বইয়ের দাম নাকি বেড়ে যাবে
‘মিথ্যা যখন পুরো পৃথিবীর অর্ধেকটা ঘুরে ফেলছে, সত্য ততক্ষণে প্যান্টটাও পুরো পরতে পারেনি।’ —উইন্সটন চার্চিল
শুনেছেন কিছু! ভাবি, শুনেছেন, বাংলা গল্পের বই নাকি আর পাওয়া যাবে না! হ্যাঁ। আপনার ভাই বলছিল। দেশে বাংলা বইয়ের চাহিদা নাকি ৪০ লাখ টন। গত বছর বইমেলায় বৃষ্টি হওয়ায় আর বইমেলার আগে কাগজের সংকট দেখা দেওয়ায় নাকি মাত্র ২২ লাখ টন বই উৎপাদিত হয়েছে। এদিকে ইন্ডিয়াতেও বইয়ের উৎপাদন গেছে কমে আর ওরা বই কেনা, বই পড়া বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। ফলে ইন্ডিয়া নাকি ঠিক করেছে, বাংলাদেশে কোনো বাংলা বই ঢুকতে দেবে না। আর এফবিআই নাকি বাংলাদেশকে বলে দিয়েছে, পাইরেটেড বই বিক্রি করতে পারবে না।
বলেন কী? এখন কী হবে!
কাল থেকেই নাকি বাংলা বইয়ের দাম খুব বেড়ে যাবে। সুযোগ বুঝে একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ফেলেছেন। তাঁরা নাকি যে প্রকাশকের যত বই ছিল, কিনে গুদামে স্টক করে রাখছেন। কাল তো আপনার ভাই বাংলাবাজারে গিয়ে দেখে বই নেই!
সবচেয়ে বেশি লাভ নাকি হবে কবিতার বই স্টক করতে পারলে। কালকে তো আমি আজিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে দেখি, শামসুর রাহমানের মাত্র দুইটা বই। সঙ্গে সঙ্গে ৩৫০ টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম। একটু পরে আরেকজন এল। দোকানি বলে, নাই। অনেক খুঁজে সৈয়দ শামসুল হকের একটা বই পাওয়া গেল। ১২০ টাকার বই চায় ৬০০ টাকা। শেষে ৫০০ টাকায় কিনে নিয়ে গেল। ধরেন ডিসেম্বর পর্যন্ত রাখতে পারলেই নাকি এটার দাম উঠবে ২০০০ টাকা কমসে কম। ভাবি, লবণ খেয়ে কী হবে? প্রতিদিন ৬ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ৬ গ্রাম লবণ তো আমাদের খাবার পানি, মাছ-শাকেই আছে। কিনে খাওয়ার দরকার কী। কিন্তু ধরেন একটা কবিতার বই কিনলাম। কিনে দশটা কবিতা মুখস্থ করে ফেলব। দুইটা আবৃত্তি করে ইউটিউবে দেব। তারপর ডিসেম্বর মাসে বিক্রি করে দেব। কত লাভ হবে বলেন। এখন তো সবাই বলছে, লবণটা ছিল পুরাই গুজব। গুজবে পড়ে বাঙালি বিষ কিনল। আজকে বলুক, কালকে বিষের দাম বেড়ে যাবে, কাল থেকে বাজারে বিষ পাওয়া যাবে না, ঠিকই দেখবেন লাইন ধরে লোকে বিষ কিনবে। টিসিবি ট্রাক নিয়ে নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়াবে। ভাই, বিষ দেন। বিষ দেন। বিষ দিয়ে কী করবেন? ওমা কী করব? বাসায় থাকুক। দাম তো বাড়বেই। পরে বিক্রি করে দেব। কিন্তু কালকে যদি বাজারে না থাকে, তখন কী হবে। হঠাৎ যদি লাগে?
জি ভাবি ভাবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো তাই লিখেছেন, আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান। আর রুনা লায়লা গান করেছেন, পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম বন্ধুভাগ্য হইল না।
চলেন চলেন। বাজারে যাই। বই কিনি। আপা শোনেন, বাংলা গল্পের বই, কবিতার বই, উপন্যাস এই সব কিনবেন। তবে রেয়ার গ্রুপের রক্তের মতো রেয়ার লেখকের বই স্টক করতে পারলে ভালো।
দাঁড়ান। আপনার ভাই মেসেজ পাঠিয়েছেন। কম লোকু মার। কম লোকু মারের বইয়ের দাম নাকি খুব বাড়বে। দাঁড়ান। এক সেকেন্ড। আপনার ভাইকে জিজ্ঞেস করি। এক সেকেন্ড। স্যরি ভাবি, কমলো কুমার। কম লোকু মার না।
ভাবি, ভাবি, আমারও একটা বই আছে। বিক্রি করে দিতে পারব পরে। মান বজী বন। মান বজী বন মনে হয় মান কচুর বন নিয়ে।
কী বলেন? মানবজীবন! ও! তাই তো!
ভাবি, পেঁয়াজ স্টক করেছিলেন? করেননি। লবণ? করেছেন। হি হি হি। ধরা খেয়েছেন। এখন এত লবণ দিয়ে কী করবেন?
গুজবে কান আসলে দেওয়া উচিত না। কী বলেন ভাবি। কত্ত গুজব যে ছড়ায় এই দেশে। দেখেন না একবার বলল, চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখা গেছে। তারপর বলল, সেতুতে নাকি মানুষের বাচ্চা লাগবে। কী বলব ভাবি, ঢাকার মতো জায়গায় স্কুলের গেটে বাচ্চার মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। কী একটা গুজব দেশে ছড়িয়েছিল। কত মানুষ যে মারা গেল। গুজব মানেই গজব। আমি তো একদম গুজবে কান দিই না। গুজব মানে গজব!
আপনার তো বয়স কম ভাবি। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন ঢোলকলমিগাছের পাতা নিয়ে গুজব ছড়িয়েছিল। ঢোলকলমিগাছের পাতা লাগলে নাকি মানুষ মরে যায়। তখন সব কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় সেসব খবর ছাপাও হতো। বলেন দেখি। তখন যদি ফেসবুক থাকত!
উফ। ভাবি, ফেসবুকের কথা আর বলবেন না! কত যে গুজব ছড়াতে পারে ফেসবুক! এক লতা মঙ্গেশকরকে যে এরা কতবার মারল।
এই জন্য ইন্ডিয়াতে একটা প্রচার হয়েছে। আমি যেবার দিল্লিতে গেলাম, তখন দেখি, এয়ারপোর্টে ফ্রি কাগজ দিচ্ছে। সেখানে দেখলাম, প্রিন্ট ইজ প্রুফ। তাতে লিখেছে, আমরা খবর ছাপার আগে এক শ বার যাচাই-বাছাই করি। ঠিক না হলে ছাপি না। অনলাইন আগে প্রকাশ করে। পরে চেক করে। ভুল হলে সরিয়ে দেয়। এই জন্য ভালো খবরের কাগজ বাসায় রাখতে হয়।
তো ভাবি আপনি কী করছেন? যাবেন বাজারে? বই কিনতে? চলেন, বাংলা বই কিনে স্টক করে ফেলি। আরেকটা বইয়ের নাম পেয়েছি। আত্ম যা একটা কবরীগাছ। স্যরি। আত্ম যাও একটি করবীগাছ।
না না। ওটা আত্মজা ও একটি করবী গাছ। হাসান আজিজুল হকের লেখা। আমাদের ডিগ্রি ক্লাসে পড়াত।
ভাবি, আনিসুল হকের বই কিনবেন নাকি?
না না। ভীষণ সস্তা। খুব চিপ লেখক।
সস্তা! তাইলে তো ভাবি কিনে রাখা যায়।
আরে বই সস্তা না। লেখক সস্তা। চিপ রাইটার। কিন্তু বইয়ের দাম রাখে বেশি। কিনেন না কিনেন না। ধরা খাবেন। পরে উইপোকায় খাবে।
দামি লেখক কিনব বলছেন। মানিক কিনি?
অবশ্যই মানিক কিনবেন। রতন কিনবেন। সোনার পাহাড় কিনতে পারেন। কেনার সময় দেখে শুনে বুঝে না কিনলে লবণ কেনার মতো ঠকতে হবে।
ঠিক ঠিক। তবে বই এবার কিনতেই হবে। বইয়ের বাজারে আগুন লেগে যাচ্ছে। বাংলা বই। আজ যে কিনবে, কাল সে লাখপতি হবে।
চলেন, সিন্ডিকেট কারসাজি করার আগেই বইয়ের দোকানে গিয়ে বাংলা বই কিনে ফেলি। বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। তবে এইবার বই কিনে কোনো বনে গা ক্রোড়পতি হয়ে যাব।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক