নূর হোসেনের দ্বিতীয় মৃত্যু
এটা কি স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন? দেখছি, নূর হোসেন জুরাইনের কবরস্থান থেকে উঠে এসেছেন। বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঢাকা শহরে। হঠাৎ একদল যুবক তাঁকে ধাওয়া করল। নূর হোসেন ‘এরশাদের দালালেরা, হুঁশিয়ার...’ বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়ানো মাত্রই কোথা থেকে যেন একটি গুলি এসে বিঁধল তাঁর বুকে। তাঁর বুকটা হঠাৎ সবুজ হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে একটা রক্তজবা ফুটল সেই বুকে। সেভাবেই মনে দুঃখ নিয়ে নূর হোসেন আবার ফিরে গেলেন জুরাইনে। সেখানে রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনসসহ অজস্র অপঘাতের শিকারের সারি সারি কবর। নূর হোসেন তারপর কী এক জেদে সেসব কবর খুঁড়ে প্রত্যেকের বুকে-পিঠে লিখে দিতে থাকল, ‘জীবন মুক্তি পাক’!
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। সকালের পত্রিকায় খবর পড়লাম। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা জোশের সঙ্গে বলেছেন, এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেন নাকি ইয়াবাখোর ছিলেন। কথাটা তিনি বলেন নূর হোসেনের মৃত্যুর তারিখে পালিত হওয়া গণতন্ত্র দিবসে, ১০ নভেম্বর। ১৯৮৭ সাল কি সুদূর অতীত? নূর হোসেনের ঘটনা তো এখনো অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তাঁরা কেউ সেখানে ছিলেন না? নূর হোসেনের মাকেও এটা শুনতে হলো? এমন গাঁজাখুরি কথায় ইতিহাসের সত্য বদলাবে না, মসিউর রহমান তা ভালো করেই জানেন। জেনেশুনে তাহলে কেন তিনি এটা বললেন?
হয়তো তিনি জেনেছেন, নূর হোসেনরা পরাজিত হয়েছে। ছাত্র-তরুণেরা পরাজিত হয়েছে। গণতন্ত্র ধরাশায়ী হয়েছে। জয়ী হয়েছে এরশাদীয় রাজনীতির ধারা। আমাদের রাজনীতিতে কেউ ছোট এরশাদ আর কেউ বড় এরশাদ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক আদর্শের মডেলও এরশাদ। আমাদের মধ্যেই ছোট ছোট স্বৈরাচারের বাস। পরিবার থেকে প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্রে সর্বত্রই তাদের নাম। এই ছোট স্বৈরাচারেরা এরশাদের মধ্যে তাদের মনের মানুষের দেখা পায়। তাই পতনের তিন দশক পরও এরশাদ এক প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিত্ব। তাহলে এরশাদকেই বাংলাদেশের রাজনীতির সত্যিকার আদর্শ বলা যাবে না কেন? নির্বাচনহীন একচেটিয়া ক্ষমতার যে রাস্তা তিনি দেখিয়ে গেছেন, সেটাই বাংলাদেশের ক্ষমতাশ্রিত সব দলের স্বপ্নের মডেল। এরশাদ উন্নয়নের কথা বলে অবৈধভাবে যে কৌশলে ক্ষমতা ভোগ করেছেন, সেই ক্ষমতা এখন আইনসিদ্ধ পদ্ধতিতেই ভোগ করা যায়।
একটি সাহসী আত্মদানের ঘটনাকে এভাবে অবমাননা করার যে সাহস মসিউর রহমান পেয়েছেন, তা তিনি পেয়েছেন বাস্তবতা থেকেই। এই বাস্তবতায় আর নূর হোসেনদের প্রয়োজন নেই। তাই যে দলের মিছিলে গিয়ে নূর হোসেন শহীদ হলেন, সেই দলই নূর হোসেনের খুনিদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে। করে বলেই মসিউর রহমান ২০১৪ সালে মন্ত্রী হন আর এবার হন মাননীয় সাংসদ।
নূর হোসেন যেন সেই অমলকান্তি, যে রোদ্দুর হতে চেয়ে হয়েছিলেন ছাপাখানার ভূত। ২৪ বছরের নূর হোসেন কিছুই হতে পারেননি। জাতির মনে তবু এক রূপকথার নায়ক ছিলেন তিনি। ছিলেন আরও অজস্র শহীদের প্রতীক। কিন্তু জনাব রাঙ্গা তাঁকে দেখাতে চান মাদকাসক্ত হিসেবে। যিনি যেমন, তিনি তো তেমনই দেখবেন ও দেখাবেন। নূর হোসেনের সহযোদ্ধারাই–বা কী করেছেন? অনেকে ধনে-মানে বড় হয়েছেন। মন্ত্রী-সাংসদ-আমলা-মিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা হাতে গুনে শেষ করা যায় না। বুকে ও পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখে তিনি নিজেকে গুলির নিশানা করে নিয়েছিলেন। দাফনের সময় অনেক ঘষাঘষি করেও তাঁর গায়ে লেখা বাংলাদেশের সেই ললাটলিখন ওঠানো যায়নি। যে গুলি তাঁর পাঁজরে রক্তজবা ফুটিয়েছিল, সেটিও সেখানেই থেকে গিয়েছিল।
নূর হোসেনের কবর হয়েছিল বেওয়ারিশ হিসেবে। আজকের বাংলাদেশে নূর হোসেনসহ এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সব শহীদও কি বেওয়ারিশ। কে আর তাঁদের উত্তরাধিকারী হয়ে বিপদ ঘাড়ে ডেকে আনতে চায়? নূর হোসেনের আয়ু আত্মসাৎ করেছিল যে রাজনীতি, সেই রাজনীতি আজও গণতন্ত্রকে নূর হোসেনের মতোই বাড়তে দেয়নি। নূর হোসেনের খুনিদের নিয়ে যাঁরা গণতন্ত্রের ককটেল পার্টি জমাচ্ছেন, শহীদ নূর হোসেনকে তাঁরা সফলভাবেই বেওয়ারিশ করে দিয়েছেন।
এরশাদের পতনের পরও নূর হোসেনের পিতা মজিবুর রহমানের হতাশা কাটেনি। তিনি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে বলেছিলেন, ‘নূর হোসেন যা চেয়েছিল, তা তো হলো। স্বৈরতন্ত্র নিপাত হলো। এখনো দেশে এত হানাহানি, সন্ত্রাস। গণতন্ত্র তো মুক্তি পেল না।’ ২০০৪ সালে মৃত্যুর আগে বড় দুঃখ নিয়ে নূর হোসেনের বাবা বলেছিলেন, ‘ছেলেটা যা চেয়েছিল, তা তো হলো না!’ শহীদ পুত্রের পিতা ভেবেছিলেন, ‘নূর হোসেনের মৃত্যুর পর সবাই আমাকে শ্রদ্ধা জানাল। ভাবতে শুরু করলাম, আমিও একটা ইডবিডি পাখি (যে পাখি স্বর্গে যেতে চায় কিন্তু পারে না) হয়ে গেলাম। আমিও সবার সঙ্গে উড়তে পারব। সেটা আমার ভুল। ইডবিডি পাখি কোনো দিন স্বর্গে যেতে পারে না। এখন কোথায় আমার স্থান?’ নূর হোসেনের মা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘দেখেন বাবা, নূর হোসেনের মুখে কি রকম রাগের চিহ্ন!’ বিদায়ের কিছু আগে তিনি মাকে বলেছিলেন, ‘মা, আমি একটা কিছু করার চেষ্টা করছি।’ (শহীদ নূর হোসেন, শামসুর রহমান ও মতিউর রহমান, প্রথমা)
এখন ২০১৯ সাল, সময় আবার আশাহীন। মানুষের মনে আবারও প্রশ্ন: রাত পোহাবার আর কত দেরি পাঞ্জেরি? শহীদের আত্মদান কি সত্যিই বৃথা যায়? তাহলে যে ছাত্রতরুণেরা ‘শত শহীদের রক্ত/ বৃথা যেতে দেব না’, ‘নূর হোসেনের রক্ত, বৃথা যেতে পারে না’ বলে স্লোগান দিয়ে মার খায়, জেলে যায়, তারা কি ভুল?
ইতিহাসের দেবতা তরুণের রক্ত পান না করে সন্তুষ্ট হন না। চিরটা কাল নিষ্পাপ সাহসী তরুণেরাই মানবতার হারানো আত্মাকে ওই ‘ইডবিডি পাখির’ মতো স্বর্গীয় উড়ালের স্বপ্ন দেখায়। এই দেশে এ রকম তরুণের অভাব কোনো দিন হয়নি। আমরাও বারবার গর্ব করে বলেছি, ‘শহীদের আত্মদান বৃথা যেতে পারে না।’ কিন্তু দিনের শেষে সব আশার সমাধিতে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর ভাষায় বলতে হয়, ‘নূর হোসেন, তোমাদের আত্মদান যে আমরা কতবার বৃথা করে দিয়েছি, তোমার বাবা মৃত্যুর আগে সেটা দেখে গিয়েছেন; তুমি সৌভাগ্যবান, তুমি তা দেখোনি।’
ব্রিটিশ মনীষী টমাস কার্লাইল বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে বীর দাও, আমি তোমাদের ট্র্যাজেডি উপহার দেব।’ উদিত দুঃখের দেশ বাংলাদেশ যুগে যুগে বীর জুগিয়ে গেছে। আর এরশাদপন্থীরা তাদের করে দিয়েছে ট্র্যাজিক। মসিউর রহমান দেখালেন, এই সময় ট্র্যাজিক বীরদের নিয়ে পরিহাসও করার সময়। নূর হোসেনের মৃত্যুর পর লেখা কবি শামসুর রাহমানের কবিতাটাই যেন সত্য, ‘বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে!’
আজও।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]