কুন্ডেরার গল্প, আমাদের জীবন

কিছুদিন আগে একটা কাজে মানবাধিকারবিষয়ক অনেকগুলো বই পড়তে হয় আমাকে। এরই একটি ছিল অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ, নাম হিউম্যান রাইটস-এ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন। ‘ভেরি শর্ট’ বলা হলেও বইটি আসলে দুই শতাধিক পৃষ্ঠার এবং গভীর বিশ্লেষণসমৃদ্ধ। সেখানে আমি মিলান কুন্ডেরার একটি গল্পের কিছু বিবরণ পাই। গল্পটা আগে বলি, তারপর গল্প বলার কারণটা।

মিলান কুন্ডেরার গল্পের মূল চরিত্র ব্রিদিত নামের এক ভদ্রমহিলা। তিনি প্যারিসে নামী দোকানে গেছেন এক বোতল ওয়াইন কেনার জন্য। গিয়ে দেখেন গাড়ি পার্ক করার জায়গা নেই সেখানে। কয়েকবার চক্কর দিয়ে বিরক্ত হন তিনি। গাড়ি পেভমেন্টে রেখে দোকানের ভেতর চলে যান। দেখেন, সেখানে নীরবে হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে শখানেক দরিদ্র মানুষ। ধনী খদ্দেরদের বিব্রত করে তারা জানাচ্ছে তাদের এমন প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ সঞ্চারিত হয় ব্রিদিতের মধ্যে। দোকান থেকে ফিরে তঁার গাড়ি ঘিরে রাখা পুলিশের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন তিনি।

পুলিশ তাঁকে জরিমানা করতে চাইছে অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য। পার্কিংয়ের জায়গায় জমাট গাড়িগুলো দেখিয়ে ব্রিদিত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।

‘তুমি কি বলবে কোথায় পার্ক করব আমি? যদি আমাকে গাড়ি কেনার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে পার্কিং কোথায় করব, তার ব্যবস্থাও করতে হবে।’

কুন্ডেরার গল্পে এই অকাট্য যুক্তিতে পুলিশ পিছু হটে এবং জরিমানা না করেই তাঁকে ছেড়ে দেয়।

কুন্ডেরার গল্প আমাদের জীবনে ঘটে অন্যভাবে। স্মৃতি ক্লিষ্ট করে সম্পূর্ণ বিপরীত অভিজ্ঞতাগুলো মনে করিয়ে দিয়ে।

২.
বছর পাঁচেক আগে ধানমন্ডিতে স্কুল থেকে মেয়েকে নিতে এসেছি। স্কুলের পার্কিং নেই, আশপাশে কোনো পাবলিক পার্কিংও নেই। অন্য সবার মতো আমার গাড়িও রাস্তার ওপর রাখে ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নামার পরে দেখি কঠিন চেহারার দুজন পুলিশ এগিয়ে আসছে। হাতে ওয়াকিটকি। আমার ড্রাইভারকে বলল সব কাগজপত্র বের করতে। আমি বিনীতভাবে বললাম: মাত্র পাঁচ মিনিট রাখব ভাই।
কেন রাখবেন?
স্কুল থেকে তুলব বাচ্চাকে।
এখানে গাড়ি রাখবেন কেন? রাস্তা কি পার্কিংয়ের জায়গা?
না। কিন্তু আমাকে বলেন, তাহলে কোথায় রাখব?
সেটা আমি কী জানি?
তাহলে বাচ্চাকে তুলব কীভাবে?
সেটা আপনার সমস্যা।

অবশ্যই আমার সমস্যা। কিন্তু বলেন, কীভাবে এখানে পার্ক না করে স্কুলের বাচ্চা তুলব? কেন সরকার তাহলে আমাদের গাড়ি কিনতে দেয়? কেন বাস ছাড়া স্কুলের অনুমতি দেয়? কী করব আমরা?

আমাদের পুলিশ প্যারিসের পুলিশ না। তারা আমার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। এই ব্যাটা কাগজ দে বলে ধমকায় আমার ড্রাইভারকে।

অসহায়ভাবে ভাবি কী অদ্ভুত দেশ বানিয়েছে এরা। এখানে সরকারি স্কুলগুলোর বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমার মতো অনেককে কষ্ট করে হলেও সন্তানকে প্রাইভেট স্কুলে পড়াতে হচ্ছে। এসব স্কুল খুলতে দেওয়া হয়েছে শহরের কেন্দ্রস্থলে। স্কুলের নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থা নেই, দূর থেকে এলে গাড়ি ছাড়া এখানে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। এখানে এসে গাড়ি পার্ক করার কোনো সুযোগ নেই। ছোট ছোট বাচ্চাকে তোলার জন্য গাড়ি একটু সময়ের জন্য রাস্তায় রাখা ছাড়া উপায় নেই। রাস্তায় রাখলে ফাইন দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

আমার আরেকজন সন্তান পড়ে অন্য এক স্কুলে। শহরের সবচেয়ে নামীদামি এই স্কুলের পাশে রাস্তায় এক সারিতে গাড়ি রাখার নাকি অনুমোদন নেওয়া আছে। আগে আগে আসতে পারলে আমিও গাড়ি রাখি তাই সেখানে। হঠাৎ কয়েক সপ্তাহ আগে দেখি ক্ষীণদেহী এক ব্যক্তি কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে হাজির। নির্বিচারে ভিডিও করে সে সারি করে রাখা গাড়িগুলোর। হতবাক হয়ে খোঁজখবর নিলাম। জানা গেল পার্কিংয়ের জন্য একধরনের ব্যবস্থা আছে, তবে তা মৌখিকভাবে। মামলা খেলে স্কুলের কিছু করার নেই।

এর কিছুদিন পরে ঘটে আরেক বিপত্তি। গুলশানে বড় এক শপিং মলের পার্কিংয়ে ঢোকার জন্য আমার গাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। দেখি সেই লাইনকে নিঃশব্দ সাপের মতো অনুসরণ করে ভিডিও করে যাচ্ছে একজন পুলিশ। আতঙ্কিত হয়ে ড্রাইভারকে বলি এখানেও মামলা দেবে নাকি? আমার ড্রাইভার দাঁত বের করে হাসে!

মামলা হলে তার তেমন অসুবিধা নেই। কী একটা কাগজ আসে আমার কাছে সেখানে নির্দেশ থাকে এত তারিখে আমার ড্রাইভারকে অমুক জায়গায় উপস্থিত করানোর জন্য। সেখানে গিয়ে সে বিকাশ করে জরিমানা দিয়ে আসে কোনো বোধগম্য রসিদ ছাড়া। খবর নিয়ে শুনি এসব নিয়ে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করতে হলে যে ভোগান্তি আর অর্থ খরচ হবে তার চেয়ে বিনাবাক্যে বিকাশে জরিমানা দেওয়া অনেক ভালো।

৩.
সমস্যা আরও অনেক আছে। আমাকে কখনো কখনো রিকশায় চড়তে হয়, কখনো সিএনজিচালিত অটোরিকশায়, গণপরিবহনের বাস, কিছুই না পেলে হাঁটতে হয় বহুদূর। সবখানেই দেখি নানা সমস্যা। রিকশা চলে না এখন অনেক রাস্তায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলে না মিটারে, বাসে থাকে না বসার জায়গা, হাঁটার জন্য নেই ফুটপাত।

ধানমন্ডির ২৭ নম্বর মোড়ে প্রায়ই রাস্তা পার হওয়ার জন্য যুদ্ধে নামি। সেখানে ফুটওভারব্রিজ নেই, জেব্রা ক্রসিং মানার কোনো ব্যবস্থা নেই, ট্রাফিক পুলিশেরও কোনো গরজ নেই পথচারীকে পারাপার করানোর। গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে পার হতে গিয়ে আরও অনেকের মতো আমারও বুকের রক্ত হিম হওয়ার অবস্থা হয় কখনো কখনো। ভাবি যদি মরে যাই এখানেই গাড়ির নিচে, কেউ হয়তো বলবে দোষটা আমারই ছিল। কেন আমি এভাবে পার হলাম রাস্তা? এই প্রশ্নটা থাকবে। উত্তর থাকবে না যে তাহলে কীভাবে পার হব রাস্তা?

আমার সংকট আসলে আমাদের সবার সংকট। আমার চেয়েও অনেক কষ্ট করে রাস্তাঘাট ব্যবহার করতে হয় অনেক মানুষকে। ব্যাকুল হয়ে রিকশা ডাকা, বাস ধরার জন্য ছুটতে থাকা, ট্রাফিক জ্যামে নাকাল হওয়া, রাস্তা পার হতে গিয়ে তীব্র হর্নের গালি খাওয়া কত মানুষকে দেখি প্রতিদিন। গাড়িতে বসে তাদের দুরবস্থা দেখলে অপরাধ বোধ করি, রাস্তায় তাদের সহযাত্রী হলে অসহায় বোধ করি।

৪.
নতুন সড়ক আইন হয়েছে দেশে। আমার কোনো আগ্রহ হয় না ভালো করে পড়ার। জানি যে এই আইনে বড় অঙ্কের জরিমানা আর জেলের শাস্তির বিধান হয়েছে। ভয়ে হয়তো প্রথম কিছুদিন একটু সমঝে চলবে কেউ কেউ। কিন্তু সড়কে দুর্ঘটনার জন্য প্রধান দায় যে বাস-ট্রাকমালিকদের, তাঁদের স্পর্শ করতে পারবে কি এই আইন? এই আইনে কি শাস্তি হবে পতাকাবাহী গাড়ির লঙ্ঘনের? ট্রাফিক পুলিশের জবাবদিহি বাড়বে এতে? এতে কি গাড়ি পার্ক করার সমস্যার সমাধান হবে? জীবন বাজি রেখে রাস্তা পাওয়ার পরিস্থিতি কি বদলাবে? এই আইন প্রয়োগ করার সামর্থ্য আর কমিটমেন্ট কি আসলে আছে সরকারের?

শুধু কঠিন আইন করে দায়িত্ব শেষ হয় না। বরং শুরু হয়। আইন প্রয়োগের তদারকি থাকতে হয়, লঙ্ঘনের শাস্তি নিশ্চিত করতে হয়। সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ আইন লঙ্ঘনের বাস্তব কারণগুলো বের করে তা দূর করতে হয়। শিকড় উপড়ে না ফেলে আমরা যদি কিছু বিষফলকে ছেঁটে ফেলি, তাহলে খুব একটা উপকার হবে না।

তবু দেখা যাক কী হয় অবশেষে। এই নিরুপায় অপেক্ষা ছাড়া আমাদের আর কিছু করারও নেই। কারণ, আমাদের গল্পটা ভিন্ন।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক