মানবজীবনে প্রকৃত সফলতা ও চূড়ান্ত বিজয়
মানবজীবন এক অনন্ত সফর। রুহের জগৎ থেকে এর পরিভ্রমণের সূচনা, দুনিয়া তার কর্মক্ষেত্র, বারজাখ (কবরজীবন) হলো অন্তর্বর্তী সময় এবং আখিরাত হলো এর ফল লাভের ও উপভোগের স্থান। মানুষের কর্ম ও তার ফলাফল এবং পরিণতির ওপর নির্ভর করে বিজয় ও পরাজয়। বিজয় যখন সফল ও সার্থক হবে, তখনই তা যথার্থ হবে; বিজয় যদি বিফল হয়, তবে সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে কারিমে বলেন: ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মোমিনগণ—যারা নিজেদের নামাজে বিনয়ী ও নম্র, যারা অসার ক্রিয়াকলাপ হতে বিরত থাকে, যারা জাকাত প্রদানে সক্রিয়, যারা নিজেদের সম্ভ্রম সুরক্ষা করে।’ ‘এবং যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং যারা নিজেদের সালাতে যত্নবান থাকে, তারাই অধিকারী হবে (জান্নাত) ফিরদাউসের, যাতে তারা স্থায়ী হবে।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ১-১১)।
বিজয় মানুষকে সুপথে ও কল্যাণ কর্মের সুযোগ করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়, যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন এবং আল্লাহ তোমাকে বলিষ্ঠ সাহায্য দান করেন।’ (সুরা-৪৮ ফাতহ, আয়াত: ১-৩)।
বিজয় তাদের সুনিশ্চিত, যারা মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখে; আল্লাহ সে স্বপ্ন পূরণ করেন। ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর রাসুল (সা.)–কে স্বপ্নটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে—তোমাদের কেউ কেউ মস্তক মুণ্ডন করবে আর কেউ কেউ কেশ কর্তন করবে। তোমাদের কোনো ভয় থাকবে না। আল্লাহ জানেন, তোমরা যা জানো না। এ ছাড়া তিনি তোমাদিগকে দিয়েছেন এক সদ্য বিজয়। তিনি তাঁর রাসুল (সা.)–কে পথ নির্দেশ ও সত্য-দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, অপর সমস্ত দ্বীনের ওপর একে বিজয়ী করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা-৪৮ ফাতহ, আয়াত: ২৭-২৯)।
এই জীবন পরকালের প্রস্তুতি পর্ব। পরকালীন সফলতাই জীবনের সার্থকতা। কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘জীবনমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কিয়ামতের দিন তোমাদিগকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হবে। (সেদিন) যাকে অগ্নি হতে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হবে, সে-ই সফলকাম। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)।
বিজয় তখনই সফল ও সার্থক হবে, যদি তার স্থায়ী সুফল ভোগ করা যায়। এ জন্য বিশেষ করণীয় রয়েছে। এ সম্পর্কে কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আমি তাহাদিগকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে; আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারে।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৪১)।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা বিজয়কে মানবতার বিজয়রূপে উপহার দিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (ইবনে কাসির)। অর্থাৎ কেউ কারও ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে না। সবার একমাত্র প্রভু মহান আল্লাহ। ইসলামের মূল বাণী পবিত্র কালেমায় এ ঘোষণাই দেওয়া হয়েছে: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ অর্থাৎ ‘এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নেই, হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।’ ‘এই ঘোষণার পর মানুষ মানব–দানব সকল প্রকার প্রভুর গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এবং আদর্শ হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে গ্রহণ করে।’
বিজয় তখনই সফল হবে, যখন মানবাধিকারের মূল বিষয় ‘সকল মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান’ সুরক্ষিত হবে। বিজয় তখন সার্থক হবে, যখন স্বাধীনতার মূল চেতনা ইনসাফভিত্তিক সমাজ কায়েম হবে। সব মানুষের জীবনের সুরক্ষা, সম্পদের সুরক্ষা, জ্ঞানের সুরক্ষা ও বংশধারা সুরক্ষা নিশ্চিত হবে এবং স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালন সুরক্ষিত হবে। তবেই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার এই বিজয় আখিরাতের চিরস্থায়ী অনন্ত জীবনে চূড়ান্ত বিজয়ের সোপান হবে ইনশা আল্লাহ!
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
[email protected]