২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

জুয়ার আর্থিক ও সামাজিক লাভ-ক্ষতি

বৈধভাবে লাভজনক ক্যাসিনো ব্যবসার অন্যতম দৃষ্টান্ত কম্বোডিয়া
বৈধভাবে লাভজনক ক্যাসিনো ব্যবসার অন্যতম দৃষ্টান্ত কম্বোডিয়া
>

সাম্প্রতিক ক্যাসিনো-কাণ্ড দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ দেশে আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ ক্যাসিনো গড়ে উঠেছে, তা প্রায় অজানা ছিল। বিশ্বের অনেক দেশে ক্যাসিনো বৈধ, কিন্তু বাংলাদেশে পুরোপুরি অবৈধ। সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী লোকের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন ক্লাবে গড়ে ওঠা ক্যাসিনোগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করেছে। আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ ক্যাসিনো। আবার মানবসভ্যতার বিকাশের শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে জুয়া বা ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা লক্ষণীয়। ‘জুয়া, আধুনিক পুঁজিবাদ ও রাষ্ট্র: ঝুঁকিপূর্ণ সমাজমুখী যাত্রা’ শিরোনামের একটি লেখার তিন পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে আজ। লিখেছেন কথাসাহিত্যিক ও যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক আফসানা বেগম

মুসলিম দেশে জুয়া
(বাকি অংশ)

মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলোতে ক্যাসিনো আইনত বৈধ, সেসব জায়গায় স্পোর্টস খাতে যত আয় হয়, তার মোটামুটি ৮০ শতাংশ আয় হয় জুয়া থেকে। এ ছাড়া ইরাক ও আরব আমিরাতে বৈধ এবং অবৈধভাবে ঘোড়দৌড়ের সংস্কৃতি আছে। আরব আমিরাতে আইনত জুয়া এবং ক্যাসিনো, এমনকি অনলাইন জুয়াও নিষিদ্ধ। কিন্তু জুয়া খেলা হয় এবং ধরা পড়লে তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে, প্রচুর অনলাইন জুয়ার সাইটও উন্মুক্ত দেখতে পাওয়া যায়। তায়েফ ও মক্কায় অবশ্য বৈধ ঘোড়দৌড়ের চল আছে। আরব আমিরাতে ফুটবল ম্যাচেও বাজি ধরার চল আছে। তবে জুয়ার ব্যাপারে আইনের কড়াকড়ির কথা যেমন সবাই জানে, এ-ও জানে যে এত কিছুর পরেও সেখানে প্রচুর জুয়ার আড্ডা পরিচালিত হয়।

এ বছর এপ্রিলের শুরুর দিকে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সৌদি আরবের একটি ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। ছবিতে দেখা গেছে বিশাল হলঘরে অসংখ্য গোলটেবিলে ঐতিহ্যবাহী আরবীয় টিউনিক পরিহিত মানুষেরা বসে তাস খেলছে। গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ছবিটি ছড়িয়ে বলা হয়েছিল যে আরবে প্রথম ক্যাসিনো উদ্বোধন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেটা কোনো ক্যাসিনো বা জুয়ার দৃশ্য ছিল না। রিয়াদে ৪ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিলোট টুর্নামেন্টের দৃশ্য ছিল সেটি। বিলোট খেলার টুর্নামেন্টটি আরব সরকার বছরে একবার আয়োজন করে থাকে। এই আয়োজনে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা যোগ দেয়। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিসহ এই খেলা জাতিগতভাবে তাদের কাছে জনপ্রিয়। এই খেলায় বাজি ধরা হয় না বরং উপস্থিত বুদ্ধির পরীক্ষা হয়। ফুটবল বা ক্রিকেট বা অন্য যেকোনো খেলার ম্যাচের মতোই খেলার শেষে জিতে যাওয়া ব্যক্তিরা পুরস্কৃত হয়। দেশটির জুয়াবিরোধী আইন শুধু তাদের নিজের দেশের অধিবাসীদের জন্যই প্রযোজ্য নয়, বিদেশিদের জন্যও প্রযোজ্য। ২০১৩ ও ২০১৫ সালের দুটো পৃথক ঘটনায় ১৮ থেকে ২০ জন বাংলাদেশিকে নিজের বাড়িতে জুয়ার আড্ডা বসানোর দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

প্রতিবেশী দেশে ক্যাসিনো ব্যবসা

সিকিম, দমন ও গোয়া ছাড়া ভারতের বাকি অংশে ক্যাসিনো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, জুয়া রাজ্য সরকারের বিষয়। তাই বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকমের আইন রয়েছে। ১৮৬৭ সালের আইনটি বিলোপ না হলেও তা অচল, কারণ আইনটি একটি কেন্দ্রীয় আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী কার্যকর নয়। জুয়ায় অংশ নিলে ১০০ রুপি জরিমানা ও এক মাস জেল এবং আয়োজন করলে ২০০ রুপি জরিমানা ও তিন মাসের শাস্তির বিধান রয়েছে। ভারতে প্রথম ক্যাসিনো স্থাপিত হয় গোয়ায়। সমুদ্রের ওপরে ভাসমান ক্যাসিনোগুলো তখন থেকেই পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। ২০১৩ সালে শুধু গোয়ার ক্যাসিনোগুলো ১৩৫ কোটি রুপি আয় করে। তবে ভারতে নির্দিষ্ট কিছু লটারি ও ঘোড়দৌড় ছাড়া বাকি সব রকমের জুয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। মহারাষ্ট্র ছাড়া ভারতের বাকি অংশে অনলাইন জুয়ার প্রচলন রয়েছে। ভারতে জুয়া থেকে আয় করা অর্থের ৩০ শতাংশ হিসাবে পরিশোধ করতে হয়। দেশের বেশির ভাগ অংশে জুয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও হোলি এবং দীপাবলি-জাতীয় উৎসবের আগে-পরে শত শত ক্যাসিনো ও জুয়ার আড্ডা গজিয়ে যায়। ওই রকম সময়ে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, বিহার, ঝাড়খন্ড ইত্যাদি এলাকায় ঘন ঘন হামলার মাধ্যমে পুলিশকে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়।

লক্ষণীয়, বছর বছর এত ধরপাকড়ের পরও ১৮৬৭ সালের অর্থদণ্ডের পরিমাণ এবং আইনের ভাষা এখনো সেখানে অপরিবর্তিত আছে। দেশটিতে বুদ্ধিজীবী ও সমাজবিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত আইনটি সংশোধনের কথা বলে আসছেন। তাঁরা সম্মিলিতভাবে আইন ও নীতিমালার আওতায় ক্যাসিনো প্রচলনের কথা বলছেন। তাঁরা মনে করেন, নীতি নির্ধারণ করে বৈধ ক্যাসিনো প্রচলনের মাধ্যমে ভারতে মাফিয়া ও ডনদের হাতে পরিচালিত অবৈধ ক্যাসিনো বন্ধ করা সম্ভব।

ইসলামি আইনের সঙ্গে সংবিধানের সরাসরি সম্পর্ক আছে, এ রকম মুসলিম দেশ পাকিস্তান। পাকিস্তানে তাই ক্যাসিনো, স্পোর্টস বেটিং, পোকার, লটারি ও অনলাইন বেটিং—সব ধরনের বাজি ধরার খেলাই নিষিদ্ধ। তবে পাকিস্তানে বৈধভাবে চারটি এলাকায় ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হয়। তাদের সংস্কৃতিতে একে জুয়া হিসেবে ভাবা হয় না এবং বাজি ধরার এই খেলা সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়। গোপনে বহু ক্যাসিনো ও অনলাইন গেমিং সাইট সেখানে প্রতিনিয়ত কার্যকলাপ চালাচ্ছে। পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এসব ভেঙে দিলেও আরেক দিকে গজিয়ে উঠছে। দেশটিতে ব্রিটিশ আমলের আইন কিছুটা পরিবর্তন করে জুয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য এক হাজার রুপি জরিমানা এবং সঙ্গে পাঁচ বছরের কারাভোগের আইন হয়েছে।

নেপালে যেহেতু পর্যটকদের জন্য ক্যাসিনো বরাবর উন্মুক্ত ও বৈধ, তাই জুয়াসংক্রান্ত সমস্যা এবং আইনকানুনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সেখানে প্রতিনিয়ত ঘটে। বহু বছর টানা চলার পর ২০১৪ সালে প্রচুর পরিমাণে কর বাকি পড়ায় ক্যাসিনো কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল। এতে পর্যটকের সংখ্যা কমে গেলে ২০১৫ সালে আবারও ৮টি ক্যাসিনো চালু হয়েছে। নেপালে শুরু থেকেই অনলাইন বেটিংয়ের ওপরে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে কিছু ব্যাংক নানা রকম অব্যবস্থা ও অসংগতির কারণে অনলাইন গেমিং সাইটের অর্থ লেনদেন করতে অপারগতা জানায়।

জুয়ায় আর্থিক ও সামাজিক লাভ

ব্যক্তির জায়গা থেকে চিন্তা করলে ক্যাসিনোর জুয়ায় লাভ অনেক। জুয়ায় অংশগ্রহণ বা আয়ের ক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই, সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, পরিশ্রম বলতেও তেমন কিছুই লাগে না। অর্থাৎ, কোনো কঠিন নিয়মের মধ্যে না গিয়েই ব্যক্তি অঢেল অর্থ আয় করতে পারে। তবে সাধারণ ব্যবসায় মানুষ যেমন লগ্নি করা টাকার একটা শতাংশ হিসাবে লাভ করে, জুয়ায় ঠিক তা নয়। এখানে লাভ হয় দ্বিগুণ, তিন গুণ বা চার গুণ হিসাবে। আবার একই টাকা জুয়ায় একই আসরে বহুবার লগ্নি করা সম্ভব। এখানে অর্থ উপার্জন যেন কোনো কাজ নয়, কেবলই খেলা আর আনন্দ এবং বিশ্রাম। বলতে গেলে খেলাচ্ছলে আয়। যেকোনো ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে একই রকম ব্যবসা বছরের পর বছর তাকে একঘেয়েমিতে ফেলতে পারে, কিন্তু ক্যাসিনোর পরিবেশে সে একেক দিন একেক রকমের খেলায় অভিনবত্বের স্বাদ পেতে পারে। ক্যাসিনোর পরিবেশ কারও কারও জন্য পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। কখনো দেখা যায় ক্রমাগত জিততে জিততে জেতাই কারও কারও ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে।

সরকারের অবস্থান থেকে ভাবলে, বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক ক্যাসিনোর মাধ্যমে সরকার পর্যটকদের দ্রুত আকর্ষণ করতে পারে। বেশি পর্যটক মানেই বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়। সরকার ক্যাসিনো থেকে সরাসরি এবং জুয়ায় জেতা অর্থের ওপর কর ধার্য করে আয় করতে পারে। আইনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সফলভাবে চালানো ক্যাসিনো একটি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে। জুয়ায় লগ্নি বেশি হলে সরকারের আয়ও বাড়বে।

জুয়ায় আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি

ব্যক্তির অবস্থান থেকে ভাবলে জুয়ার নেশায় একজন মুহূর্তের মধ্যে ধনসম্পদ হারিয়ে দেউলিয়া পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। যেহেতু খেলাচ্ছলে আয় এবং ক্ষতি হয়ে থাকে, তাই কখন কোনটা বেশি হয়ে যায়, তা চট করে ধরা যায় না। গেম থিওরির সফল ব্যবহারের কারণে কোনো জুয়াড়ির পক্ষে ক্রমাগত জিতে যাওয়া সম্ভব নয়। এ রকম ক্ষেত্রে কিংবা ক্রমাগত হার স্বীকার করে দেউলিয়া হলে মানুষ হতাশায় পড়ে। ক্রমেই সে বিষণ্নতায় ভোগে এবং পরিবারে অশান্তির সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত কেউ কেউ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। দেখা যায়, আমেরিকার নেভাদায় আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে জুয়া খেলতে যেহেতু বিদ্যা-বুদ্ধির দরকার হয় না, তাই যে কেউ এই নেশায় জড়িয়ে পড়তে পারে। নিয়মিত জুয়ায় অংশগ্রহণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেশার উদ্রেক করে; হারলে হারানো অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা এবং জিতলে আরও বেশি অর্থ উপার্জনের উৎসাহ, এই চক্রের কোনো শেষ নেই।

রাষ্ট্র বা সরকারের অবস্থান থেকে ভাবলে, ক্যাসিনোর মাধ্যমে একই স্থানে অল্প সময়ের মধ্যে এত টাকার লেনদেনের কারণে অপরাধ বেড়ে যেতে পারে। নানা রকমের প্রতারণা, আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাংয়ের উদ্ভব, বিভিন্ন রকমের অরাজকতার সৃষ্টি হতে পারে। ক্যাসিনোর মতো ব্যবসার মাধ্যমে ধনীদের আরও ধনী হতে সাহায্য করা হয়, যা সম্পদে বৈষম্য আছে এমন একটি দেশে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্যাসিনোনির্ভর শহরের দিকে তাকালে দেখা যায়, ক্যাসিনোয় এবং আশপাশের এলাকায় মাদক, অস্ত্র ও দেহব্যবসার বৃদ্ধি ঘটে। আইনকানুন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

কেস স্টাডি—কম্বোডিয়া

ক্যাসিনোর থাকা না-থাকার যুক্তি এবং লাভ-ক্ষতিবিষয়ক আলোচনায় কম্বোডিয়ার ঘটনা পর্যালোচনা করা যায়। ১৯৯০ সালের আগে কম্বোডিয়ায় কোনো ক্যাসিনো ছিল না। কম্বোডিয়ার একদিকে কমিউনিস্ট দেশ ভিয়েতনাম ও লাওস, আরেক দিকে বৌদ্ধধর্মের দেশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার। এই দেশগুলোতে ক্যাসিনো ব্যবসা বৈধ নয়। কম্বোডিয়া ক্যাসিনো বৈধ ঘোষণার মাধ্যমে এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছিল। চারদিকের সীমান্ত এলাকার শহরগুলোতে তারা একের পর এক ক্যাসিনো নির্মাণ করতে থাকে। ক্যাসিনো ব্যবসায় অংশ নেওয়ার জন্য চীনের ব্যবসায়ীদেরও আহ্বান জানায়। সীমানা পেরিয়ে যেন মানুষ সহজে ক্যাসিনোয় জুয়া খেলে আবার নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে পারে, তাই সীমান্তের দেশগুলোর জন্য সরকার ভিসার বাধ্যবাধকতাও উঠিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে রাজধানীর ২০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে আরও ক্যাসিনো গড়ে তোলা এবং উড়োজাহাজ ভাড়া করে চীন থেকে ধনী জুয়াড়িদের নিয়ে এসে খেলার ব্যবস্থা করা হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই পর্যটন খাতে কম্বোডিয়ার আয় হু হু করে বাড়তে থাকে, গত ২০ বছরে যা ১০ গুণ বেড়েছে। শুধু ক্যাসিনো থেকে ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সরকারের আয় হয়েছে যথাক্রমে ২০ মিলিয়ন, ২৫ মিলিয়ন ও ২৯ মিলিয়ন ইউএস ডলার। বর্তমানেও আয় ঊর্ধ্বমুখী।

কম্বোডিয়ার সরকার আইন করে নিজেদের অধিবাসীদের জন্য ক্যাসিনো নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু দ্বিতীয় পাসপোর্ট থাকার সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ ক্যাসিনোতে প্রবেশ করে। কম্বোডিয়ার জনগণের মধ্যে অনেক আগে থেকেই জুয়ার সংস্কৃতি ছিল। তারা স্বভাবগতভাবেই যেকোনো কিছু নিয়ে বাজি ধরতে পছন্দ করে। ‘বৃষ্টি হবে কি না’—এ রকম বিষয়ে এক হাজার ইউএস ডলার বাজি ধরার ঘটনা সেখানে ঘটেছে। তাই ক্যাসিনোতে না গেলেও সারা দেশে লটারি থেকে শুরু করে নানা রকমের রেস ও জুয়ার আসর আছে। তবে সরকার কোনো অবৈধ ক্যাসিনো গড়ে উঠতে দেয় না। প্রবেশ করতে না পারলেও দেশে ক্যাসিনোর বৈধতার সংস্কৃতি তাদের জীবনযাপনে প্রভাব ফেলে। জুয়া খেলেনি, এ রকম পুরুষের মনোবল নিয়ে তারা সন্দেহ করে। ছোটখাটো জুয়ায় অংশ নিতে নিতে এবং সুযোগ পেলে দ্বিতীয় পাসপোর্ট দেখিয়ে ক্যাসিনোয় প্রবেশ করার অভ্যাস রেখে তরুণ এবং মধ্যবয়সী প্রজন্মের বহু মানুষ জুয়ায় আসক্ত হয়ে গেছে। এতে পারিবারিক সমস্যা ও আত্মহত্যার হার বেড়েছে। দেশজুড়ে জুয়ার আসক্ত মানুষ থাকতেও তারা একে চিকিৎসাযোগ্য কোনো সমস্যা মনে করে না, বরং সামাজিক নিয়ম বলে ধরে নেয়। ২০১২ সালে একবার দেশব্যাপী মানসিক সমস্যাজনিত রোগের চিকিৎসার ক্যাম্পেইন হয়েছিল। সেখানে হতাশা ও মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত প্রচুর মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে কিন্তু সারা দেশে জুয়ায় আসক্ত একজন মানুষেরও চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

চীনা ব্যবসায়ীরা কম্বোডিয়ার ক্যাসিনোগুলোতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ লগ্নি করেছে। যেহেতু মেইনল্যান্ড চায়নায় ক্যাসিনো নিষিদ্ধ, তাই তারা বহু বছর ধরে ম্যাকাওতে বৈধভাবে লাভজনক ক্যাসিনো ব্যবসা করে আসছে। চীনের ব্যবসায়ীরা হংকংয়ের নিয়মনীতির কারণে সেখানে দীর্ঘদিন ক্যাসিনো ব্যবসা করতে পারে না। কিন্তু ইদানীং ফিলিপাইন, কম্বোডিয়ায় সফলভাবে ব্যবসা করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কম্বোডিয়াকে তারা দ্বিতীয় ম্যাকাও হিসেবে গড়ে তুলবে অচিরেই। ২০১৮ সালে কিছু চীনা ব্যবসায়ী ক্যাসিনো নির্মাণের উদ্দেশ্যে কম্বোডিয়ার বিশাল এলাকা কিনতে চেয়েছিল; এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপও ছিল। কিন্তু চীন, যার কাছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ক্রমাগত জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, কম্বোডিয়া সেখানে শক্ত অবস্থানে থেকেছে। তারা ক্যাসিনোর জন্য জমি বিক্রি করতে রাজি হয়নি।

সীমানার দিকে সমুদ্রের কাছাকাছি ক্যাসিনোগুলো অবস্থিত বলে চীনা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সমুদ্রের তীর তথা পরিবেশদূষণের অভিযোগ আছে। এই অভিযোগে এ বছরের শুরুর দিকে দুটো ক্যাসিনো বন্ধও করে দেয় কম্বোডিয়ার সরকার। এরই মধ্যে জুলাই মাসে এক প্রভাবশালী চীনা কোম্পানি ১ হাজার ৬০০ টন পরিবর্তনযোগ্য ব্যবহৃত প্লাস্টিকের চালান কম্বোডিয়ার বন্দরে পাঠায়। পরিবেশবাদীরা তখন থেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে। গত বছর চীনা সরকার ব্যবহৃত প্লাস্টিক আমদানি নিষিদ্ধ করার পরে সারা পৃথিবীতে এর প্রভাব পড়ে। রিসাইকেলেবল প্লাস্টিকের কারখানা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থাপনের জন্য তাই চীনা কোম্পানিগুলো এখন তৎপর। মালয়েশিয়ায় বড় ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত চীনা কোম্পানিও এ বছর জুন মাসে পেনাং বন্দরে তিন হাজার টন ব্যবহৃত প্লাস্টিক আমদানি করেছিল। মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়া, দুটো দেশের পরিবেশবাদীদের চাপে এবং সরকারি উদ্যোগে প্লাস্টিকের চালান ফেরত পাঠানো হয়েছে। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত এ ধরনের নানা সমস্যা কম্বোডিয়া প্রতিনিয়ত ঠেকালেও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন শিল্প বন্ধের ঘটনা, নিজের দেশে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি, জুয়ার আসক্তির মাধ্যমে সমাজে অবক্ষয় সৃষ্টি ঠেকাতে পারছে না।

শেষ কথা

সব প্রতিকূলতার মধ্যে সরকার, ব্যবসায়ী, অংশগ্রহণকারী জুয়াড়ি যদি নিয়মনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তবে বৈধভাবে একটি দেশ লাভজনকভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতে পারে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা কম্বোডিয়া তা করে দেখিয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে এমনিতেই দুর্নীতির মাধ্যমে ধনীর সম্পদ বৃদ্ধির হার পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের চেয়েও বেশি, অর্থনৈতিক বৈষম্য যেখানে সমাজকে বিপজ্জনক করে তুলছে, সর্বোপরি যেখানে বিচারব্যবস্থা ও আইনের প্রয়োগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সেখানে বৈধভাবে ক্যাসিনোর মতো ব্যবসা কতটুকু সুফল বয়ে আনবে বা সামাজিক অবক্ষয় বাড়িয়ে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে নতুন করে কতটা ধস নামাবে, তা ভাবার বিষয়। অন্যদিকে, সমাজ পরিবর্তনের ধাপে এ রকম ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা বা অস্তিত্ব অস্বীকার করারও উপায় নেই।

সরকারের পরিকল্পনায় কোনো পর্যায়ে ভবিষ্যতে বৈধ ক্যাসিনো নির্মাণের পদক্ষেপ থাকলে থাকতেও পারে। তারা কেবল পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে হয়তো ব্যবসাটি চালু করে দেখতে চাইতে পারে। সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে এমন বক্তব্য শোনা গেছে। সে ক্ষেত্রে, রাতারাতি প্রচুর ব্যবসা গড়ে ওঠা রোধ করার জন্য সরকার ব্যবসায়িক লাইসেন্সের অত্যন্ত উচ্চ হার নির্ধারণ করতে পারে, যা সরকারের আয় বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। দেশের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার উদ্দেশ্যে উচ্চ হারের কর আরোপ এবং প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট জাতীয়তা ও বয়স নির্ধারণ করে দিতে পারে। ক্যাসিনোর আশপাশের এলাকাকে কেমন করে সুরক্ষা দেওয়া যায়, সেটি নিয়েও সরকারের দীর্ঘ পরিকল্পনা থাকতে পারে। সবচেয়ে আগে যা প্রয়োজন পড়বে তা হলো ক্যাসিনো–সম্পর্কিত নীতিমালা নির্ধারণ, নতুন আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। শিল্পের অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের আগ্রহকে যেহেতু আশীর্বাদ মনে করা হয়, তাই স্বাভাবিকভাবে তাদের আহ্বান জানানো হবে। তখন চায়নিজ এমনকি ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও লাভের আশায় ক্যাসিনো নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে, সে ক্ষেত্রে নিয়মনীতি নির্ধারণে কম্বোডিয়ার মতো শক্ত অবস্থানে থাকার মানসিকতা এবং সত্যিকারের সামর্থ্য থাকা নিতান্ত প্রয়োজন। সরকারকে যেহেতু অনেক দূরদর্শী হতে হয়, তাই নীতিনির্ধারকেরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আগেপিছে না ভেবে জুয়ার মতো ঝুঁকির চাল দেবে না বলে আশা করা যায়।             

যাহোক, জুয়াবিরোধী অভিযানের কারণে ইতিমধ্যে প্রাচীন ও প্রয়োগ অযোগ্য আইনের উপস্থিতির বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। প্রয়োজনীয় আইনের অনুপস্থিতিতে মাদক, অর্থ পাচার এবং অস্ত্র আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। জুয়ার সরঞ্জাম আমদানি ও ব্যবসার বিস্তার সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে করা হয়েছে। এসব অসংগতি সত্ত্বেও যেকোনো ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ প্রশংসনীয়, যদি তা সত্যিকার অর্থে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। প্রশ্ন আসতে পারে, জুয়াবিরোধী অভিযান কি সত্যিকার অর্থে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান? জুয়া যদি দুর্নীতি হতো, তবে এই অভিযানের দায়িত্বে থাকা উচিত ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সিংহভাগ গণমাধ্যম, সরকার এবং বুদ্ধিজীবীদের একাংশ একযোগে একে দুর্নীতি দমন অভিযান হিসেবে আখ্যায়িত করছে। গোটাকতক ব্যবহৃত মদের বোতল, কিছু টাকার বান্ডিল আর দু-চারটা রুলেট বা তাসের ছবি পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখলে সরল চিন্তাধারার জনগণের মনে দুর্নীতির খনি আবিষ্কৃত হয়েছে বলে ভ্রম হতে পারে। অন্যদিকে, দুর্নীতির উচ্চ হারের জন্য বিখ্যাত একটি দেশে ক্রমাগত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলতে থাকবে তা অত্যন্ত যুক্তিসংগত এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু বর্তমান পদক্ষেপ প্রচারণার কায়দায় ভিন্ন খাতের বিষয়কে ব্যবহার করে জনগণকে চমকিত বা প্রলুব্ধ করে কিছুদিনের জন্য জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে সংঘটিত বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে, জুয়ার আইন দ্রুত সংস্কারের বিষয়টি এখানে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, যা অভিযানটিকে সার্থকতা দিতে পারে।

বস্তুত, পুঁজিবাদী সমাজ সময়ের সঙ্গে সমাজ নিজেই তার কার্যকলাপ, প্রয়োজন এবং যেকোনো পণ্যের টিকে থাকা না-থাকা নির্ধারণ করে। এবং ক্রমে নতুন চাহিদা এবং নব্য পুঁজিবাদী শ্রেণির উদ্ভব হয়। কেবল এটুকু আশা করা চলে যে ঝুঁকিকেন্দ্রিক চাহিদা যেহেতু সমাজে বাড়ছে, তাই মানুষ আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঝুঁকিকে কাজে লাগিয়ে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আনবে।[ শেষ ]

আফসানা বেগম: কথাসাহিত্যিক ও যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক