মোশাররফের দণ্ড: সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে পারে
কোনো দেশে যখন একজন সাবেক সামরিক শাসককে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়, তখন তা ইতিহাস তৈরির চেয়ে কম নয়। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো সাবেক সামরিক প্রধানকে রাষ্ট্রদ্রোহের গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। দেশের সংবিধান স্থগিত করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ওই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ আদালতের রায় বিভিন্ন দিক থেকে একটি যুগান্তকারী অগ্রগতি। এটি সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং বিচার বিভাগের ক্রমবর্ধমান দৃঢ়তাকে তুলে ধরছে। এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব না–ও হতে পারে, তবে আদালতের রায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। রায়টি সম্ভাব্য সুবিধাবাদীদের কাছে একটি শক্ত বার্তাও পাঠিয়েছে।
মোশাররফের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি একটি বিস্ফোরক রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির একটি বড় কারণ ছিল। সাবেক সেনাপ্রধানকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কারাগারে অন্তরীণ রাখার ঘটনায় সামরিক বাহিনী অবশ্যই খুশি ছিল না। এবং এখন এই দণ্ড সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। রায় ঘোষণার পর সামরিক নেতৃত্ব রায়ের বিরোধিতা করে ও মোশাররফের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে।
পাকিস্তানে অতীতে অনেক রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু সংবিধানের ৬ নম্বর ধারার আওতায় এই প্রথম কোনো সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। বেশ কয়েকবার বেঞ্চ পরিবর্তনের কারণে মামলাটির বিচারপ্রক্রিয়া পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে। ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারির জন্য মোশাররফকে ২০১৪ সালে অভিযুক্ত করা হয়।
এখানে একটি বড় আশঙ্কা ছিল যে সেনাবাহিনীর বিরোধিতার কারণে বিচারপ্রক্রিয়া কখনো শেষ হবে না। বারবার তলব করা সত্ত্বেও মোশাররফ আদালতে হাজির হননি। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের বাইরে রয়েছেন এবং গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে তিনি দেশ ত্যাগ করেন। আদালত তখন তাঁকে পলাতক ঘোষণা করেন।
এটা স্পষ্ট ছিল যে ইমরান খানেরসরকার মোশাররফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিল না। গত মাসে একটি নাটকীয় পদক্ষেপে সরকার এই মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের প্রত্যাহার করে এবং আদালতকে বিচারকাজ স্থগিত করতে বলে। কারণ হিসেবে বলা হয় সাবেক সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে মামলাটা বেশ দুর্বল। আদালতের এই রায় এখন সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। সরকার মোশাররফের মৃত্যুদণ্ডের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানায় কি না, তা এখন দেখার বিষয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে মোশাররফকে দেশে ফিরতে হবে। তবে তাঁর দেশে ফেরার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই।
১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জেনারেল মোশাররফ এক অভ্যুত্থানে নওয়াজ শরিফের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের অভিশংসনের হুমকিতে ওই বছরের আগস্ট মাসে মোশাররফ প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। মজার বিষয় হচ্ছে মোশাররফের পদত্যাগের পাঁচ বছরের বেশি সময় পরে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়।
উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যান প্যাটারসন বলেছেন, আসিফ আলী জারদারি তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি মোশাররফকে দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, কেবল দায়মুক্তির প্রতিশ্রুতিতেই মোশাররফ প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে রাজি হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে ক্ষমতায় আসা পিপিপি সরকার মোশাররফের কাছে শপথ নিয়েছিল। তিনি তখনো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
তবে নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। তিনি তখন মোশাররফের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ পেয়ে যান। কারণ, মোশাররফ তাঁকে কেবল ক্ষমতাচ্যুতই করেননি, তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করেছিলেন।
মজার বিষয় হলো মোশাররফকে তাঁর আসল অপরাধ, অর্থাৎ একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চালানোর জন্য বিচার করা হয়নি। বরং ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি এবং সংবিধান স্থগিত করে রাখার জন্য বিচার করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট এবং পার্লামেন্ট ওই ঘটনার দায় থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছে। এ জন্য অনেক আইন বিশেষজ্ঞই প্রশ্ন তুলেছেন যে ২০০৭ সালের পদক্ষেপটি সংবিধানের ৬ ধারার অধীনে মোশাররফকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট ভিত্তি দিয়েছে কি না।
ব্যাপক বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে মোশাররফ ২০০৭ সালের নভেম্বরে সংবিধান স্থগিত করেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এ ঘটনাকে বিশ্লেষকেরা দ্বিতীয় অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেন। তখন প্রধান বিচারপতিসহ বেশির ভাগ শীর্ষ আদালতের বিচারকদের আটক করা হয়েছিল। এই পদক্ষেপ তাঁর নয় বছরের শাসনেরও অবসান ঘটায়।
স্পষ্টতই, সামরিক নেতৃত্ব মোশাররফের বিচারপ্রক্রিয়া থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল, কিন্তু বাস্তব ঘটনা অন্য রকম। ২০১৫ সালে মোশাররফের রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার বিচারের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ ঘোষণা করেছিলেন যে ‘সেনাবাহিনী তার নিজস্ব মর্যাদা ও প্রাতিষ্ঠানিক গর্ব রক্ষা করবে।’ তাঁর এ ঘোষণায় এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে মোশাররফ সামরিক বাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত এবং তারা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ মেনে নেবে না। তাদের বর্ণনায় এটা তাদের ‘সামরিক বাহিনীর অবমাননা’।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট যেদিন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার মেয়াদ বাড়ানোর মামলার পূর্ণ রায় প্রকাশ করেছেন, তার এক দিন পর মোশাররফের বিরুদ্ধে এই মামলার রায় ঘোষণা করা হলো। আদালত ছয় মাসের জন্য জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদ বাড়িয়েছেন। তবে এ বিষয়ে সংসদকে অবশ্যই ছয় মাসের মধ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে। ছয় মাসের মধ্যে আইন প্রণয়ন করতে না পারলে নিয়োগ অবৈধ হবে।
এই রায় একটি নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে যে এটার জন্য সাংবিধানিক সংশোধনী প্রয়োজন, নাকি কেবল নিয়ম পরিবর্তন করলেই হবে। এই সিদ্ধান্ত সেনাপ্রধানের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে বিতর্ককে আরও গভীর করেছে। আদালতের দুটি আদেশই দেশের বিচার বিভাগের দৃঢ়তাকে সামনে এনেছে, যা এককথায় নজিরবিহীন। এর ফলে সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। আসলে খেলা এখনো শেষ হয়নি। এরপরে যা ঘটবে, তা সরকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য হবে মারাত্মক পরীক্ষা।
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
জাহিদ হুসেইন: পাকিস্তানি লেখক ও সাংবাদিক