বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক যেন সাপে-নেউলে না হয়
>আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন শুরু হচ্ছে আজ। এ বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ-এর সঙ্গে কথা বলি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে ঘিরে আপনার চিন্তা কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সেদিন আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমি একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলেছিলাম, সেটা হলো বাংলাদেশকে শক্তিশালী হতে হবে। বাংলাদেশকে যদি তার লক্ষ্য অর্জন করতে হয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের লক্ষ্য যদি অর্জিত হতে হয়, তাহলে ক্ষমতাসীন দলকে আরও শক্তিশালী হতে হবে। আর সেটা অর্জন করতে হলে তাকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এখন মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে তার যারা বিরোধী পক্ষ রয়েছে, তার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে তোলাই হবে সেই শক্তি অর্জনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে, একপন্থী হিসেবে দাঁড়াতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটা অর্জনের চেষ্টা না করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অবস্থানের দুর্বলতা কাটবে না। সরকার পর্যায়ে সেই দুর্বলতা কাটাতে হলে এই মুহূর্তে প্রয়োজন হলো দল–মত বা বিরোধী দলনির্বিশেষে একটা গেট টুগেদার। এর লক্ষ্য থাকবে শক্তি অর্জন।
প্রথম আলো: এটা তো অনস্বীকার্য যে কোনো রাষ্ট্রের বিদেশনীতি হলো সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বর্ধিতাংশ।
এমাজউদ্দীন আহমদ: সেটাই সঠিক কথা। সরকারি দল যদি দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা আস্থায় আনতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বাইরে কথা বলবেন, তখন সেটা অধিকতর কার্যকরভাবে বাংলাদেশের কথা হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অবস্থানটা তখন আরও একটু বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ প্রসঙ্গে আমার এটা স্মরণে আসছে যে স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩ সালে যখন শেখ সাহেব ওআইসি সম্মেলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাজউদ্দীন আহমদ সাহেব তাঁকে বললেন যে আপনি যান, ঠিক আছে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলে যান। তখন তিনি কী বলেছিলেন? তিনি তাজউদ্দীনকে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমার দেশ সম্পর্কে আমি যা ভাবব, তাই করব।’ নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভারত কী করল? শ্রীলঙ্কা বা মুসলিমপ্রধান মালদ্বীপের নাম তারা উচ্চারণ করল না। বলেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কথা। প্রতীয়মান হচ্ছে অনেক কিছু দিয়েও আর কূলমান রক্ষা করতে পারছে না। সময় এসে গেছে, বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবেই সাড়া দিতে হবে।
প্রথম আলো: রাজনীতিতে একটা শিষ্টাচার গড়ে উঠেছিল যে দলগুলো তাদের কাউন্সিলে বিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানাত—
এমাজউদ্দীন আহমদ: তাতে বিরোধী দল অংশ নিত এবং নিয়েছেও। এ ধরনের কাউন্সিলে বিরোধী দলকে সসম্মানে দাওয়াত দিয়ে আনাটাই সংসদীয় রীতিনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
প্রথম আলো: স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পতনের পরের দিনগুলোতে খবরের কাগজে প্রায়ই শিরোনাম হতো বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্র অচল।
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমি সেটাই বলছি। অপজিশন লিডারকে যথাযোগ্য মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানানোটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটা অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং আওয়ামী লীগের আসন্ন কাউন্সিল সামনে রেখে এ ধরনের পদক্ষেপ আমরা আশা করতে পারি। আমি আবারও বলব, বহির্দেশীয় শক্তির উদ্বেগজনক তৎপরতা মোকাবিলা করতে চাইলে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শক্তিশালী হতে হবে। কিন্তু আমরা দরকারি মুহূর্তে বাংলাদেশের এই চেহারাটা দেখতে পাই না। এটা দেখতে চাইলে অবশ্যই বিরোধী দলকে কাছে টানতে হবে।
প্রথম আলো: আপনার প্রাক্তন ছাত্র ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদের দাবি, বিএনপি এখন বৃহত্তম বিরোধী দল নয়।
এমাজউদ্দীন আহমদ: এখনো বিএনপি অফিসের সামনে যে ছোটখাটো সভাগুলো হয়, সেদিকে তাকালেই বোঝা যায় যে বিএনপি সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য।
প্রথম আলো: আপনার প্রাক্তন ছাত্র অবশ্য মনে করেন, দেশের বিরাজমান বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের একই সঙ্গে মন্ত্রিত্বে থাকা সমীচীন নয়।
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমিও তাই মনে করি। সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকর করতে হলে রাষ্ট্র থেকে সরকারকে যেমন ভিন্ন করতে হয়, তেমনি সরকারকেও দল থেকে ভিন্ন করতে হয়। নিয়মটা হলো সরকার ও দল আর এক থাকবে না। দল ও সরকার যদি একই সত্তায় মিশে যায়, তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্রটা মূর্ছা যায়। সংসদীয় ব্যবস্থাটা আর কার্যকর ও অর্থবহ থাকে না।
প্রথম আলো: সংসদ দলীয় সরকারে বিলীন হওয়ার তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন বেরিয়েছে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে গিয়ে ভারতও ওই পৃথক্করণের মডেলটা নিয়েছে। তাই সেখানেও দেখা যায় দলীয় নেতা যিনি, তিনি সরকারের নেতা নন। সংসদের দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা তিনি নন। ব্রিটেন বা অন্যরা কিন্তু এই অবস্থাটাই আঁকড়ে রেখেছে। তার কারণ এই পৃথক্করণটা রাখতে পারলেই তাতে জনস্বার্থ সব থেকে ভালোভাবে রক্ষা পেতে পারে।
প্রথম আলো: ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধীকরণে ক্ষমতাসীন দলের কিছু উচ্চপর্যায়ের নেতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন।
এমাজউদ্দীন আহমদ: এর সঙ্গে যাতে আরও কয়েকটি পদক্ষেপ গৃহীত হয়, তাহলে আমি এর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখি। ক্ষমতাসীন দল যদি এখন বিরোধী দলের কাছাকাছি আসে, যেমনটা আপনি একটু আগেই উল্লেখ করলেন, তার জবাবটাও এখানে দিচ্ছি। জেনারেল এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্বে আমরা দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে কাছাকাছি দেখেছি। তাদের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্রে এ রকম একটি কাছাকাছি সম্পর্ক থাকটাই একটা ট্রাডিশন।
প্রথম আলো: আরেকটি বিষয় বলুন, সেটা হলো বাংলাদেশের দলগুলো কেন গণতান্ত্রিকভাবে কমিটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিকভাবে কমিটির সংখ্যা কমছেই। তাহলে সামাজিক নেতৃত্ব কোন পথে তৈরি হবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমাদের এই দেশে যদি আমরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও শাসনব্যবস্থা চালু করতে চাই, তাহলে জনস্বার্থ সংরক্ষণের কথা সবার আগে ভাবতে হবে। আর সেটা করতে চাইলে বর্তমানে যেভাবে চলছে, সেখানে আমি বলব, সরকার থেকে দলকে কিছুটা হলেও আলাদা করতে হবে। দল হলো দলের, কিন্তু সরকার হলো সবার। সুতরাং এই অবস্থাটাকে তৈরি কিংবা অক্ষুণ্ন রাখতে পারলেই জনস্বার্থকে সব থেকে উত্তম উপায়ে রক্ষণ করা সম্ভব।
প্রথম আলো: বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে কি এ রকম কিছু করেছিল?
এমাজউদ্দীন আহমদ: বিএনপির জাতীয় পর্যায়ে সম্মেলন হলে তাহলে তাদেরও বলব, তারা যেন এই রকম পথে যেতে নিজেদের এখন থেকেই তৈরি করে।
প্রথম আলো: কিন্তু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিব হওয়ার পরে সাবজেক্ট কমিটি করেছিলেন। এতে অনেকটা শ্যাডো কেবিনেটের ছায়া পড়ে। বিভিন্ন কমিটি থেকে সুচিন্তিত মতামত দিলে সেটা দেশের দলভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাকে ঋদ্ধ করতে পারে। কিন্তু সেসব তেমন কাজ করছে না।
এমাজউদ্দীন আহমদ: তার কারণ অন্য দিন বলব। তবে এটুকু বলব যে একটা স্থবিরতা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়েই এটা আমরা কমবেশি দেখতে পাচ্ছি। এই স্থবিরতার কাল কতটা দীর্ঘ বা হ্রস্ব হবে তা বলতে পারব না। তবে এ ধরনের স্থবিরতার মধ্যে পরিবর্তন তেমন একটা দেখা যায় না। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে এ ধরনের বা কাছাকাছি অবস্থার মধ্য দিয়ে সমাজে বা রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তির উন্মেষ ঘটতে পারে। ফ্রান্সের অভিজ্ঞতা আমাদের কিন্তু তেমন একটা সম্ভাবনা মনে করিয়ে দিতে পারে।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের কাউন্সিল থেকে কী চান?
এমাজউদ্দীন আহমদ: যেন তারা এমন পদক্ষেপ, এমন নীতি–আদর্শ গ্রহণ করে, যাতে বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক সাপে-নেউলে না হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ না হোক, কিছুটা সহযোগিতামূলক হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
প্রথম আলো: কারাগারের পরিবর্তে খালেদা জিয়াকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে রাখার মধ্যে কিছুটা শুভেচ্ছার রেশ আছে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সেটা তো আছেই। না হলে তঁাকে রাখা হচ্ছে কেন। আমরা চাইব বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে, কারণ অনেক হয়েছে, অনেক, যিনি তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে অনেক দুর্ভোগ সয়েছেন এবং তঁার স্বামীও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এই দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে আরেকটু সদয় দৃষ্টি দিয়ে তঁাকে দীর্ঘকালীন পরিসরে একটা জামিন দেওয়া উচিত।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের দলীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী দেখেন? দ্বিদলীয় একসময় ভাবা হয়েছিল। অনেকের মতে এখন একদলীয়। কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?
এমাজউদ্দীন আহমদ: ছোট ছোট দল থাকবে অনেক। তবে দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটাই হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক মন্ত্র। আপনি যে অভ্যন্তরীণ কমিটি নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছেন, সেটা এক দিনে হয় না। বারে বারে করতে হয়, এ জন্য দলীয় স্তরগুলোতে একটা অভ্যাস গড়ে তুলতে দিতে হয়।
প্রথম আলো: বিএনপি ক্ষমতার বাইরে, তার আন্দোলন, মিছিল, সভা নেই। অফুরন্ত সময়। কিন্তু তারাও নির্বাচন করে কমিটি চায় না। কিন্তু এখানে অবাধ নির্বাচন ও তার ফল মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে না উঠলে জাতীয় নির্বাচন কেন অবাধ হবে, এটা তো অভ্যাসে থাকে না।
এমাজউদ্দীন আহমদ: বিএনপিরও এভাবে কমিটি করা উচিত। বাংলাদেশে দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ চাইলে এই কমিটিগুলো ব্যালটে হতে দিতে হবে। এই কমিটিগুলো এভাবে করতে পারলে যেটা হবে, সমাজে নেতৃত্ব তৈরি হবে। যার যা প্রাপ্য তখন তাকে তা দিতে হবে। বিরোধী দলের নেতাকে ধারণ করার অভ্যাসও এই অভ্যন্তরীণ কমিটি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই আশা করব, আওয়ামী লীগ এই কাউন্সিলে তার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি গঠনে উদ্যোগ নিক। একবার চালু করতে পারলে ধীর ধীরে অভ্যাসটা গড়ে উঠবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ধন্যবাদ।