বিষণ্নতার রাজধানীই আমাদের নিয়তি
রাজধানী ঢাকার ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্ন। এই বিষণ্নতা কবিদের বিষণ্নতা না, এই বিষণ্নতা মানুষ হয়ে অমানবিকভাবে বাঁচতে বাধ্য হওয়ার বিষণ্নতা। ২০ বছর আগে ঢাকার রিকশাচালক আর তরুণ কবিদের প্রায় সবাই ছিল বিষণ্ন। সে সময় ঢাকার সব রাস্তায় রিকশা চলত আর ফাঁকাও ছিল। দেখতাম মাঝরাতে বিষণ্ন রিকশাওয়ালা প্যাডল ঠেলছে আর পেছনে ততোধিক বিষণ্ন কবি ‘ও রে নীল দরিয়া’ বা ‘এই নীল মণিহার’ গাইতে গাইতে যাচ্ছে। সেই বিষণ্নতার মধ্যে তা-ও মায়া ছিল, সৌন্দর্য ছিল। কিন্তু বিআইডিএসের গবেষণায় যাদের বিষণ্নতা মারাত্মক বলে ধরা পড়েছে, তাদের বিষণ্নতা কাব্যিক নয়, অতিমাত্রায় গাদ্যিক। ম্যাচবাক্সের মতো ছোট ছোট বাসাবাড়িতে কোটি কোটি মানুষ থাকছে, তারাই ভোর হলে পিলপিল করে নামছে রাস্তায়—যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এমন সব বাস, যা যাত্রীদের গবাদিপশুর থেকে সামান্য উন্নত বলে মনে করে। ঘরে-বাইরে সবখানে জোর যার মুল্লুক তার।
এখনকার বিষণ্নতা দেহের সুস্থতা, মনের জোর সব খেয়ে ফেলে।
উত্তরের মঙ্গার তাড়া খেয়ে অভাবী মানুষেরা ঢাকায় আসতে বাধ্য হতো, জীবিকা ছাড়া অন্য কোনো টান এ শহরের প্রতি তাদের ছিল না। যে শহরে তারা অপমান-অপদস্থ হয়ে প্রাণীর মতো পরিবেশে বস্তিতে ঘুমাত, সেই শহরে তাদের জীবন তো বিষণ্নই হবে।
এরপর বিষণ্নতার সারিতে এসে দাঁড়াল লাখো পোশাককর্মী। জীবিকার শিকল তাদেরও টেনে ঢাকায় এনে ফেলল। মূলত তরুণী সেই মেয়েরা যৌবনের সেরা সময়টা ১২-১৪ ঘণ্টা সময় হাড়জ্বালানো পরিশ্রম এবং ফোরম্যান-ম্যানেজারদের গালাগালের ভার গায়ে নিয়ে প্রায় বস্তির মতো বাসায় ফিরে বসত রান্না-কাপড় ধোয়ার মতো কাজে। এই জীবনে কোনো আশা জমে না। এই দাসশ্রমভিত্তিক অর্থনীতিতে একদিকে বিপুল মুনাফা তৈরি হয়, অন্যদিকে শ্রমিকদের জীবনে জমে বিষণ্নতার গাদ। আখ নিংড়ানো মেশিনের একদিকে রস জমাতে হলে অন্যদিকে পড়ে থাকে শুকনা ছোবড়া। ছোবড়া হয়ে যাওয়া মানুষের জীবন তাই বিষণ্ন হতে বাধ্য।
আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশের জীবনেই আনন্দ নেই। সন্তানের জন্মের সময় বা অসুখ-বিসুখের সময় যে বাবা থাকতে পারে না, প্রবাসের বৈরী পরিবেশে যাদের আনন্দ করার সুযোগ কম, বিষণ্নতা তাদের ছায়াসঙ্গী। প্রবাসীদের পাঠানো ডলারের গায়ে তাই লেগে থাকে নিরানন্দ জীবনের হতাশা।
এরপর আছে এই শহরের নিম্ন আয়ের কোটি মানুষের পরিবার। বাসাবো-খিলগাঁও-মুগদাপাড়ায়, মোহাম্মদপুর-আদাবর-মিরপুরে, পুরান ঢাকা-কেরানীগঞ্জে বা ভাষানটেক-রামপুরা-বাড্ডায় যারা ৭০০-৮০০ বর্গফুটের বাসায় স্বামী-স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে, সেই জীবনে স্বস্তি কোথায়? স্বস্তি কোথায় যানজট-দূষণ আর অপমানকর সড়কে? তার ওপর বাজারের আগুন, বিবিধ রকম ভয়ের তাপ আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা যাদের এসব দিন-রাত্রিকে কুরে কুরে খায়, তারা একসময় টের পায় জীবন এক বিষণ্ন ফাঁদ।
ঢাকার জনসংখ্যায় মেসবাসীদের অংশ কম নয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোচিং করতে এসে বা হলে সিট না পেয়ে হাজারো ছেলেমেয়েকে কম ভাড়ার মেসে থাকতে হয়। চাকরির খোঁজে থাকা বেকারের বিষাক্ত সময়গুলোর সাক্ষী কেবল ওই সব মেসের চৌকি। কারাগারের মতো বিষণ্ন এ শহরে মাঠে, পার্কে, স্কয়ারে বা নদীর ধারে বেড়ানোর উপায় নেই, শিশুদের নেই খেলার মাঠ। নারী বা শিশু বা বৃদ্ধ কারও জন্য এ শহরের রাস্তা, পরিবহন, প্রশাসন উপযোগী না। কাজে বেরোনো মানে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করা। চলাচলে ঝামেলা, অফিস-আদালতে ঝামেলা-ঘুষ-অবজ্ঞা। কিন্তু কিছু করার নেই। যায় দিন ভালো, আসে দিন আরও খারাপ। এ অবস্থায় আশা হারিয়ে যায়, যারা পারে দেশ ছাড়ে, বাকিরা বিষণ্নতার স্থায়ী রোগী হয়ে পড়ে।
এই বিষণ্নতা কেবল অর্থনৈতিক না, কেবল ভুল নগরায়ণের ফলও না; সেরের ওপর সোয়া সের হয়েছে রাজনৈতিক অবসাদ। ভয়ের সংস্কৃতি বলে একটা কথা চালু আছে। আদতে ভয়ের কোনো সংস্কৃতি হয় না, ভয়ের পরিবেশে মানুষের সংস্কৃতিও ভয়ে জমে যায়। মানুষে মানুষে যোগাযোগ কমে যায়, মতপ্রকাশের অধিকার লোপ পায়, মানুষের মর্যাদা তলানিতে নেমে পড়ে। মানুষ এভাবে সংস্কৃতিহীন হয়ে পড়ে। যে দেশের মানুষের ভোটের অধিকার থাকে না, প্রতিবাদ মানে যেখানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া, ভিন্নমত মানে পাড়া থেকে প্রতিষ্ঠানে কোণঠাসা হয়ে থাকা, সেখানে বিষণ্নতা মহামারি হয়ে উঠবেই। বিষণ্নতার রাজনীতি আছে, সেই রাজনীতি মানুষকে মাথা নত করে চলা বিষণ্ন জীবে পরিণত করে আর তারপর তাদের মধ্য থেকে তৈরি করে খুনি, দখলদার, লুটেরা ও নির্যাতকদের। বিআইডিএসের ওই জরিপ বলছে, ঢাকার ১০ শতাংশ ধনী মানুষের আয় পুরো শহরের বাসিন্দাদের মোট আয়ের ৪৪ শতাংশ। আর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ১ শতাংশের কম।
এমন মারাত্মক বৈষম্যের পরিসংখ্যান কি আমাদের বিষণ্ন করে তোলে না?
এই অসহায় ও বিষণ্ন মানুষের মনোবিকার এতই বাড়ে যে অচিরেই সেখানে দেখা দেয় ‘সোশ্যাল ক্যানিবালিজম’। পশ্চিমে এই কথাটা চালু। অপরের ক্ষতি চাওয়া এর ছোট রূপ। বড় রূপ হলো অবিরত হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও গণপিটুনির হিড়িক। কিছুই নতুন না। সুযোগ ও সুবিধা যেখানে এত কম, সেখানে বাসের সিট, হলের সিট এবং চাকরির সিট নিয়ে মানুষ কামড়াকামড়ি করতে বাধ্য। এ রকম বিষণ্ন ও উদ্বিগ্ন মানুষ ক্রমেই প্রত্যেকে প্রত্যেকের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। অবিশ্বাস্য অবিশ্বাস রাজনীতি থেকে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। সম্পর্কে প্রতারণা, ঈর্ষা, হিংসা আর অন্যের ক্ষতি করে নিজের লাভের বাসনা সেখানে অপ্রতিরোধ্য হয়ে যায়।
রাজধানীর ৭১ শতাংশ বিষণ্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে তখন পাওয়া যায় ৬৮ শতাংশ শারীরিক অসুস্থতায় ভোগা মানুষ, সাড়ে ৩ শতাংশ মানুষ এখনো তিন বেলা খেতে পায় না। শহরের অধিবাসীদের মোট মাসিক আয়ের ৯ শতাংশ খরচ হচ্ছে চিকিৎসা খাতে। বিষণ্নতা তার উদ্দীপনা নষ্ট করে বলে জীবনের দুর্দশা দূর করার চেষ্টা কমে যায়, আর অসুস্থতা খেয়ে নেয় তার আয়ের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ।
বিষয়টা বুঝতে বারবার আমরা আলজেরীয় বিপ্লবী ফ্রানজ ফ্যানোর কাছে যাই। তিনি এ অবস্থাকে বলছেন ইন্টারমিডিয়েট ভায়োলেন্স বা মধ্য দশার সহিংসতা। দবির ও খবিরের শত্রুতা হলো ব্যক্তিগত। দল, সরকার, রাষ্ট্র, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সহিংসতা রাজনৈতিক। আর বিশৃঙ্খল জনতা যখন কাউকে পিটিয়ে মারে, তখন তাকে বলব মধ্যম পর্যায়ের হিংসা। যে দেশে মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম বা বিপ্লব-বিদ্রোহের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না বা চায় না, সেখানে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও পাবলিক বা সামাজিক সহিংসতা মহামারি আকারে ছড়ায়। যখন মানুষ রক্ত দিতে ভয় পায়, তখন সমাজদেহে জমা বিষাক্ত রক্ত এভাবে পুঁজ হয়ে বেরোয়।
এর সমাধান কী? চলমান শাসনের ধারা আরভুল নগরায়ণ ও উন্নয়নের উৎসব চালু রেখে সমাধান আশা করা মানে কুড়াল দিয়ে ফোঁড়া কাটা। শহর ব্যবসা-বাণিজ্যের জায়গা, রাজনীতির রেষারেষির জায়গা। শহরকে বসবাসের প্রধান কেন্দ্র বানিয়ে আমরা ভুল করেছি। অথচ আমাদের কোনো কোনো মন্ত্রী সকল গ্রামকে শহরের আদলে গড়তে চান। বাংলাদেশের খুব কম পরিবারেরই শহরে বসবাসের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। শত শত বছর আমরা গ্রামে যৌথ জীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ হয়ে থেকেছি। শহর আমাদের বিষণ্ণ করবেই। কিন্তু যে শহর বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল হয়েও বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য, সেই শহর তো দেশের ললাটলিখন হতে পারে না। রাজধানী হলো দেশের প্রচ্ছদ, সেই প্রচ্ছদকে এমন বিষণ্ণ ও অমানবিক রেখে কোন আশায় বুক বাঁধব আমরা?
ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক