উপকূলজুড়ে বনায়ন করতে হবে
>সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছিল। যে তীব্রতায় তা আঘাত হেনেছে, সুন্দরবন না থাকলে জানমালের আরও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বিশেষজ্ঞদের তরফে বলা হচ্ছে যে সুন্দরবনের কারণে বাংলাদেশ ঝড়ের এই বিপদ থেকে অনেকটাই বেঁচে গেছে। সুন্দরবনের গুরুত্ব ও একে রক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ।
প্রথম আলো: ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবনের কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে?
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: সুন্দরবনে আঘাতের সময় বুলবুলের বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। এই তীব্র বাতাসে বনের অবশ্যই ক্ষতি হওয়ার কথা। গাছপালা ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি বন্য প্রাণীরও ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে শীতকালে বাংলাদেশে আসা পরিযায়ী পাখিদের একটি অংশ এই সময়টাতে সুন্দরবনের ওই এলাকায় অবস্থান করে। এ ছাড়া জলোচ্ছ্বাসের কারণে অন্যান্য স্থলচর প্রাণীদেরও ক্ষতি হওয়ার কথা। তবে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ ক্ষতি হলো, তা নিরূপণের জন্য একটি সামগ্রিক সমীক্ষা হওয়া দরকার।
প্রথম আলো: বুলবুলের আঘাতের ক্ষত সারাতে বন বিভাগের কী করা উচিত?
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: সিডর ও আইলার পর আমরা সুন্দরবনকে বিরক্ত না করে ক্ষত সারানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এখনো তা–ই করা উচিত। এর বাইরে কোনো কিছু করতে গেলেই বনের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ, একটি গাছ কেটে সুন্দরবনের ভেতর থেকে নিয়ে আসা মানে সেখানে প্রবেশ করা ও বন্য প্রাণীদের উপদ্রব করা। এটা করা ঠিক হবে না। সিডরের সময় তো কয়েক লাখ গাছ পড়ে গিয়েছিল। সেগুলো যেমন ছিল আমরা তেমনি রেখে দিয়েছিলাম। সেগুলো পচে বনের প্রতিবেশ ব্যবস্থার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এতে বনটির প্রতিবেশ ব্যবস্থা আরও সমৃদ্ধ হয়েছিল।
প্রথম আলো: তার মানে সুন্দরবন শুধু আমাদেরই সুরক্ষা করছে না, তার নিজেকে সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষমতাও আছে?
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: পৃথিবীর যেকোনো বনের চেয়ে সুন্দরবন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। এখানে এমন সব গাছ ও প্রাণী থাকে, যাদের লোনা ও মিঠাপানির সঙ্গে বসবাস করার ক্ষমতা আছে। তারা উপকূলের প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকতে পারে। ফলে এটি একই সঙ্গে নিজেকে ও বাংলাদেশকে রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তো আমাদের সুন্দরবন আছে। কিন্তু এই ঝড়টি তো উপকূলের অন্য কোনো এলাকাতেও আঘাত হানতে পারত। সেটা হতে পারত হাতিয়া, নোয়াখালী বা অন্য কোনো এলাকায়। সেখানে তো সুন্দরবনের মতো এত গভীর বন নেই। একসময় সেখানে ম্যানগ্রোভ বন ছিল। সেগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে কেটে সাবাড় করা হয়েছে। ওই জেলাগুলোতে বুলবুলের মতো ঝড় আঘাত করলে ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হতো। অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারত।
প্রথম আলো: তাহলে উপকূলীয় মানুষকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করার জন্য কী করতে হবে?
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের উপকূলীয় এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থা অনেক সমৃদ্ধ। সেখানে লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণ আছে, বন তৈরির জন্য অনুকূল জলবায়ু আছে। বৃষ্টিপাতও ভালো। কিন্তু এসব এলাকায় আমরা বনভূমি টিকিয়ে রাখতে পারিনি। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল থেকে আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে উপকূলজুড়ে বনায়ন করতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে যে বন গড়ে উঠছে, তাকে রক্ষা করতে হবে। উপকূলের চর ও নতুন জমি ছাড়াও অনেক ব্যক্তিগত জমি আছে, সেখানে বনায়ন সম্ভব।
প্রথম আলো: কিন্তু সুন্দরবনের চারপাশসহ উপকূলীয় এলাকাজুড়ে তো দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে। সরকারিভাবে প্রচুর প্রতিষ্ঠান বনভূমি বরাদ্দ নিচ্ছে। তাহলে বন রক্ষা পাবে কীভাবে?
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: মনে রাখতে হবে সুন্দরবন আমাদের পক্ষে সৃজন করা সম্ভব নয়। বৃক্ষরোপণ করে এ ধরনের বন তৈরি করা অসম্ভব। এই বনের প্রতিবেশ ব্যবস্থার কোনো একটি উপাদান যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে বনের ক্ষতি হয়ে যাবে। বনের চারপাশে যদি দূষণ বেড়ে যায় বা লবণাক্ততা বাড়ে, তাহলে সেখানে এখন যে ধরনের বৃক্ষ হচ্ছে, প্রাণীরা বাস করছে, তারা আর টিকতে পারবে না। ফলে এই বনটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করার সামর্থ্য হারাবে। আর একবার কোনো একটি বন ধ্বংস হয়ে গেলে তাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না। আমাদের আগের অভিজ্ঞতা তা–ই বলে। শুধু সুন্দরবন নয়, পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে গেলে বা শিল্পায়ন করতে গেলে অনেক সাবধানী হতে হবে। সেখানে এমন কোনো কলকারখানা গড়ে তোলা যাবে না, যা ন্যূনতম পরিবেশদূষণ ঘটাবে। অনেক দূষণ আছে যেগুলো হয়তো সরাসরি দেখা যাবে না। যেমন বায়ুদূষণের কারণে বনের মধ্যে কীটপতঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হবে। এসব কীটপতঙ্গ বিশেষ করে মৌমাছি বনের গাছের পরাগায়ন ঘটায়। আর পানিতে দূষণ হলে জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে এক জায়গার বীজ যে আরেক জায়গায় গিয়ে বৃক্ষের জন্ম দেয়, তা আর হবে না।
প্রথম আলো: সুন্দরবনের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ কী?
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: আমরা সিডরের পরপর জরুরি ভিত্তিতে একটি কাজ করেছিলাম, তা হচ্ছে বনের মধ্যে যেসব পুকুর আছে, সেগুলোকে লোনাপানিমুক্ত করেছিলাম। কেননা, পুরো সুন্দরবনে ওই পুকুরগুলো হচ্ছে মিঠাপানির একমাত্র উৎস। সেগুলো জলোচ্ছ্বাসের কারণে লবণাক্ত হয়ে ওঠে। বুলবুলের পরও তা–ই হওয়ার কথা। এসব পুকুরে বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী পানি খায়। ফলে সেগুলো দ্রুত সেচে লোনাপানি সরিয়ে ফেলতে হবে। যাতে বৃষ্টির সময় তাতে মিঠাপানি জমতে পারে। আর বন বিভাগের অনেক স্থাপনা ও ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নৌযানগুলো নষ্ট হয়েছে। সেগুলো দ্রুত মেরামত করতে হবে। যাতে ঝড়–পরবর্তী সময়ে বনে গাছ চুরি বা বন্য প্রাণী হত্যা না হয়।
প্রথম আলো: বনের দিকে সবার নজর কেন?
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বন বিভাগ দেশের সবচেয়ে বেশি ভূমি এককভাবে ব্যবস্থাপনা করছে। কিন্তু এসব বনভূমি রক্ষায় এখন তাদের রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হচ্ছে। আগে মানুষ গাছ কেটে নিয়ে যেত। এখন পুরো বনটি নিয়ে যেতে চায়। আমরা যদি বন রক্ষা করতে না পারি, তাহলে আমরা নিজেদেরও বাঁচাতে পারব না। এটা সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।