একসময়ের খাদ্যঘাটতির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ খাদ্যে স্বাবলম্বী হয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের মনে
রাখতে হবে যে আমরা খাদ্যে স্বাবলম্বী হলেও পুষ্টির ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে পুষ্টিসংক্রান্ত যে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে, তাতে দেখা যায়, দেশের প্রতি আটজনের মধ্যে একজনের, অর্থাৎ ২ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষের
পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। আর সুষম খাবার কেনার সামর্থ্য নেই অর্ধেকের বেশি মানুষের।
গত বুধবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে পুষ্টিসম্মত খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং মানুষের তা কেনার সামর্থ্য কতটুকু আছে, তা–ও বিবৃত হয়েছে। সরকারি হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্যের হার ১২ শতাংশ। এ কথা সত্য যে গত কয়েক বছরে দারিদ্র্যের হার বেশ কমেছে। কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ার কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেনি। অতিদরিদ্র মানুষ ভাত, রুটি ও কম পুষ্টিকর খাবার দিয়ে কোনোরকমে ক্ষুধা নিবৃত্তি করলেও পুষ্টির প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পারছে না। আবার নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের মতো দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার বাসিন্দারা তিন বেলা ঠিকমতো খেতেও পারছে না।
তবে পুষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যও আছে। ১৯৯৭ সালে যেখানে দেশে ৬০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির ছিল, ২০১৮ সালে তা কমে ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। সার্বিকভাবে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নারীর পুষ্টি পরিস্থিতি এখনো নাজুক অবস্থায় আছে। ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রতি তিনজনের একজন নারী প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার পায় না। এ তথ্য খুবই উদ্বেগজনক। আগের থেকে আমরা কতটা ভালো করেছি, তার চেয়ে জরুরি হলো, কত দ্রুত বর্তমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে তৈরি করার কথা বলেন। কিন্তু বিপুলসংখ্যক মানুষকে অপুষ্টিতে রেখে সেটি সম্ভব নয়। এ কারণে সরকারের সব উন্নয়ন কর্মসূচিতে পুষ্টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে দরিদ্র মানুষের মধ্যে চাল ও গম বিতরণ করছে, যার ‘লাভের গুড়’ পিঁপড়াই বেশি খেয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। এ অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় চাল বা গম না দিয়ে তাদের কাছে পুষ্টিকর খাবার পৌঁছাতে পারলে সেটি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
সরকার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুপুরের খাবার হিসেবে পুষ্টিকর বিস্কুট দিচ্ছে, যাতে শিক্ষার্থীদের পুষ্টির চাহিদা অনেকটাই পূরণ হচ্ছে। যদিও এ কর্মসূচি এখনো পাইলট স্কিম হিসেবে চালু আছে। শিশুদের মতো দরিদ্র নারীদের জন্যও তৈরি খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির প্রয়োজন অনেক বেশি। মা অপুষ্টিতে ভুগলে তাঁর সন্তানও অপুষ্ট ও রুগ্ণ হবে। বাংলাদেশে ডব্লিউএফপির এ দেশীয় উপপরিচালক আলফা বাহ দারিদ্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়া জরুরি বলে মত দিয়েছেন।
তবে শুধু সহায়ক কর্মসূচি দিয়ে দেশের পুষ্টি সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এর টেকসই সমাধানের জন্য প্রত্যেক মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে, দরিদ্র মানুষের আয় বাড়াতে হবে; যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে। জিডিপি বাড়ানোর পরিসংখ্যানে তৃপ্ত না থেকে জনগণের পুষ্টির দিকে নজর বাড়াতে হবে।
উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সমৃদ্ধ মানবসম্পদের বিকল্প নেই।