২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

শিশুদের পরীক্ষার কারাগার থেকে মুক্তি দিন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

যুক্তি যেখানে জ্ঞানের প্রসার ঘটায়, জেদ সেখানে ধ্বংস ডেকে আনে। আমাদের এখন যুক্তি ও জেদের মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার সময়। ২০১০ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয় প্রাথমিক সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা। সেই থেকে বিবাদের শুরু। আমলা-পরামর্শিত সরকারের জেদ, আর ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক শিক্ষাবিদের যুক্তি। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে যুক্তি অগ্রাহ্য করে চলছে জেদের কারবার। এখন শুরু হতে চলেছে পাবলিকের টাকার শ্রাদ্ধের শেষ আয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের তোড়জোড় এখন তুঙ্গে। সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। প্রাথমিক ও এবতেদায়ি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য গঠন করা হবে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড।

মিডিয়া এ খবর প্রচারে টিপ্পনী কাটতে ভুলে যায়নি। লিখেছে, প্রথম থেকেই দেশের শিক্ষক ও অভিভাবকেরা বলে আসছেন, প্রাথমিক সমাপনীর নামে শিশুদের ওপর পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেড়েছে নোট-গাইডনির্ভরতা আর কোচিং–বাণিজ্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মানুষ বাধ্য হয়ে আদালতে গিয়েও এই নির্মম শিশু নির্যাতন থেকে অতি উৎসাহীদের নিবৃত্ত করতে পারেনি।

বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে যা চলছে তার সঙ্গে তুঘলক সুলতান বা এ যুগের ট্রাম্পের সঙ্গেই কেবল তুলনা চলে। ট্রাম্প সাহেব ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শোর তুলে আমেরিকাকে ধংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। আমরা আর কী করেছি—তা তোলা থাক, তবে শিক্ষা ধ্বংসের ষোলোকলা পূর্ণ করে এনেছি বটে! প্রাসঙ্গিক সওয়াল করাই যায়। গ্রেড নিয়ে এই কদিন আগেও প্রাথমিক শিক্ষকেরা রাস্তায় ছিলেন। রাস্তা থেকে শিক্ষকদের উঠে যাওয়া বোধ হয় কোনোকালেই আর সম্ভব হবে না। রোদ–বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, না খেয়ে, না ঘুমিয়ে থাকতে হবে রাস্তাতেই। সেখানে যেটা অনিবার্য জুটবে, তা হলো পুলিশের পিটুনি আর আমলা-কর্তাদের চোখ রাঙানি। এভাবেই চলছে দশকের পর দশক।

বেসরকারি স্কুল–কলেজ–মাদ্রাসার এমপিও ঝুলিয়ে রাখা হলো ১০ বছর, জট যত না খুলেছে, বেঁধেছে তার চেয়ে ঢের বেশি। বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার সুরাহার কোনো চিন্তাই নেই কর্তাদের মাথায়। চার দশক ধরে ঝুলে আছে বেসরকারি কলেজে নির্মম শিক্ষক-অনুপাত ব্যবস্থা। গত ৬০ বছরে প্রাইমারি শিক্ষা পাঁচ না আট বছরের হবে, উচ্চমাধ্যমিক স্তর থাকবে কি থাকবে না, কিংবা মাধ্যমিক স্তর কোথা থেকে কোন পর্যন্ত হবে, তার সুরাহা হলো না। কিন্তু ভদ্রলোকের এককথা। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা নেওয়ার জবরদস্ত আয়োজনে কারও তর সইছে না।

কিন্তু আসলে কী হচ্ছে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার নামে? শিশুদের নাওয়া-খাওয়া হারাম। আনন্দ বলে শিশুর এখন কিছু নেই, নেই তার নিজের মতো ভাবার, খেলা করার সময়। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা–বাবা, লুটেরা বণিকেরা মিলে শিশুর তাবৎ আনন্দ লোপাট করছে। এমনিতেই যুগটা অতিমাত্রায় যন্ত্রশাসিত। শিশুরা হচ্ছে যন্ত্রের অধম। মুখে হাসি নেই, চোখে ঘুম নেই। মিশতে চায় না কারও সঙ্গে। কাউকে তার আপনজন মনে হয় না। দ্রোহ বাসা বাঁধে মনের গহিনে। সে হিংস্র হয়ে ওঠে। অপরের প্রতি ঘৃণা জমে, সুন্দর পৃথিবীকে মনে হয় সবচেয়ে নিষ্ঠুর। শতকরা ৮০ ভাগ শিশুর বয়সই তিন বছর পেরোনোর আগে মনে তার বিষণ্নতা গেঁড়ে বসছে।

বাড়ছে কোচিং সেন্টারে সেন্টারে শিশুর দোড়াদোড়ি, নোট-গাইডের রমরমা বাণিজ্য। কিন্তু এর চেয়ে সর্বনাশা যা ঘটছে তার অনেক ভিডিও এখন ইউটিউবে ঘুরছে। শিশুর হাতেখড়ি হচ্ছে নকল আর চুরিবিদ্যায়! স্কুলের বড় কাজ শিশুকে নীতি-নৈতিকতা, শৃঙ্খলা শেখানো। এখন সারা দেশে চলছে তার উল্টোটাই। জীবন যত বিষময় হয়ে উঠছে, শিশু হচ্ছে তত বেশি আইনকানুন, রীতিনীতিবিরোধী। বাড়িতে, ক্লাসে, পরীক্ষার হলে সে এসব তালিম পাচ্ছে ,মা–বাবা, অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসকদের কাছে থেকে। সরাসরি।

পরীক্ষা হলো শিশুর অর্জিত জ্ঞানের পরিমাপের ব্যবস্থা। আধুনিককালে শিক্ষা মূল্যায়নের ধারা বদলে গেছে তামাম দুনিয়ায়। সারা বছর পরম যত্নে শিক্ষক এখন প্রতিটি শিশুর আগ্রহ, আবেগ, রুচি নজরে রাখেন, নোট রাখেন। পরম মমতায় ভুল শুধরে দেন। তাতে যে পরিবর্তন ঘটে শিশুচিত্তে, আচরণে, অভ্যাসে তার ধারাবাহিক মূল্যায়ন করেন। কিন্তু সবই ঘটে এমন এক মমতাঘেরা পরিবেশে যে শিশু বুঝতেই পারে না ওস্তাদ তার প্রতিদিন পরীক্ষা নিয়ে চলেছেন। তাই শিশুমনে পরীক্ষাভীতি বাসা বাঁধে না। এরই কেতাবি নাম ফরমাটিভ এসেসমেন্ট। পরীক্ষা হলো জুজু্ বুড়ি। সে শুধু ভয় দেখায়, আনন্দ কেড়ে নেয়, দুঃখ বাড়ায়। শিশুর সৃজনক্ষমতা নষ্ট করে। তাই সে জুজু থেকে শিশুকে সযত্নে দূরে রাখেন আধুনিক শিক্ষক। শিক্ষায় এ পরীক্ষাজুজুকে কেতাবি ভাষায় বলে সামেটিভ এসেসমেন্ট। দুনিয়া এখন তাই শিশুদের সামেটিভ এসেসমেন্ট করা হয় না, গ্রেডিং করা হয় না। বলা হয় প্রতিটি শিশুই কোনো না কোনো দিকে অন্যের চেয়ে ভালো। শিক্ষকের কাজ প্রতিটি শিশুর নিজস্বতা আবিষ্কারের চেষ্টা করা। যার যা ভালো সেটাকেই লালন করা, উৎসাহ দেওয়া, বিকশিত হওয়ার পথ করে দেওয়া।

দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর ধরে শিক্ষককে ঘিরে যে অপশিক্ষা চলছে, প্রায় ৫০ বছর গত হলো, সে ধারণার অবসান ঘটেছে। মানুষ আবার ফিরে গেছে প্রাচীন গ্রিসের শিশুপ্রেমী গুরু সক্রেটিসের কাছে। তাঁর পথই সেরা পথ বলে মেনে নিয়েছে। এখন শিক্ষার কেন্দ্রে শিশুর অবস্থান। তাকে ঘিরেই যত আয়োজন, যত চেষ্টা। এখন কোনো শিশুকে ‘সাদা স্লেট’ ভাবা হয় না। বরং এটা মানা হয় যে জন্মের পর থেকেই শিশু শিখতে শুরু করে। তার শিক্ষাদর্শন হলো, ‘বিশ্বজোড়া পাঠাশালা মোর, সবার আমি ছাত্র’। আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তির আগেই শিশু বিস্তর জ্ঞান স্কুলে নিয়ে আসে। স্কুল, শিক্ষকের কাজ সেগুলো একটি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে মালা গেঁথে নিতে সাহায্য করা। তাই সামেটিভ এসেসমেন্ট শিশুদের বেলায় কোনো কাজে লাগে না; বরং শিশুর মনে হতাশা বাড়ায়। এ যুগে তাই শিশুশিক্ষায় সামেটিভ এসেসমেন্ট অচল।

অথচ কী আশ্চর্য, শিক্ষায় লাখ লাখ জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানে সামান্য উদ্যোগ না নিয়ে আমরা শিশুবিদ্বেষী এক প্রকল্প নিয়ে হনহন করে দৌড়াচ্ছি হুড়মুড়িয়ে পড়ে মরতে! প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড করার নামে যে কোটি কোটি টাকা শ্রাদ্ধ করতে যাচ্ছি, সে টাকা শিশুদের মানবিকতা, সৃজনী ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে বরাদ্দ করা বেশি দরকার ছিল। শিশুদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো ভালো বই আমরা আজও বানাতে পারিনি। শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়ার কথা ভাবার ফুরসত নেই। কিন্তু প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার নামে লাখো কোটি টাকা লুটপাটের সদর দরজা খুলে দিতে যাচ্ছি।

মা–বাবা, অভিভাবক, শিশু বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, শিশু অধিকারকর্মী ও সংগঠনের প্রবল বিরোধিতা উপেক্ষা করে যাঁরা এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে খড়্গহস্ত, তাঁদের প্রতি আমাদের শেষ আবেদন, আমাদের শিশুদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেবেন না। এর চেয়ে জোনাথান সুইফট যেমন ইংরেজদের দরবারে তাঁর সবিনয় আরজি (এ মোডেস্ট প্রোপাজল) পেশ করেছিলেন, আমরাও সেখান থেকে কথা ধার করে বলি, ‘হে রাজশক্তি, এর চেয়ে বলুন, আমাদের প্রিয় সন্তানদের জবাই করে তা দামি মসলাপাতি দিয়ে উত্তম রান্না করে আপনাদের ভোজ টেবিলে হাজির করে দিতে। সেটা বরং এর চেয়ে কম বেদনার হবে।’ দয়া করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে আমাদের সন্তানদের মুক্তি দিন।

আমিরুল আলম খান: যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]