মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়বে
নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা গণহত্যা মামলার তিন দিনব্যাপী শুনানি শুরু হয় ১০ ডিসেম্বর। এই দিন মামলার বাদী গাম্বিয়া অভিযোগগুলো পেশ করে। ১১ তারিখে এসব অভিযোগের জবাবে তাদের অবস্থান উপস্থাপন করে মিয়ানমার। গাম্বিয়ার এই মামলা ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার পক্ষ থেকে করা হয়েছে। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন সে দেশের আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তাম্বাদু। ১০ ডিসেম্বর তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন। ১১ ডিসেম্বর মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন দেশটির প্রকৃত সরকারপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি।
দুই পক্ষের বক্তব্যই পত্রপত্রিকায় বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে, যা পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। অভিযোগ ও জবাবের শুধু চুম্বক অংশটুকু দেখে নেওয়া যাক। গাম্বিয়ার বক্তব্যে হত্যা, শিশু হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং গণ–উচ্ছেদের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর নীতিতেই গণহত্যার উদ্দেশ্য নিহিত ছিল বলে আদালতকে অবহিত করা হয়। এ ছাড়া গণহত্যা এখনো চলমান, বিধায় তা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়।
প্রত্যাশিতভাবেই অং সান সু চি তাঁর বক্তব্যে গণহত্যার সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উত্তর রাখাইনের সীমান্তবর্তী এলাকায় ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে কিছু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এ সময় কিছু সেনাসদস্য ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ করেছিল বলে তিনি স্বীকার করেন, সে ব্যাপারে মিয়ানমারের বিচারব্যবস্থার অধীনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর উভয় পক্ষ পরস্পরের উপস্থাপিত বক্তব্য খণ্ডন করে নিজেদের অবস্থানের ব্যাখ্যা প্রদান করেছে।
তিনটি প্রশ্ন এ প্রসঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনেই; এক. গাম্বিয়া কেন? দুই. বাংলাদেশ কেন নয়? তিন. মামলার রায়ে যদি মিয়ানমারকে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে কি রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে?
প্রথম প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক এ জন্য যে এ রকম মামলা সাধারণত পার্শ্ববর্তী দেশ, যাদের স্বার্থ রয়েছে তারাই করে থাকে। গাম্বিয়া তো দূরবর্তী এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, যার কোনো সরাসরি স্বার্থ নেই এ বিষয়ে। এর উত্তর হচ্ছে, গাম্বিয়া মামলাটি করেছে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষ থেকে। ওআইসির পক্ষ থেকে গাম্বিয়াকে নির্বাচনের কারণ, আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তাম্বাদু এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। রুয়ান্ডা গণহত্যার মামলা তিনি পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও এ বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বিতাড়িত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাফল্যের দেখা যদিও মেলেনি, এই দ্বিপক্ষীয় জানালা বাংলাদেশ বন্ধ করতে চায় না। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছে। বাংলাদেশ যদি মামলার পক্ষ হতো, তাহলে মিয়ানমার একটি অজুহাত পেয়ে যেত দ্বিপক্ষীয় প্রয়াস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। মামলা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবাসনের পুরো প্রক্রিয়াটি সে ক্ষেত্রে ঝুলে যেতে পারত। এটা ঠিক যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না, তবু চেষ্টা তো চালিয়ে যেতে হবে।
তৃতীয় প্রশ্নটির উত্তর বেশ জটিল, না এবং হ্যাঁ দুটোই হতে পারে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এই মামলায় প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত তার নির্যাতনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জাতিসংঘের গণহত্যা আইন লঙ্ঘন করেছে কি না। অর্থাৎ, মিয়ানমার গণহত্যা সংঘটিত করেছে কি না। যদি করে থাকে, অর্থাৎ মামলার রায় যদি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে যায়, তাহলে তাদের পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি বিষয় আসবে।
কিন্তু নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসন বিষয়ে সরাসরি নির্দেশনা সম্ভবত এই আদালতের এখতিয়ারভুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। মামলায় চলমান গণহত্যা বন্ধে আদালতের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের প্রতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা জারির আরজি আছে। আরজিটির নিষ্পত্তি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে। এরূপ নির্দেশনা যদি আসে, তবে সেটা হবে গাম্বিয়া এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে একটা নৈতিক বিজয়।
এ ছাড়া প্রশ্ন আছে, আদালতের রায় মিয়ানমার যদি না মানে, তাহলে কী করা যাবে। সে ক্ষেত্রে রায় কার্যকরের দায়িত্ব বর্তাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ওপর। সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত নিরাপত্তা পরিষদ কী পদক্ষেপ নেবে, তা অনুমান করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা পরিষদ ব্যর্থ হলে ‘ইউনাইটিং ফর পিস’ নামে একটা ব্যবস্থা আছে, যাতে সাধারণ পরিষদের ৮০ শতাংশ ভোটে নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো বাতিল করা যায়। তবে কোরীয় যুদ্ধের পর এ পদ্ধতি আর কখনো প্রয়োগ করা হয়নি। তা ছাড়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের ৮০ শতাংশ সদস্যরাষ্ট্রকে এককাট্টা করা যাবে, তেমন সম্ভাবনাও কম।
তাহলে এ মামলা জিতলেই–বা লাভ হবে কী? মিয়ানমার যদি একটি গণহত্যাকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে এখন পর্যন্ত যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশ মিয়ানমারের পেছনে রয়েছে, তাদের বর্তমান অবস্থান ধরে রাখা নৈতিক দিক থেকে কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি বিশ্ব মোড়লদের যারা আজ কিছু অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে শক্তভাবে মিয়ানমারের সব অপকর্মকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য সহজ হবে নিজ স্বার্থ বিসর্জন না দিয়েও মিয়ানমারকে সভ্য সমাজে ফিরে আসতে চাপ দিয়ে রাজি করানো। গণহত্যাকারীদের দোসর বলে পরিচিত হতে নিশ্চয় চাইবে না অনেক দেশই।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘটিত অবর্ণনীয় নির্যাতনের মধ্যে গণহত্যার সুস্পষ্ট আলামত আছে, এটা নিশ্চিত। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে আদালতের রায়ে মিয়ানমার অবশ্যই গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেই। পৃথিবীতে অনেক অপরাধ ঘটে যেখানে অপরাধী কে তা সবাই জানে, তারপরও আইনের ফাঁক গলে অপরাধী পার পেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি যে ঘটবে না, সে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য, হত্যা–নির্যাতনের পেছনে গণহত্যার অভিপ্রায় ছিল, তা প্রমাণ করতে হবে। সুচতুরভাবে অং সান সু চি উত্তর মিয়ানমারে অভিযান চলাকালে সেনাসদস্যদের ‘কিছু’ অপরাধের কথা স্বীকার করছেন। কিন্তু এর পেছনে গণহত্যার অভিপ্রায় ছিল, তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করছেন। আমরা আশা করব, তাঁর এই মিথ্যাচার সব স্পট সাক্ষ্যপ্রমাণের সামনে অসার প্রমাণিত হবে এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত একটি ইতিবাচক রায় দিতে সক্ষম হবেন। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অপরাধের স্বীকৃতিও একটি অর্জন।
এ ছাড়া এই মামলা রোহিঙ্গাদের পক্ষে বিশ্ববিবেককে অন্তত খানিকটা নাড়া দিতে সক্ষম হবে। কানাডা ও নেদারল্যান্ডস এই মামলায় সব ধরনের সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। আটজন নোবেলজয়ী প্রকাশ্য আদালতে গণহত্যার দায় স্বীকার করে নিতে অং সান সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের কয়েকজন সদস্য সু চিকে পাঠানো চিঠিতে বলেছেন যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপকর্মের সাফাই গাইতে গিয়ে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার সামান্য যা অবশিষ্ট আছে, তিনি তা–ও হারাবেন।
রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই হবে দীর্ঘ। এ বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে অনেক বন্ধু লাগবে এই চরম দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর। এ মামলায় আর কিছু না হোক, তাদের ওপর নির্যাতন–নিপীড়নের চিত্র আরও বেশি উন্মোচিত হবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে। আশা করা যায়, সেই সঙ্গে তাদের সহমর্মী বন্ধুর তালিকাও অনেকটা দীর্ঘায়িত হবে এর মাধ্যমে।
মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব