অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দক্ষতার উন্নয়নে বিনিয়োগ
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শুরু হচ্ছে। আমরা আজ আলোচনা করব এ পরিকল্পনায় দক্ষতা উন্নয়নে কতটা বিনিয়োগ করা যায়। কোন ক্ষেত্রে কীভাবে বিনিয়োগ করলে দক্ষতা উন্নয়নে অবদান রাখতে পারব।
দক্ষতা এমন একটা বিষয়, এটা যুগ ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। তাই দক্ষতা বৃদ্ধিতে পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন নিয়ে আজকের আলোচনা।
শামসুল আলম
আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম হলো মানবসম্পদ। তাই মানবসম্পদে দক্ষতার উন্নয়নে ও কারিগরি শিক্ষায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা অনেক গুরুত্ব দিয়েছিলাম।
এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের কথাও বলেছিলাম। সরকারও এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছিল।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মূল ভিত্তি। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি হবে ২০২০-২৫ সালের জন্য। এ ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগে আমাদের মনে রাখতে হবে অটোমেশন, রোবটিকস ও ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনসংখ্যা সুবিধা)। ইত্যাদি বিষয়।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেব। ১) কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি গ্রোথ, ২) সবার সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে সাম্য ও সমতা। ৩) জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা।
কিন্তু এসবের জন্য প্রয়োজন জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করা। আমাদের দেশে বাজারের চাহিদার সঙ্গে শ্রমের জোগানের মিল নেই। কিন্তু চাহিদা মেটাতে সেই জায়গাগুলোতে বিপুলসংখ্যক বিদেশি নিয়োগ হচ্ছে।
বাজার উপযোগী কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতার উন্নয়নের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। আমাদের দরকার উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চ কারিগরি শিক্ষা, যার মাধ্যমে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা করতে পারব। সরকার আগামী পাঁচ বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনা করলেও বেসরকারি খাতকে ভবিষ্যতের প্রয়োজন মাথায় রেখে বিনিয়োগ করতে হবে। তা হতে হবে অন্তত ১৫-২০ বছরের কথা চিন্তায় রেখে। লক্ষ রাখতে হবে পরিকল্পনা, বিনিয়োগ যা–ই হোক না কেন, সবকিছু দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী সমন্বিত পদ্বতিতে যেন হয়।
মানস ভট্টাচার্য্য
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মূল বিষয় ছিল নাগরিকদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।এখানে কর্মসংস্থান তৈরিই ছিল মূল লক্ষ্য।
এ পরিকল্পনায় জাতীয় উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো নারীর ক্ষমতায়ন ও বেকারত্ব কমিয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি। এ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন করার ক্ষেত্রে ছিল বিশেষ গুরুত্ব। এ বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে দাতা সংস্থা ও সরকারের অর্থায়নে বেশকিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল।
দাতা সংস্থার মাধ্যমে প্রায় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিনিয়োগ হয়।
আজকের আলোচনা থেকে আমরা দুটি বিষয় জানতে চাই—প্রথমত, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিনিয়োগগুলো কতটা সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো যায়? দ্বিতীয়ত, এ পরিকল্পনায় আমাদের প্রত্যাশা কী?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
এত দিন পর্যন্ত মানবসম্পদ উন্নয়নের মাপকাঠি ছিল কেবল শিক্ষা। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা করতে শিক্ষার সঙ্গে দরকার প্রযুক্তি ও দক্ষতা।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুযোগ ঠিকই পাচ্ছে, কিন্তু তারা পিছিয়ে আছে প্রযুক্তিগত জ্ঞানে, যা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে বাধা তৈরি করছে। আর এ জন্য শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি কারিগরি শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে তারা আরও বেশি চাকরির সুযোগ পাবে।
শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কারণ, দক্ষ জনবলের অভাবে এখন বিদেশ থেকে কর্মী আনতে হচ্ছে।
আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আবার বিদেশি কর্মীদের জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে। এ বিষয়টি আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দক্ষ লোকের অভাবে দেশের পোশাক খাতের ১৩ শতাংশ কারখানায় বিদেশিরা কাজ করে। এদিকে দেশের মানুষ কাজ না পেয়ে অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে।
আমাদের কোন খাতে কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন, তা শনাক্ত করে সে হিসেবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। সময় এসেছে খাতভিত্তিক মান তৈরি করে দেওয়া।
এ বিষয়টি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পারিকল্পনায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
সম্প্রতি সরকার প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের বাজেটে নারী-পুরুষের ভিত্তিতে বরাদ্দ দিয়েছে। একইভাবে দক্ষতাসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের যত প্রকল্প নেওয়া হয়, সেখানে দক্ষতার ভিত্তিতে কতটা বরাদ্দ আছে, তা উল্লেখ করে দিলে ভালো হয়।
ফারুক হোসেন
দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা বলতে নাগরিকদের মনে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। সেই জায়গাটা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। সরকার তিনটি কারণে ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি গঠন করেছে।
প্রথমত, ১৫-২০ বছর ধরে সরকারের যে দক্ষতা উন্নয়নকাজ হচ্ছে, তা সমন্বিত নয়।প্রশিক্ষণার্থীদের যে যার ইচ্ছেমতো সনদ দিচ্ছে। মান নির্ধারণ করছে। তাই সনদ থাকলেও বাস্তবে দক্ষ না হওয়ায় চাকরি হচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা পূরণের মতো দক্ষতা অর্জনে যে পরিমাণ প্রশিক্ষণ, কারিকুলাম প্রয়োজন হবে, তা আমাদের কাছে নেই বললেই চলে। তৃতীয়ত, যে যার ইচ্ছেমতো সনদ বিক্রি করেছে। এর ফলে বিদেশ যাওয়ার পর সেই সনদ গ্রহণ করা হচ্ছে না। তাই যেখানে এক হাজার ইউএস ডলার আসার কথা, সেখানে আসছে ৫০০ ডলার।
এ জন্য একজন কর্মী ব্যক্তিগতভাবে বঞ্চিত হচ্ছে ও সরকারকে প্রাপ্য রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত করছে। সত্যিকার দক্ষ বাজার তৈরি করতে হলে সমন্বিতভাবে দক্ষতা উন্নয়নব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
দক্ষতার উন্নয়নে তিনটি ভিত্তি হলো সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা এবং দক্ষতার প্রশিক্ষণ। এই তিনটির সমন্বয়েই তৈরি হবে দক্ষ শ্রমশক্তি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই তিনটির সমন্বয়ে দক্ষতার প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ হতে হবে।
রিফুল জান্নাত
দক্ষ কর্মী তৈরিতে গত পাঁচ বছরে কানাডা সরকার বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আইএলও এবং সরকারের সঙ্গে ৪০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। দক্ষ কর্মী তৈরির অভিজ্ঞতা ভালো। তবে কিছু সমস্যাও আছে। এসব সমস্যা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।
মাধ্যমিক স্কুলপর্যায় থেকে দক্ষতা বাড়াতে কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত। সক্ষমতা আনতে প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষক ও একটি উপযুক্ত কারিকুলাম প্রয়োজন।
তবে আমাদের যে প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষক নেই, তা না। পলিটেকনিক ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে যাঁরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তাঁদের আমরা সময়োপযোগী পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে পারছি না। তাই এ ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
এ ছাড়া নিয়োগ পদ্ধতি অনেক দীর্ঘ ও কঠিন হওয়ায় অনেক পলিটেকনিক ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষক নেই, যা আরেকটি অন্তরায়। তাই এখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে সরকারকে দক্ষ প্রশিক্ষক গড়ে তুলতে হবে।
যে শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও স্নাতক শেষে পড়তে পারবে না, তাদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া যে দক্ষ প্রশিক্ষণ আমরা দিচ্ছি, তা যেন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয় ও সব দেশে সমান চাহিদা থাকে, সেদিকে সরকারকে যথেষ্ট লক্ষ রাখতে হবে।
তানিয়া ফেরদৌস
এডিবি ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এসব উন্নয়ন সহয়োগী চায় যেন সরকার দীর্ঘমেয়াদি সুফল পায়। সেই লক্ষ্যে আমরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে কাজ করছি। এ জন্য একটা পরীক্ষামূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
এর অধীনে ৬৪০টি স্কুলে আমরা বিনা মূল্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়া এই শিক্ষা কার্যক্রমে আমরা ২০২১ সালে সফট স্কিল যুক্ত করতে যাচ্ছি।
সম্প্রতি কিছু পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজ করছি। এডিবির সহায়তায় আমরা দেশের বাইরে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছি। মানসম্মত সার্টিফিকেট ও কারিকুলাম প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে জার্মানির কিছু সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি।
সিঙ্গাপুরের নানিয়াং পলিটেকনিকের মতো ব্যয়বহুল জায়গায় আমরা প্রতিবছর অনেককে প্রশিক্ষণ করতে পাঠাই। কিন্তু যারা দাতা সংস্থা রয়েছে তারা উপলব্ধি করে, সরকার যেন এ দেশেই একটা নানিয়াং পলিটেকনিকের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। তাহলে অনেক বেশি ভালো হবে এবং আমরা এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত
কামরান টি রহমান
বাংলাদেশে কমবেশি ছয় কোটি মানুষের একটা শ্রমবাজার রয়েছে। প্রতিবছর সেখানে আরও প্রায় ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এত বিশাল শ্রমবাজার সামাল দেওয়ার চেয়ে এখন বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কর্মসংস্থান করা।
সাধারণত যারা দেশের বাইরে যাচ্ছে, তারা মূলত দুবাই বা মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে। এটা ছাড়া জাপান ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের মতো দেশগুলোতে সেবা খাত তৈরি হচ্ছে। কারণ, সেখানে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আবার আমাদের দেশেও নার্সের সংখ্যা কম। এই খাত আমরা চাইলেই সমৃদ্ধ করতে পারি।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা দক্ষতা বাড়ানো নিয়ে কাজ করেছি, আমি মনে করি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে পারি। কারণ, দক্ষতা বাড়লে একজন একটা ভালো চাকরি পাবে। কিন্তু একজন উদ্যোক্তা গড়ে উঠলে একাধিক লোকের কর্মসংস্থান হবে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সরকারকে দক্ষতা ও উদ্যোক্তা তৈরি উভয় দিকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
শাজিয়া ওমর
দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে যে পরিমাণ সম্পদ দরকার, তা আমাদের নেই। তাই এ খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি। এখন কথা হলো আমাদের কী কী প্রয়োজন? দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে আমাদের দরকার এমন কিছু প্রতিষ্ঠান, যেখানে থাকবে উন্নত প্রযুক্তি। প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষক।
এই উদ্যোগ সফল করতে সরকার চাইলেই দাতা সংস্থাগুলোর থেকে সহযোগিতা নিতে পারে। বাংলাদেশে আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের নারীরা চাইলে অনেক কিছু করতে পারে না। এর মূলে রয়েছে কিছু সামাজিক সীমাবদ্ধতা এবং নিরাপত্তার অভাব।
আমাদের দেশে অনেক আবাসিক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশন রয়েছে, যদি এ বিষয়ে সবাইকে জানানো হয়, তাহলে অনেক নারীই আগ্রহী হবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী হবে।
এখন পরিবহন খাতে নারীরা আসছে। যদি আমরা লিঙ্গবৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারি, তাহলে এটিও একটি সম্ভাবনাময় খাত হতে পারে।
আমরা শুনছিলাম অনেক ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান আমাদের দেশে কাজ করছে। কারণ, আমাদের অনেক খাতে দক্ষ লোকবল নেই। এ জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লোকবল তৈরি করতে পারলে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। তবে শুধু প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে আসতে হবে যেন তারা প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের অবশ্যই চাকরি দেয়। তাদের দেওয়া প্রশিক্ষণ যেন বৃথা না যায়।
বিশ্বব্যাংক পঞ্চগড়ে এ ধরনের কাজ করেছে। তারা প্রাইভেট কোম্পানির ৫০০ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। শর্ত হলো, তারা প্রশিক্ষণ শেষে এদের কাজ দেবে।
আফতাব উদ্দিন আহমেদ
আমরা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা না করে যদি ১০ বছর পর বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চাই এই পরিকল্পনা করি, সেটাই বেশি ভালো হবে। কারণ, ৫ বছরের পরিকল্পনা করার পর দেখা যায় আরও আধুনিক কিছু চলে আসে।
আমরা আবার পিছিয়ে পড়ি। তাই ১০ বছরের একটা পরিকল্পনা তৈরি করার পর ৫ বছরের জন্য কোনো পরিকল্পনা হাতে নেওয়া গেলে বেশি ভালো হয়।
ব্র্যাক মূলত গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। ব্র্যাক এসব এলাকার মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, সরকার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এত কিছু করছে, অথচ কোনো সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে দক্ষতার বিষয়ে তেমন কিছু বলা থাকে না।
কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতার স্তর যাচাই করে নিয়োগ দিতে হেবে।
দিদারুল আনাম চৌধুরী
১৯৭২ সাল থেকে ইউসেপ মূলত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও যুবকদের কীভাবে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়, আমরা সেটা নিয়েই ৪৭ বছর ধরে কাজ করছে।
১০টি টেকনিক্যাল স্কুল নিয়ে আমরা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নে কাজ করছি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
কিন্তু কোনোটার সঙ্গে কোনোটার সমন্বয় নেই। সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বিতভাবে কাজ করা প্রয়োজন। একটি সমন্বয় কেন্দ্রের মাধ্যমে আটটি বিভাগে আটটি টেকনিক্যাল স্কিল ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা সম্ভব। তাহলে দেশীয় সম্পদ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক সুবিধা হবে বলে মনে করি।
এর পাশাপাশি সরকারকে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দক্ষতার উন্নয়নে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল এবং সফট স্কিলসকে প্রাধান্য দিতে হবে।
কিশোর কুমার সিং
আমাদের সমস্যা হলো, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। যদি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিসাব করতে চাই কতজন শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে, আমরা বলতে পারব না।
যদি জানতে চাওয়া হয় দেশে কতজন হিজড়া জনগোষ্ঠী রয়েছে, আমরা বলতে পারব না। কারণ, আমাদের কাছে তথ্য নেই। তাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় এনে বিনিয়োগের কথা ভাবা উচিত।
নারীর নিরাপত্তা ও আবাসিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রসঙ্গে এখানে একজন বলছিলেন, এর সঙ্গে আমি যোগ করতে চাইব প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের সুবিধার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার।
আমরা জানি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জেন্ডারবান্ধব বাজেট করেছে। কিন্তু এটা নিয়ে আরও বেশি কাজ করা প্রয়োজন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জেন্ডারবান্ধব ও প্রতিবন্ধীবান্ধব বাজেট নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।
টুমো পটিআইনেন
আইএলও মনে করে, বাংলাদেশের কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধির মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে কাজের ধরন আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তি আধুনিকায়ন হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের দিকে জোর দিতে হবে। তাই আইএলও এবং বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
শুধু দক্ষতা বৃদ্ধি নয়, কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করছি। কর্মক্ষেত্র বাড়ানোর কৌশল দক্ষতা তৈরির চেয়ে কঠিন কাজ বলে মনে করি। প্রশ্ন আসতে পারে, কীভাবে কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়? উৎপাদনশীলতা বাড়ার সঙ্গে সৃষ্টি হয় নতুন কর্মক্ষেত্র। যেমন ইপিজেড, এসইজেডে সরকার অনেক বিনিয়োগ করেছে।
এ ছাড়া রয়েছে এসএমই এন্টারপ্রাইজ ও মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ, যেখানে উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। একজন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে আরও অনেক নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।
কর্মক্ষেত্রে নারীরা যত সম্পৃক্ত হবে, ততই সচ্ছলতা আসবে বলে মনে করি। পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় দক্ষতাকে এমন পর্যায় নিয়ে যেতে হবে, যেন বিদ্যমান চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়।
কর্মক্ষেত্র বাড়াতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আরও দক্ষতা বাড়ানো এবং জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
ডেটাবেইস তৈরি করতে বিনিয়োগ করতে হবে, যেখানে প্রতিটি শ্রমিকের একটা করে প্রোফাইল থাকবে।
এখানে বলা থাকবে কোন সেক্টরে কী ধরনের দক্ষতা লাগবে ও প্রতি ৫ বা ১০ বছর পর আরও কী কী লাগতে পারে।
হ্যান্স ল্যাম্বব্রেস্ট
আজকের আলোচনার বিষয় অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে। আমরা জানি, বাংলাদেশ মিশন ২০৪১ নিয়ে কাজ করছে। তাই শুধু ৫ বছরের জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট হাতে না নিয়ে আরও বেশি সময়ের জন্য পরিকল্পনা করা গেলে ভালো হয়।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পড়তে শুরু করেছে। তাই নতুন খাতে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। যেমন আইসিটি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করা ইত্যাদি।
যে বিষয়গুলো আজকের আলোচনায় অন্য বক্তাদের মাধ্যমে উঠে এসেছে, এর বাইরে আমি একটা বিষয়ে বলতে চাই। সেটা হলো, সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হয়ে আমরা বলতে চাই, দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরও অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে ব্যবসা ও রপ্তানির ক্ষেত্রে। কারণ, নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশকে অনেক কাজ করতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে। আরও অনেকেই করছে, এ ছাড়া এডিবি ও বিশ্বব্যাংক ঋণ দিয়ে সাহায্য করছে, যা সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যয় করে বাংলাদেশ আরও উন্নয়ন করতে সক্ষম বলে মনে করি।
একজন উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে মনে করি, সরকার যা কথা দিয়েছিল, তা ঠিকভাবে পালিত হচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে আমরা সামনে আরও সাহায্য করতে প্রস্তুত থকব।
মো. মাসুদ রানা
প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এই ব্যাপকসংখ্যক লোকের প্রায় অর্ধেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিশ্বের ১৭৩টি দেশে কর্মরত রয়েছে।
এ পর্যন্ত ১২ দশমিক ৬ মিলিয়ন কর্মী বিদেশে কাজ করছে। অনেকের মনে হচ্ছে, হয়তো সব অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি তেমন না।
শ্রমবাজারের শ্রমিকদের আমরা ৪ ভাগে ভাগ করেছি ১. পেশাদার ২. দক্ষ ৩. আধা দক্ষ ৪. কম দক্ষ। লেস স্কিল বলতে আমরা কাউকে অদক্ষ বলছি না।
কারণ, কোনো মানুষই অদক্ষ নয়। বিদেশে যারা যাচ্ছে, তাদের প্রায় ৬০ শতাংশ প্রফেশনাল, স্কিল ও সেমি স্কিল হিসেবে যাচ্ছে। আর বাকিরা লেস স্কিল হিসেবে যাচ্ছে।
এনএসডিএ এবং ২২টি মন্ত্রণালয় এই স্কিল নিয়ে কাজ করছে। আমরা আশা করি সামনে আরও উন্নত হবে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে প্রতিটি উপজেলায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সেই লক্ষ্যে উপজেলা পর্যায়ে ৪০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হচ্ছে এবং আরও ৬০টি সিটিসি নির্মাণের কার্যক্রম চলছে। তাই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই খাতে অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া হবে।
শামসুল আলম
দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। ট্রেনিং ইনস্টিটিউট খুলেছে। এ ছাড়া ইউনিভার্সিটি করেছে। কিন্তু এত কিছুর পর বাজার চাহিদা মেটানো কেন সম্ভব হচ্ছে না, সেটাই চিন্তার বিষয়।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। আজকের আলোচনায় সরকারের বিষয়ে কথা বলা হয়েছে কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের
কিছু করণীয় রয়েছে, সে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ উদ্যোক্তা তৈরি করছে। দেশের ৮০ শতাংশ বিনিয়োগ আসছে বেসরকারি খাত থেকে। তাই বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
ফিরোজ চৌধুরী
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই তরুণদের দক্ষ করে তুলতে হবে। তাহলে তারা কর্মক্ষেত্রে ভালো করবে। তাই দক্ষতার উন্নয়নে চাই সঠিক বিনিয়োগ। আশা করা যায় অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে সঠিক বিনিয়োগের সুপারিশ করা হবে।
আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
যাঁরা অংশ নিলেন
শামসুল আলম: সদস্য (সিনিয়র সচিব), সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন
টুমো পটিআইনেন: কান্ট্রি ডিরেক্টর, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), কান্ট্রি অফিস ফর বাংলাদেশ
ফারুক হোসেন: নির্বাহী চেয়ারম্যান, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
হ্যান্স ল্যাম্বব্রেস্ট: ফার্স্ট সেক্রেটারি, টিম লিডার এডুকেশন অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট অ্যাট দ্য ডেলিগেশন অব দ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন টু বাংলাদেশ
রিফুল জান্নাত: জ্যেষ্ঠ উন্নয়ন উপদেষ্টা, কানাডিয়ান হাইকমিশন
কামরান টি রহমান: সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন
তানিয়া ফেরদৌস: প্রকল্প বিশ্লেষক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক
শাজিয়া ওমর: কমিউনিকেশন কনসালট্যান্ট, বিশ্বব্যাংক
আফতাব উদ্দিন আহমেদ: পরিচালক, দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি, ব্র্যাক
দিদারুল আনাম চৌধুরী: পরিচালক, প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইনোভেশন, ইউসেপ বাংলাদেশ
কিশোর কুমার সিং: বিশেষ দক্ষতা বিশেষজ্ঞ, আইএলও
মানস ভট্টাচার্য্য: অফিসার ইনচার্জ, দক্ষতা ২১ প্রকল্প,আইএলও
মো. মাসুদ রানা : ঊর্ধ্বতন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো