এটা সবারই জানা যে ভূমি সমস্যা নিয়ে দেশের মানুষকে চরম দুর্ভোগ ও কষ্ট পোহাতে হয়। ভূমির মালিকানা আছে এমন ব্যক্তি বা পরিবার খুব কমই পাওয়া যাবে যঁারা ভূমিসংক্রান্ত সমস্যা থেকে একেবারেই মুক্ত। নতুন আইন ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানির কারণে দেশের ভূমি জরিপ বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একটা বন্ধ্যত্ব চলছে। ২০০৪ সালে যে সংকটের সূচনা হয়েছে, তার সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও ২০০৪ সালের শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি।
২০০৪ সালের আইন অনুযায়ী ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় এবং প্রয়োজনের তুলনায় এর সংখ্যা খুবই কম। এসব ট্রাইব্যুনালে তিন লাখ মামলা ঝুলছে। মামলা ঝুলে থাকা বাংলাদেশে বিচিত্র নয়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ৩৫ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। কিন্তু এর মধ্যে ভূমি জরিপসংক্রান্ত তিন লাখ মামলার অবস্থা সবচেয়ে করুণ। কারণ, অন্য মামলাগুলোর ক্ষেত্রে বেশির ভাগই একটি বা দুটি স্তরের আপিল অতিক্রম করেছে। কিছু মামলার নিষ্পত্তি ঘটেছে। কিন্তু ভূমি জরিপ মামলার কোনো তুলনা নেই। ২০০৪ সালের আইনেই সারা দেশে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান ছিল। কিন্তু বিস্ময়কর বাস্তবতা হচ্ছে রাষ্ট্র সেই আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করেনি। এ কারণে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো ১৫ বছর ধরে শুধু পদ্ধতিগত কারণে অমীমাংসিত থেকে গেছে। আইনে আপিলের বিধান থাকায় সরকারি কর্মকর্তারাও রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হননি। ভূমি জরিপের হালনাগাদ ইতিহাসে বারবার ঘটেছে। কিন্তু এ রকম একটি অচলাবস্থা অশ্রুতপূর্ব।
আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শেষ পর্যন্ত যে বিষয়টির দিকে নজর দিয়েছে, এটাকেই ঢের মানতে হচ্ছে। আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংসদের আগামী অধিবেশনেই আইন সংশোধন করা হবে। এর ফলে সহকারী জজ ও সিনিয়র জজরাও বিচারকাজ পরিচালনার এখতিয়ার পাবেন। বর্তমানে সারা দেশে ৪১টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। যুগ্ম জেলা জজরা তঁাদের নিয়মিত কাজের অতিরিক্ত হিসেবে এই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র। এ কারণে বিচারাধীন মামলার শুনানিই শেষ হচ্ছে না। একটি তারিখ থেকে পরের শুনানির তারিখের মধ্যে ছয় মাস থেকে এক বছরের বিরতি দিতে হচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে ভূমির জরিপ সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মূলত এর ওপরেই ভূমির প্রকৃত মালিকানা নির্ধারণের মতো সংবেদনশীল বিষয়টি নির্ভরশীল। এ রকম একটি ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে এত দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আইন ও বিচারমন্ত্রী এর আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আইন সংশোধন প্রশ্নে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টির রফা করতেই এক ডজন বারের বেশি তঁারা বৈঠক করেছেন। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে তাঁরা নিস্তার পাননি। এ ব্যাপারে সম্প্রতি অবসরে যাওয়া ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সচিব প্রথম আলোর কাছে যে মতামত দিয়েছেন, তাকেও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী আইনে সংশোধনী এলেই ভূমি জরিপ মামলার গতি আসবে—এমনটি তিনি মনে করেন না।
আমরা মনে করি, এ রকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ আইনের খসড়া নিয়ে স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ করা খুব দরকারি। অংশীজনদের আড়ালে রেখে বিষয়টিকে কেবলই কর্মকর্তাদের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখার নীতি কতটা সুফল দেবে, সে বিষয়ে আমরা সংশয়মুক্ত নই। আইনটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের। এ বিষয়ে ভূমিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের তরফে কোনো সাড়াশব্দ নেই। আশা করব, এই আইনের সংশোধনী পাসের আগে ভূমিমন্ত্রী একটি পরিষ্কার বিবৃতি দেবেন এবং জনমত যাচাই করার সুযোগকে পাশ কাটানো হবে না।