দাতা-নির্ভর নারী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা
২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ‘নারী-পুরুষ সমতা, রুখতে পারে সহিংসতা’ স্লোগানে ১৬ দিনের প্রচারাভিযান কর্মসূচি। একে বলা হচ্ছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ। চলবে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন এনজিও এবং নারী সংগঠনগুলো একজোট হয়ে এই পক্ষ পালন করে আসছে। এই পক্ষ পালনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিগুলোর একটি হলো, মাঠ পর্যায়ে আন্দোলন–তৎপরতা তথা মানবন্ধন, মিছিল, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন, আলোচনা সভা ইত্যাদি।
শুধু এই পক্ষ ধরেই নয়, এ দেশে নানা ধরনের নারী নির্যাতন ঘটলে অনেকেই মানববন্ধনসহ অনেক ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো অনুদাননির্ভর। এখন কথা হলো, এই প্রতিবাদ তৎপরতা কি নারী নিপীড়ন বন্ধের বেলায় খুব বেশি প্রভাব ফেলছে? পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৩৩০ জন নারী এবং ১ হাজার ১ জন শিশু।
সম্ভবত প্রভাব আশানুরূপ না। সম্ভাব্য প্রধান কারণটি হলো ঠিক বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়ার যে কর্মসূচি, সেখান থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে সরকার আর এনজিওগুলো। নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ডের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি পরিচালনা করা এবং সেটির বেশির ভাগই দাতাগোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণেই এর বাইরে এনজিওরা কিছু করতে পারে না। কর্মসূচিগুলোর বেশির ভাগই ‘টপ-ডাউন’ অর্থাৎ ওপর থেকে নিচের দিকে করা হয়। তাই হয়তো আসলে লৈঙ্গিক সমতার ক্ষেত্রে যে ধরনের কর্মসূচি অঞ্চলভিত্তিক, সংস্কৃতিভিত্তিক কিংবা শ্রেণিভিত্তিক নেওয়ার কথা, সেগুলো সেসব অবস্থান থেকে নেওয়া সবসময় সম্ভব হয় না। আমরা আমাদের মতো করে উন্নয়ন কিংবা লৈঙ্গিক সমতার প্রকল্প বানাই, সেখানে হয়তো জনগণ কী রকম করে চাচ্ছে, সেটা খুব কমই গুরুত্ব পায়।
দ্বিতীয়ত ১৬দিন ধরে যে কর্মসূচি আগামী ১০ তারিখ পর্যন্ত হবে, সেটি কীভাবে করা হবে, তার ছক কষতে আমরা কী সেই স্থানীয় (যারা কর্মসূচির আওতাধীন) লোকজনের মতামত কিংবা তাঁদের এই পরিকল্পনায় রেখেছিলাম? আমাদের হয়তো মনে হয় আমরা যা পরিকল্পনা করি সেটিতে তারা অংশ নেবেন। অনেকেই এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু অংশগ্রহণ করেন কজন। আবার বেশি উপস্থিতি কখনো অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে না। যেমন নারী দিবসের অনুষ্ঠানেও অনেক শ্রেণি-পেশার নারীদের উপস্থিতি থাকে, কিন্তু মঞ্চে থাকেন পরিচিত নারী নেত্রী এবং এনজিওর কর্ণধারেরা। কারণ তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই অনুষ্ঠানগুলো হয়। এ ধরনের অনুষ্ঠানে খুব কমই দরিদ্র, সমাজের একেবারেই তলানিতে থাকে নারীদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। কথা বলেন মাত্র মুখচেনা কয়েকজন।
অথচ চিত্রটা যদি উল্টো হতো, কী এমন সমস্যা হতো? যেসব নারী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন তাঁদের যদি বাল্যবিবাহের সমস্যাগুলো বলতে বলা হতো, তাহলে মনে হয় লৈঙ্গিক সমতার স্লোগানগুলো শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকত না। নিপীড়নের শিকার যাঁরা, তাঁদের আমরা সহানুভূতির চোখেই দেখি কিন্তু তাঁকে তাঁর অভিজ্ঞতার বয়ান দেওয়ার জন্য তৈরি করি না। আমরা নিজেরাই সবকিছু নিয়ে কথা বলতে চাই।
শেষত; এ ধরনের কর্মসূচির সফলতা কতটুকু, তা মূল্যায়ন করা হয় কি না? কেন কর্মসূচিগুলো সবার কাছে পৌঁছায় না, সেগুলো নিয়ে আমাদের কোনো বোঝাপড়া আছে কি না? বাংলাদেশে এনজিওগুলো এবং সরকার এই বিষয়ে যত কাজ করে, সেই হিসাবে নারীর প্রতি সহিংসতা কমে যাওয়ার কথা অনেকখানিই। কিন্তু তা হচ্ছে না।
কারণ এখনো মানুষ নারী নিপীড়নকে নারীর বিষয় বলে মনে করে। তাই নারী নিপীড়নের ক্ষেত্রে, কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে নারী-শিশু নিপীড়ন মোকাবিলা করার জন্য নারীকে যতটা পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতন করা হচ্ছে, পুরুষকে সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না এবং এগুলোকে রাজনৈতিকভাবে দেখার চেষ্টাও খুবই সীমিত পরিসরেই হয়।
অন্যদিকে লৈঙ্গিক সমতার প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত নারী-পুরুষ বিভাজিত অবস্থার মধ্যেই আছে। এর বাইরে যাঁরা আছেন, তারা কীভাবে নারী এবং পুরুষ উভয় লিঙ্গের মানুষদের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, সেটিও এখনো এই সমতার কর্মসূচির আওতায় আসেনি। কারণ দাতাদের মনোযোগ এখনো সেখানে যায়নি। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন দাতা–নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে খুব বেশি আশা করার জায়গা সত্যিই হয়তো নেই।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]