কড়াইলের রুমীরা কি হেরে যাবে?
কড়াইল একটা বস্তির নাম। দেশের বহু অঞ্চল থেকে রাজধানীতে আসা গরিব মানুষের বড় এক আশ্রয় এটা। সেই সূত্রে দেশজুড়ে পরিচিতি তার। স্থানীয়রা বললেন, বছরে দুবার ‘আগুন লাগে’ এখানে। বহুবার আগুন লেগেছে। চিরচেনা সেই আগুনে পুড়ে পুড়েই কড়াইল ‘ঢাকা-১২১২’তে টিকে আছে আজও। অসাধারণ তার প্রাণশক্তি।
‘উন্নত’ ঢাকার ‘কলঙ্ক’ও বলা যায় কড়াইলকে। বিশেষ করে যাঁরা ঢাকাকে অটোয়া কিংবা সিঙ্গাপুর হিসেবে দেখতে মরিয়া। প্রচারমাধ্যমে দেখেছি, ‘গুলশান সোসাইটি’র বড় এক দুঃখ, কড়াইলের কারণে গুলশানের লেকের দুর্গন্ধ লাগে তাঁদের নাকে! এটা মেনে নেওয়াও দুঃসহ—গুলশান ও কড়াইল উভয় জনপদের পোস্টাল ঠিকানা ‘ঢাকা-১২১২’!
তবে কড়াইলের অলিগলি ঘুরে মনে হবে এটা চিরচেনা বস্তির মতো নয়। সাংগঠনিকভাবে আরও শক্ত কিছু। আয়তনে, বসতির ধরনে, ভূমির সঙ্গে বাসিন্দাদের সম্পর্কের বিচারে এটা অন্যান্য বস্তি থেকে একেবারে পৃথক। ঢাকার প্রায় ১০০ বড় বস্তির মাঝে কড়াইল তাই একটা বিশিষ্ট নাম।
পুরো কড়াইলকে একটা বড় বাজারও বলা যায়। আবাসিক এবং বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য মিলেই এখানকার অলিগলি। শতাধিক একর জমির ওপর গড়ে ওঠা বিশাল এক অর্থনীতি আছে কড়াইলের পেটের ভেতর। যদিও প্রচারমাধ্যমে কড়াইল ‘মাদকের উৎস’ এবং ‘অবৈধ বসতি’র অধিক কিছু নয় আজও। রাষ্ট্রের জমিনে ভূমিহীন নাগরিকদের অস্থায়ী আশ্রয় কেন অবৈধ, সেই ব্যাখ্যা অবশ্য ওসব প্রতিবেদনে পাওয়া যায় না। যে কেউ কড়াইলে দু-এক দিন থাকলেই কেবল বুঝতে পারবেন, ঢাকার প্রচারমাধ্যমে কড়াইলের বস্তি-সাহিত্য কতটা শ্রেণিবিদ্বেষী মুখস্থবিদ্যা মাত্র।
এই প্রচারযুদ্ধের মূল কারণ কড়াইলের ‘ভূ-রাজনৈতিক’ গুরুত্ব। গুলশান, মহাখালী, বনানীর মাঝখানে এর অবস্থান। এ রকম জায়গায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের একটি বস্তি নগর-মুরব্বিরা এত দিন মেনে নিয়েছেন—সত্যি বিস্ময়কর এটা। তাঁদের ‘বদান্যতা’ কড়াইলবাসীর মুখে মুখে! যদিও তার বিনিময়ে ঘরভাড়া, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল মিলে মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়মিত দিতে হয় অজ্ঞাত পরিচয়ধারী স্থানীয় ‘মুরুব্বি’দের হাতে। ইতিহাসের সব ‘শুদ্ধি অভিযানে’ও সেসব বহাল ছিল এবং আছে। সরকারি জমি হলেও তার বেচাবিক্রি হয় এখানে। তবে তাতে এক দিনের জন্যও নিশ্চিন্তে থাকার নিশ্চয়তা মেলে না। উচ্ছেদের উদ্বেগ চিরসঙ্গী এখানে।
বরাবরই কড়াইলে আগুন লাগে রাতে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এই রহস্যের উত্তর আছে। বুলডোজারের যেখানে শেষ, আগুনের সেখানেই শুরু। রাত মানে তাই চিরকালীন এক উৎকণ্ঠা কড়াইলে।
এখানে সবাই জানে, একদিন উচ্ছেদ হতে হবে। যদিও কেউই জানে না, কোথায় যাবে তারা। রাজনীতিহীন রাজনীতিবিদের ওপর কারওই ভরসা নেই। সামাজিক নেতৃত্ব ও যৌথতা আছে সামান্যই। গায়ে-গায়ে বসত করেও বাসিন্দারা পরস্পরবিচ্ছিন্ন। এটাই এই মানুষদের ভয় ও দুর্বলতার কারণ।
রুমী স্মৃতি পাঠাগারের কিশোর-কিশোরীদের অবশ্য এসব নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বসে নেই। বস্তির বউ-বাজার এলাকায় এই পাঠাগারটি কড়াইল বস্তির বড় চমক বলা যায়। এ যেন ‘জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি’র মতো। বিশাল এক ঘিঞ্জি জনবসতির মাঝে ১২ বাই ২৫ বর্গফুটের এক ছোট্ট আশার খেয়া। দারিদ্র্য ও নিয়তির বিরুদ্ধে একধরনের ঔদ্ধত্যও বলা যায় একে। সুরম্য মহাখালী পেরিয়ে কড়াইলের দিকে যত এগিয়েছি, দেখলাম রিকশাচালক, খুদে দোকানদার, ফেরিওয়ালা, অনেকেই রুমী পাঠাগারকে চেনে। যদিও প্রাত্যহিক জীবনযুদ্ধে এর কোনো তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক মূল্য খুঁজে পান না তাঁরা।
শুধুই একটা পাঠাগারের গল্প নয়
যদিও সংখ্যা ক্রমে কমছে কিন্তু বাংলাদেশের আনাচকানাচে পাঠাগার আছে অনেক। কড়াইলের রুমী স্মৃতি পাঠাগারের গল্পটা সেখানে কিছুটা আলাদা। যদিও প্রায় ১৫০০ বই আছে এই পাঠাগারের সংগ্রহে। তবে এই পাঠাগার কেবল জ্ঞান বিতরণের সাধনায় নেই। এর কারবার কেবল বই নিয়ে নয়। নিম্নবর্গের এক জনপদে সাংস্কৃতিক জাগরণের ভরকেন্দ্র হওয়ার ইচ্ছা তার। পাহাড়সম গরিবির নিচে চাপা পড়া অসংখ্য শৈশব-কৈশোরের অন্তত একাংশকে সুন্দর আগামীর দিকে নিতে চায় রুমী পাঠাগার। ঠিক যে স্বপ্ন ছিল জাহানারা ইমামের সন্তান শাফী ইমাম রুমী ও তার বন্ধুদের।
প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর শেষে সুস্পষ্টভাবেই হিসাব মেলানো যায়। কড়াইলের অনেক কিশোর সকালে খবরের কাগজ বিক্রি শেষে এখন স্কুল কলেজে যায়। গান গায়। অভিনয় করে। ছবি আঁকে। বিকেলে এসে আগের মতোই বাবার দোকানে বসে। বসতেই হয়। করে অন্য সব কাজও। কড়াইলের রুমীদের গেরিলা জীবন শাফী ইমাম রুমীদের মতো না হলেও খুবই কষ্টময়। সবকিছু শেষে রাতে তারা পাঠাগারে আসে। এটা এখন তাদের শুভ আসক্তি। চিরচেনা খারাপ আসক্তির বিরুদ্ধে এভাবেই পাল্টা আসক্তি কিশোর-তরুণদের বাঁচায় হয়তো। কড়াইলের কিশোরদের অক্সিজেন এই বিদ্যাঘর। বছরে ৩৬৫ দিনই খোলা থাকে যা।
স্থানীয় কিশোর-কিশোরীরাই চাঁদা তুলে চালায় এই পাঠাগার। তারা আছে এর পরিচালনায়। বিকাশে। সুবিধাভোগী হিসেবেও। তাদের ‘স্যার’, ‘ভাইয়া’, ‘আপা’ হিসেবে কয়েকজন পরিবর্তনবাদী তরুণ-তরুণীও আছেন। আপাতত কেউই এরা জানে না, কড়াইল বস্তি যখন উচ্ছেদ হবে তখন এই এক টুকরো স্বপ্নভূমি নিয়ে কোথায় পাড়ি জমাবে তারা। তবে হাল ছাড়তে রাজি নয় এখানে প্রায় কেউই। প্রতিদিন পাঠাগারে বসে হাসান, সাকিব, হৃদয়, রিয়াদ, নুশরাত, মুনিয়ারা নিত্যনতুন পরিকল্পনা করছে। হাতে আঁকা ছবির প্রদর্শনী হবে শিগগির। বুয়েট স্থপতি, এমআইএসটির লেকচারার শারমিন সাদিয়া বাচ্চাদের নিয়ে ছবি আঁকার ক্যাম্প করছেন। পাশের টিঅ্যান্ডটি মাঠে মেয়েদের সাইকেল চালানো শিক্ষার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পাঠাগারের সদস্যদের মধ্য থেকে একটা রিপোর্টার টিম গড়ে উঠেছে। বস্তি থেকেই আগামী দিনে দারুণ কিছু রিপোর্টার পাওয়ার আশা কড়াইলের অভিভাবকদের। নাটক ও গানের একটা দল গড়ে তোলার মতো জনশক্তিও ইতিমধ্যে তৈরি এখানে। সবচেয়ে বড় লক্ষ্য, ছোট্ট একখণ্ড জমির স্বত্ব কিনে একটা স্কুল গড়া। স্বপ্ন যেন আকাশ ছুঁতে চায়। আপাতত যার জন্য দরকার পাঁচ লাখ টাকা।
কয়েকজন তরুণ-তরুণীর আদর্শিক নিরীক্ষা
২০০০ সালে রাফসানুল এহসান সাজ্জাদের হাত ধরে কড়াইলে এই পাঠাগারের যাত্রা। এখনো তিনি আছেন। তারকা যুবাদের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির মাঝেই পরিচয় হলো কড়াইলের যুবক সাজ্জাদের সঙ্গে। একটি এনজিওর সংগঠক হিসেবে কড়াইলে কাজ করতে এসেছিলেন তিনি। সেই থেকে এই বসতির শিশু-কিশোরদের নিয়ে তাঁর ‘কিছু করা’র সাধনা। লালমাটিয়ায় এক ডেভেলপার কোম্পানিতে পেশাগত কাজের বাইরে কড়াইলের এই লাইব্রেরি ঘিরেই তাঁর জীবনযাপন। বিশাল এই বস্তির শিশু-কিশোরদের দারিদ্র্যের জিম্মিদশার মাঝে জ্ঞান ও সুস্থ সংস্কৃতির আলো ছড়াতে তাঁর পাশে রয়েছে ছায়েদুল হক নিশান, জসিম উদ্দিন, সীমা দত্ত, ফারজানা মালাসহ আরও অনেকে।
কেউ তাঁরা ব্যাংকার, কেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কেউ নারী আন্দোলনের সংগঠক। রুমী স্মৃতি পাঠাগার তাঁদের দিনান্তের মিলনবিন্দু। আদর্শিক পরীক্ষাগার। কড়াইলের কিশোর-কিশোরীরা রাষ্ট্রীয় বৈষম্য আর সামাজিক ঘৃণা অতিক্রম করে একটা স্বশাসিত ভবিষ্যৎ নির্মাণে যুক্ত হোক এবং সমর্থ হোক, এটাই রুমী পাঠাগারের উদ্যোক্তা তরুণ-তরুণীদের আকাঙ্ক্ষার জায়গা। এই পথচলায় গত অক্টোবরে পাঁচ বছর হলো পাঠাগারের। এর মাঝে প্রচুর সামাজিক বাধাও পেরোতে হয়েছে। পাঠাগারে মেয়েদের আসা, ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে মেলামেশা, পাঠচক্র ইত্যাদি নিয়ে বাধা এসেছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে খুনের হুমকিতেও পড়তে হয়েছে সাজ্জাদ ও নিশানকে। সেসব কমেছেও ইতিমধ্যে। বস্তিতে কিশোরী-তরুণীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছেন ‘রুমী’রা। নিজেদের মাঝে সম্পর্কের ধরনেও এনেছেন পরিবর্তন। অভিভাবকেরাই এখন চান সন্তানেরা অন্য কোথাও না যেয়ে পাঠাগারে যাক। কেবল পড়তে নয়, নিজেদের বদলাতে। ভবিষ্যৎ বদলাতেও।
কড়াইলের শিশু-কিশোর-তরুণেরা তাই দল বেঁধে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে পোস্টার লেখে। লাগায় এখানে সেখানে। বস্তিজুড়ে দেয়ালে দেয়ালে সেসব পোস্টার চোখে পড়ে। বউ-বাজারে জলপাই বিক্রেতা হাসানকে দেখলাম দোকানে ওই রকম দুটো পোস্টার লাগিয়ে রেখেছে। রুমী স্মৃতি পাঠাগারের সদস্য সেও। কলেজে যায় হাসান। বিকেলে বাবার দোকানে বসে। রাতে পাঠাগারে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে কড়াইল বস্তির এই হাসানেরা দেশের যেকোনো বড় বড় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। কিন্তু তারা অসহায় কেবল রাষ্ট্রের মুখোমুখি। তাদের শঙ্কা, থাকার জায়গার পাশাপাশি রুমী স্মৃতি পাঠাগারও হারিয়ে যেতে পারে আসন্ন উন্নয়নের আগ্রাসনে।
আজকের শাফী ইমাম রুমীরা কি হেরে যাবে?
কড়াইলের চায়ের দোকানগুলোতে কান পাতলেই শোনা যায়, অনেক মেগা প্রকল্পের গল্প। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের চূড়ান্ত সব খবর এখানে সবার জানা। যে তালিকায় আছে আবাসন প্রকল্প, হাতিরঝিলের পরিসর বাড়ানো, আইটি ভিলেজ ইত্যাদি বহু কিছু। বস্তির জমিতে আসন্ন এই প্রকল্পগুলোকে ঘিরে শত শত কোটি টাকার বরাদ্দও নাকি প্রস্তুত। এসব প্রকল্প-পরিকল্পনায় শ্রমজীবী ঘরহারা মানুষগুলোর পুনর্বাসনের বিষয়ে কোনো প্রস্তাব আছে কি না, সেটা অজ্ঞাত। রুমী পাঠাগারের রুমীরা তাই জানে না, তাদের ভবিষ্যৎ কী? আইটি ভিলেজে দেশের নানান সুবিধাভোগী মানুষের আরেকটু সুবিধা হবে, সেটা স্পষ্ট। ঢাকার উঠতি মধ্যবিত্তের বেড়ানোর জায়গা বাড়াতে হাতিরঝিলও বাড়ানো দরকার। কিন্তু কড়াইলের রুমীরা তখন কোথায় যাবে, তাদের শিক্ষাজীবনের কী পরিণতি হবে? উন্নয়নের বুলডোজার কি ওদের স্বপ্নও গুঁড়িয়ে দেবে? যদিও ওরা জানে প্রায় পাঁচ দশক আগে পাকিস্তানের সৈনিকেরা শাফী ইমাম রুমীদের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি!
আলতাফ পারভেজ: গবেষক