ইতিহাসের বিরুদ্ধে লড়ছেন ইমরান
গত সপ্তাহে দক্ষিণ এশিয়ায় দুটো বড় ঘটনা ঘটেছে। একটা, বাবরি মসজিদ মামলার রায়। অপরটা, শিখদের জন্য কর্তারপুর করিডর খুলে দেওয়া।
প্রথম ঘটনায় ভারতের আদালত অযোধ্যায় মসজিদের স্থলে রামের নামে মন্দির তৈরির নির্দেশ দিলেন। দ্বিতীয় ঘটনায় পাকিস্তান তার ভূমিতে সাড়ে চার কিলোমিটারের এক করিডর খুলে দিয়েছে শিখদের আসা-যাওয়ার জন্য। শিখরা এখন এই করিডর দিয়ে দুটি তীর্থস্থানে আসতে-যেতে পারছেন। যার একদিকে ভারতনিয়ন্ত্রিত পাঞ্জাবে রয়েছে ‘দেরা বাবা নানক’; অন্য পাশে লাহোর অংশে রয়েছে ‘দরবার সাহিব গুরুদ্বার’।
গুরুদুয়ারা দরবার সাহিব শিখদের দ্বিতীয় পবিত্র ধর্মস্থান। এখানেই নানক জীবনের শেষ ১৮ বছর কাটান। পাকিস্তানের সিদ্ধান্তে শিখরা উল্লসিত। ১২ নভেম্বর ছিল গুরু নানকের ৫৫০তম জন্মদিন। কর্তারপুর করিডর পেয়ে দিনটি শিখরা দারুণভাবে উদযাপন করলেন। অন্যদিকে বাবরি মসজিদ হারিয়ে মুসলমানেরা আছেন নীরব অসন্তোষ। ধর্মীয় স্বাধীনতার বিবেচনায় দুটো ঘটনা একদম বিপরীতমুখী।
স্পষ্টত কূটনীতি ও সমাজনীতিতে ইমরান খান এগিয়ে আছেন। তবে প্রচারমাধ্যমে তাঁর পদক্ষেপ সামান্যই কদর পাচ্ছে। বরং দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে দেশটি নিয়ে প্রধান খবর হলো মাওলানা ফজলুর রহমানের ‘আজাদি মার্চ’। ফজলুর রহমান ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়েছিলেন এই ‘মার্চ’-এ। যার লক্ষ্য ইমরানকে পদত্যাগ করানো। প্রায় ১৬ দিন হলো মাওলানাদের কুচকাওয়াজের। ইমরান ক্রিজেই রয়েছেন এবং শক্তিশালী মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্টও তাঁর পেছনেই আছে। প্রশ্ন উঠেছে, ফজলুর রহমান জীবনের শেষ বাজিতে হেরে যেতে চলেছেন কি না। তবে পদত্যাগ ব্যতীত আন্দোলনকারীদের অন্যান্য দাবি মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ইমরান। সেটা মাওলানাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাঁরা এখন ‘প্ল্যান-বি’র কথা বলছেন। যার অর্থ চার প্রদেশ থেকে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করে ইসলামাবাদ অবরোধ। যার আরেকটা অর্থ সহিংসতা। পাকিস্তানের জন্য এটা একটা খারাপ মুহূর্ত।
ফজলুর রহমান বৃত্তান্ত
পাকিস্তানের দেওবন্দি ঘরনার রাজনৈতিক দল জমিয়াতে-ই-উলেমা-ই-ইসলামের প্রধান হলেন ফজলুর রহমান। এই দলের বয়স ৭৪ বছর। ফজলুর রহমান এর একাংশের নেতা। পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাওলানা এখন তিনি। ১৯৮০ সালে ২৭ বছর বয়সে পিতা মুফতি মেহমুদের মৃত্যুসূত্রে রাজনীতিতে এসেছিলেন। এর আগে আল-আজহার থেকে পড়ালেখা শেষ করেন। শরীফ ও ভুট্টো রাজবংশের তরুণদের মতোই তিনি। পাকিস্তানে এসব রাজনৈতিক বংশে তরুণ-তরুণীরা বিদেশে পড়ালেখা শেষে পিতা-মাতার রাজনৈতিক ব্যবসায়ের হাল ধরেন। এটাই ঐতিহ্য!
সমাজতন্ত্রী ন্যাপের রাজনৈতিক বন্ধু হিসেবে মুফতি মেহমুদ একসময় খাইবারে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তবে তাঁর পুত্রের চার দশকের রাজনীতি শেষে দেখা যাচ্ছে, দেশটির জাতীয় পরিষদে জমিয়তের আসন নেই। সর্বশেষ নির্বাচনে ফজলুর রহমান নিজে দুটি আসনেই হেরেছেন। নির্বাচনের ফলাফল দলে তাঁর নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। নির্বাচনের পরই কারচুপির অভিযোগ তোলেন তিনি। এটা অস্বাভাবিক নয়। ডেরা ইসমাইলে দুটি আসনেই তিনি হারেন ইমরান অনুসারীদের কাছে। যে ইমরান রাজনীতিতে যোগ দেন তাঁর ১৬ বছর পর।
শরীফ ও ভুট্টো ডাইন্যাস্টিও নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযোগ করছিল প্রথম থেকে। সেনাবাহিনী নির্বাচনে ইমরানের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করে বলে অভিযোগ আছে। এই অভিযোগকে পুঁজি করে সরকারবিরোধীদের নিয়ে একটা বড় আন্দোলনের পটভূমি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন ফজলুর রহমান, যা মূলত রাজনৈতিকভাবে তাঁকে নিজ দল ও জাতীয় পরিসরে প্রাসঙ্গিক রাখতে পারে। তাঁর হিসাবে ভুল ছিল না। কিন্তু তিনি অপেক্ষা করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। সহযোগী বিরোধী দলগুলোকে অপ্রস্তুত রেখেই অক্টোবরে অসময়োচিত এক রাজনৈতিক জুয়ায় নেমে পড়েন ফজলুর রহমান। পাকিস্তানের প্রভাবশালী গোয়েন্দারাও তাঁর এই হঠাৎ গর্জে ওঠায় বিস্মিত। অতীতে ফজলুর রহমান জাতীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলেই ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছেন। গত বছর বিরোধী সব দল মিলেই তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী করেছিল। দলের দলিলপত্রে শরিয়া আইনের কথা বললেও বরাবরই জাতীয় পরিসরে সেক্যুলার দলগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে তাঁর রাজনীতি। সেই বিবেচনায় আজাদি মার্চ তাঁর জীবনের প্রথম একক কর্মসূচি। এর কৃর্তৃত্ব ও দায়ভার তাই একা তাঁরই।
রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ থাকতে চান পাকিস্তানের মাওলানারা
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরানের মাত্র ১৫ মাস হলো। তিনিও ক্ষমতায় আসার আগে ২০১৪ সালে ফজলুর রহমানের মতোই এক লংমার্চ করেছিলেন। তখন মাওলানারা ছিলেন তাঁর উৎসাহদাতা। সেনাবাহিনীরও নীরব সমর্থন ছিল তাতে। এখন একই মাওলানারা ইমরানের বিরুদ্ধে। ইমরানের দেখানো অস্ত্র নিয়েই পথে তাঁরা। তবে সেনাবাহিনী এবার মাওলানাদের পাশে নেই। পাকিস্তানের রাজনীতির নতুন চমক এটা।
প্রশ্ন হলো, মাত্র ১৫ মাস বয়সী একটা সরকারকে টেনে নামাতে এত মরিয়া কেন পাকিস্তানের মাওলানাদের? এর বড় কারণ গত নির্বাচনে এসব দলের খারাপ ফল।
ইমরানের পদত্যাগ ছাড়াও মাওলানাদের আরও দাবি আছে। যার একটি হলো পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন ও রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব কমানো। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য এটা খুবই জরুরি। কিন্তু পাকিস্তানে মাওলানাদের তরফ থেকে এ রকম দাবি বেশ কৌতুককর। প্রায় সাত দশক তাঁরা জাতীয় সব বিষয়ে নাক গলাতে সেখানকার সেনাবাহিনীকে বাড়তি মদদ দিয়েছেন। ফলে এ রকম দাবি তোলার নৈতিক শক্তি কার্যত তাঁদের নেই।
‘আজাদি মার্চ’ থেকে ফায়দা তুলছে শরিফ ও ভুট্টো ডাইনেস্টি
২৮ অক্টোবর করাচি থেকে আজাদি মার্চ শুরু। ‘মাওলানা আ-রা-হে...মাওলানা আ-রা-হে’ স্লোগান দিতে দিতে পাঞ্জাব হয়ে ইসলামাবাদ আসার পরই এই মিছিল বৈশ্বিক মনযোগ কেড়ে নেয়। পাকিস্তানের প্রধান প্রধান প্রচারমাধ্যম এত দীর্ঘ সময় কোনো রাজনৈতিক সমাবেশের লাইভ প্রচার চালায়নি, যা ঘটে এই কুচকাওয়াজকে ঘিরে। কিন্তু মাঠের হিসাবে এই সমাবেশ থেকে মূলত লাভবান মুসলিম লিগের নওয়াজ শরিফ। আজাদি মার্চ থেকে দূরে থাকার বিনিময়ে বন্দিদশা থেকে বিদেশ যাওয়ার জন্য দর–কষাকষি শুরু করেছেন তিনি এবং ইতিমধ্যে কন্যা মরিয়ম নওয়াজকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন। একই আচরণ করেছে ভুট্টোদের পিপলস পার্টি। রাজনীতিতে জামিয়াতকে ইমরানের নতুন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে দেবে তারা, এমন ভাবার কারণ ছিল না। ইমরানবিরোধী হলেও সংগত কারণেই তারা আজাদি মার্চে সামান্যই লোকবল পাঠিয়েছে। বিলওয়াল ভুট্টো এবং আসিফ জারদারির অঙ্ক বুঝতে ভুল করেছেন ফজলুর রহমান। আজাদি মার্চকে সামনে রেখে নওয়াজের মতোই আসিফ জারদারি সরকারের সঙ্গে দর–কষাকষি করছেন মুক্তি পেতে। এসব বোঝাপড়া ব্যর্থ হোক সেটাই চাইবেন মাওলানারা। তবে ফজলুর রহমানের এ–ও ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাঁর পিতার সঙ্গে বিলওয়াল ভুট্টোর নানার ছিল চরম বৈরী রাজনৈতিক সম্পর্ক। সেই তিক্ততাকে পুঁজি করেই একদা জেনারেল জিয়া রাজনৈতিক মঞ্চে এসেছিলেন। পিপিপির কর্মীদের এসব অজানা নেই।
তবে আজাদি মার্চ ফজলুর রহমানকে পাকিস্তানের রাজনীতির কেন্দ্রে স্থাপন করেছে নতুন করে। শরিফ ও ভুট্টো রাজপরিবারের পাশাপাশি ইমরানবিরোধী তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা বিবেচিত হচ্ছেন তিনি। এর বাইরে দীর্ঘস্থায়ী এই সমাবেশ থেকে তিনি কী অর্জন করে নিতে পারছেন, সেটার হদিস পাচ্ছেন না রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা।
কাশ্মীর ফ্রন্টে পাকিস্তান এ মুহূর্তে ইতিহাসের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। দেশটিতে তাই দরকার জাতীয় ঐক্য। সেনাবাহিনী কোনোভাবেই এ সময় দেশের অভ্যন্তরে সহিংস রাজনৈতিক উত্থান-পতন দেখতে চাইবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু, অর্থনীতি উদ্ধারে চরম পরীক্ষার মুখে পুরো পাকিস্তান। এ সময় একটা নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা ভারতের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যুদ্ধাবস্থায় পাকিস্তানকে আরও দুর্বল করবে। ফলে মাওলানা ফজলুর উদ্যোগে সশস্ত্র বাহিনীর আগ্রহ কম।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তানের পুরানো সব সমস্যার পাশাপাশি প্রায় নুয়ে পড়া এক অর্থনীতিও পেয়েছিলেন। অবস্থা সামাল দিতে তিনি চীন ও আইএমএফের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। প্রচুর শর্তের বিনিময়ে আইএমএফ ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে দেশটিকে। এই অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রতার বেদনা এখন বইতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ইমরান যে পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোতেই সমাধান খুঁজবেন, সেটাই স্বাভাবিক। মাওলানারা এই বাস্তবতা জানেন। তারপরও জনগণের দৈনন্দিন কষ্টকে রাজনৈতিক পণ্য করতে প্রলুব্ধ হয়েছেন তাঁরা।
তবে গত নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করতে তাৎক্ষণিক তদন্ত শুরু করতে পারেননি ইমরান। বরং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাড়তি হুমকির মুখে পড়েছে তাঁর আমলে। এসব কারণে মধ্যপন্থীদের মাঝেও ইমরানের তেহেরিক-ই-ইনসাফ সরকার নিয়ে অসন্তোষ আছে। যদিও সেই অসন্তোষ এখনই সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য তৈরি নয়। ইমরানের চেয়ে ভালো বিকল্প নেই পাকিস্তানের সামনে। মাওলানারা তো ননই। গত সাত দশকে ফজলুর রহমান বা অন্য কোনো মাওলানা পাকিস্তানের ভেতরে-বাইরে সরকার পরিচালনার মতো আস্থা তৈরি করতে পারেনি। তাঁরা স্লোগান, হুমকি ও অবরোধে যতটা সফল, রাষ্ট্র ও অর্থনীতি পরিচালনায় তেমন বিকল্প আশাবাদ সৃষ্টি করতে পারছেন না।
পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক মিত্ররা ইমরানের পাশে
আজাদি মার্চ আয়োজনের দিনক্ষণ নির্ধারণেও মাওলানারা স্বল্প বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ কর্তৃপক্ষের বার্ষিক সমন্বয় বৈঠককালে কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানী অংশত অবরোধ করে আছেন তাঁরা এবং আরও অবরোধের পরিকল্পনা করছেন। চীনের প্রকল্পগুলো পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মূল চালিকাশক্তি এ মুহূর্তে। স্বভাবত আজাদি মার্চে চীন সুখী নয়। দেশটির অপর দুই আন্তর্জাতিক মিত্র তুরস্ক ও সৌদি আরবও শক্তভাবে ইমরানের পাশেই রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ফজলুর রহমানকে মদদ দেওয়া আরও দুরূহ। কারণ, তালেবানদের ঘনিষ্ঠ তিনি। আর ওয়াশিংটন চাইছে তালেবানদের চাপে ফেলে মুখরক্ষামূলক একটা চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে বাড়ি ফিরতে।
ইমরান খান এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করতে আগ্রহী। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ইমেজ বদলাতে চান তিনি। ভারতের দিক থেকে চরম বৈরিতার মুখেও পাঞ্জাবের শিখদের সাড়ে চার কিলোমিটার করিডর ছেড়ে দেওয়া তাঁর সেই রণকৌশলেরই অংশ। মোদির নেতিবাচক কূটনীতির বিপরীতে তিনি বড় বাজি ধরেছেন। পিচ খারাপ। কিন্তু মনোযোগের সঙ্গে বল করে যাচ্ছেন। এমনকি মাওলানা সাহেবের লংমার্চে প্রথম ১৫ দিনে একবারও হামলা চালায়নি পুলিশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ হলে নিশ্চিতভাবে যা হতো। এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। ভারতে একদা আই কে গুজরাল এবং ভিপি সিং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ রকম পরিবর্তন ঘটাতে চাইতেন। কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক আয়ু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইমরান দক্ষিণ এশিয়ায় ইতিহাসের বিরুদ্ধেই লড়ছেন মনে হয়।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক