলর রয়েছেন, তাঁরাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
প্রথম আলো: আপনি নিয়মতান্ত্রিক কাউন্সিল হওয়াকেই দলটির শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু কমিটি গঠনে তা নির্দেশ করে না। যেমন গত কাউন্সিলের পর পৌনে তিন বছরের মাথায় মাত্র একটি জেলা সাংগঠনিক কমিটি করেছে এবং গত দু-এক মাসে ১৫–২০টি পকেট কমিটি হয়েছে।
তাও সভাপতি ও সম্পাদক বাছাই। পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারে না, ব্যালটে নির্বাচন তো দূরের কথা। এটা আপনি কীভাবে দেখবেন।
হারুন-অর-রশিদ: এটা একধরনের সীমাবদ্ধতা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেটা নির্দেশ করে যে দলের সাধারণ সম্পাদক যদি সরকারের নির্বাহী পদে না থেকে শুধু দলের নির্বাহী পদে থাকতেন, তাহলে এক কাউন্সিল থেকে আরেক কাউন্সিলের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি সময় কাজে লাগিয়ে এই ধরনের কমিটিগুলোকে যথাযথভাবে গঠন করতে পারতেন। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, সমাজ পরিবর্তনশীল, সমাজ এক জায়গায় স্থির থাকে না। সাম্প্রতিক কালে আওয়ামী লীগের ভেতরে আরেকটা সমস্যা হলো অনুপ্রবেশকারী। সুতরাং দলকে অনুপ্রবেশকারীমুক্ত রাখা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য একটা প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আলো: কাউন্সিলের নতুন মুখ বাছাইয়ে সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের প্রভাব কতটা আশা করেন?
হারুন-অর-রশিদ: সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এটা লোকদেখানো কোনো অভিযান নয়। যাঁরা অনুপ্রবেশকারী কিংবা যাঁরা দলীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দলের সভানেত্রী রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। আমি বলব, তিনি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। বোস্টনে বসে আমি বঙ্গবন্ধুর অতীতের বক্তব্য পর্যালোচনা করছি। আর তাতে দেখছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানই তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। আর আজ তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একইভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। একসময় যাঁরা বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে দ্বিধান্বিত থাকতেন, তাঁরা আজকে শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করেন। শত্রু-মিত্রনির্বিশেষে সবাই।
প্রথম আলো: বিরোধী দলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির নানা ঘটনা আমরা জানি। বর্তমান নেতৃত্ব বিরোধী দলের প্রতি কেমন মনোভাব দেখাচ্ছে?
হারুন-অর-রশিদ: তারা ইনডেমনিটি বিল পাস করেছে। তারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কাজ দিয়েছে। তারা ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা করেছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সখ্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছে।
প্রথম আলো: এবারের কাউন্সিলে বিএনপি আমন্ত্রিত হবে? বিএনপি যাবে?
হারুন-অর-রশিদ: বিএনপিকেও আওয়ামী লীগ অতীতে আহ্বান জানিয়েছে। আপনি নিজেও জানেন, বিএনপি তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা দেশের মানুষের কাছে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিকভাবেও তারা একটা বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। তারা একসময় দেশের বড় দল ছিল।
প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন আর তারা বড় দল নেই? তারা প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা হারিয়েছে?
হারুন-অর-রশিদ: এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিএনপি যে অবস্থানে ছিল, সেই অবস্থানে আর নেই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানা কারণে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, এখন সেই দূরত্বের কারণগুলো ভুলে শুধু তাত্ত্বিকভাবে এটা ভাবলে হবে না যে তারা একসময় দেশের বড় দল ছিল। বিভিন্ন সময় তারা সরকার গঠন করেছে, তাদের আওয়ামী লীগ তার কাউন্সিলে আমন্ত্রণ জানাবে না কেন—এটা নিয়ে তত্ত্বগত আলোচনা হতে পারে, কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত হবে না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা বলতে পারি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একজন সজ্জন, ভদ্রলোক। তিনি শপথ নিলেন না কিন্তু অন্যরা সংসদে এলেন। যদি তিনি আসতেন, তাহলে তিনি একাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতেন। তদুপরি আমি মনে করি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো যায়। কিন্তু সার্বিকভাবে আন্তদলীয় সম্পর্কের বিষয়টি যদি আপনি বিবেচনায় নেন, তাহলে কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন যে বাধাটা কোথায়।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতার জন্য দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু আপনার কথায় দলটির প্রতি আপনার অনুরাগই বেশি প্রকাশিত। কেউ এ রকম সমালোচনা করলে কী বলবেন।
হারুন-অর-রশিদ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আমি আওয়ামী লীগের আসন্ন কাউন্সিলকে যেভাবে মূল্যায়ন করতে পারি, আমি তো সেভাবেই বলব। এখন যদি কারও পূর্ব চিন্তাপ্রসূত বা নিজস্ব রাজনীতির বিষয় থাকে, তাহলে তাঁর সঙ্গে আমার কথার মিল না–ও হতে পারে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্র নিয়ে এর আগে আমার অনেক সাক্ষাৎকার আপনি নিয়েছেন। তাতে আপনি দেখবেন, আমার বক্তব্য তখন অনেকের কাছে রূঢ় বা একপেশে মনে হতে পারত, কিন্তু কালক্রমে সেসব আমরা বাস্তব হতে দেখেছি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট বিএনপির জন্য আত্মঘাতী হবে, সেটা আমি আপনাকে বলেছিলাম। তাই বাস্তবতার দিকে না তাকিয়ে, যদি আমরা প্রথাগতভাবে সরকারি ও বিরোধী দলের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে সেটা হবে একটা থিওরিটিক্যাল ডিসকোর্স। ব্যালটের মাধ্যমে সাংগঠনিক কমিটি গঠন হলেই গণতান্ত্রিক হবে। আর আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে করলে গণতান্ত্রিক হবে না, সেটা আমি মনে করি না।
প্রথম আলো: গোপন ব্যালটে কমিটি হবে, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেই তা লেখা আছে। এখন সেটা হচ্ছে না। সেটা তো অনেক দূরের কথা, আমরা দেখছি পূর্ণ কমিটিই হতে পারছে না। সভাপতি ও সম্পাদক ছাড়া কোনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয় না, সেটা আপনি কী বলবেন?
হারুন-অর-রশিদ: আপনি এভাবে কমিটির ওপরে যদি এতটা বেশি জোর দেন, তাহলে আপনি কি বলবেন যে দলটি ৭০ বছর ধরে কী করে টিকে থাকল? এই সমাজের ভেতরের শক্তিকে যদি তারা উপলব্ধি করতে না–ই পারত, তাহলে তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কিন্তু আপনি যেভাবে দল শক্তিশালী করার বিষয়টিকে দেখছেন, সেটা কিন্তু অনেকটা থিওরিটিক্যাল। আপনি যদি তার সীমাবদ্ধতাগুলোকেই বড় করে দেখেন, তাহলে আপনি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তাকে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবেন না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
হারুন-অর-রশিদ: ধন্যবাদ।