যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঘুষবিরোধী ব্যবসায়িক সংগঠন ট্রেসের প্রতিবেদনে ঘুষ লেনদেনে বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৭৮তম স্থানে কিংবা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা অত্যন্ত উদ্বেগজনক খবর। ‘ট্রেস ব্রাইবারি রিস্ক মেট্রিক্স’ শিরোনামে ট্রেস ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘুষের প্রবণতা নিয়ে প্রতিবছর এই সূচক তৈরি করে। ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ আরও দুই ধাপ পিছিয়েছে। যেসব দেশে ঘুষের ঝুঁকি বেশি, সেসব দেশের পয়েন্টও বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারত ৪৮ পয়েন্ট পেয়ে ৭৮তম অবস্থানে, পাকিস্তান ৬২ পয়েন্ট নিয়ে ১৫৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ভুটান; ৪১ পয়েন্ট নিয়ে দেশটির অবস্থান ৫২তম। বাংলাদেশ থেকে সূচকে এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ায় একদা সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত আফগানিস্তান থেকে আমাদের পিছিয়ে থাকা লজ্জাকরও।
সার্বিক এই চিত্রের বাইরে সংগঠনটি বেশ কিছু ছোট বিষয়েও সূচক তৈরি করে থাকে; এর মধ্যে আছে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক যোগাযোগ (অসাধু লেনদেনই যার উদ্দেশ্য); নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা ও সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ, ঘুষ লেনদেনে বাধা ও ঘুষ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া। এসব ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। ট্রেসের প্রতিবেদনে ঘুষের ঝুঁকি কমাতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই সূচকে বাংলাদেশ পেয়েছে ৬৪ পয়েন্ট; যদিও ভারতের অবস্থান অনেক ভালো।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ট্রেসের প্রতিবেদনের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ঘুষের প্রবণতা কম। তাঁর এ দাবি সত্য হলে দেশবাসী আনন্দিত হতো। কিন্তু বাংলাদেশে ঘুষের লেনদেনের মাত্রা বা ঝুঁকি জানতে বিদেশি প্রতিবেদনের প্রয়োজন পড়ে না, চোখ–কান খোলা রাখলেই টের পাওয়া যায় এবং কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জনগণকে যেতে হয়, তা তারা ভালোই জানে। গত সেপ্টেম্বরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির আরেক জরিপে দেখা গেছে, ঘুষ ছাড়া সেবা পায় না ৮৯ শতাংশ মানুষ।
এসব সূচক ও জরিপ থেকে এই সত্যই বেরিয়ে আসে যে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে এর সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিতে হয়। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। সরকার কিছু কিছু আইনি পদক্ষেপ নিলেও ঘুষের মাত্রা যে কমেনি, ট্রেসের প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সর্বনিম্ন অবস্থানই তা নির্দেশ করে। যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত বিভাগের এক-তৃতীয়াংশ কাজ বাগিয়ে নিয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে ঘুষ-দুর্নীতি কমাতে হলে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও অসাধু সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে যে অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছে, সেটি ভেঙে দিতে হবে। যেসব দেশের সংবাদমাধ্যম বেশ স্বাধীন সেসব দেশ ঘুষ-দুর্নীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কেননা, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এ ক্ষেত্রে সরকারের চোখ ও কানের ভূমিকা পালন করতে পারে, যদি সত্য প্রকাশের বাধাগুলো অপসারণ করা যায়। একই সঙ্গে নাগরিক সমাজকে যুক্ত করতে পারলে সরকারের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনা সহজ হয়। ভারতসহ অনেক দেশে এই কৌশল সুফল দিয়েছে।
সরকারকে মনে রাখতে হবে, ঘুষ-দুর্নীতি বেড়ে গেলে শুধু ব্যবসার খরচই বাড়ে না, ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হন। সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম প্রণোদনা ঘোষণার পরও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়ার কারণও ঘুষের প্রাদুর্ভাব। টেকসই উন্নয়ন এবং এর সুফল বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছাতে হলে ঘুষের ঝুঁকি কমাতেই হবে।