রাজনীতিতে হিসাবের যত গরমিল
যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে গণমাধ্যমে মাসখানেকের বেশি সময় ধরে তুমুল আলোচনা চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছ থেকে ছাত্রলীগের ছোট নেতাদের কোটি টাকা কমিশন পাওয়ার পর বড় নেতাদের বড় অঙ্কের ‘ন্যায্য পাওনা’ দাবির টেলিফোন ফাঁস হওয়া থেকে সম্ভবত এসব আলোচনার শুরু। এরপর এল হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার বাগানো এবং ক্যাসিনোর কারবারে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাদের অঢেল বিত্তবৈভব অর্জনের কথা। টেন্ডার এবং ক্যাসিনোর মতো পরিবহন ব্যবসাতেও যে উন্নতির গতি প্রায় রকেটের সমান, তা-ও এবার প্রমাণিত হয়েছে। এসব চোখধাঁধানো উন্নতি কীভাবে অস্বীকার করা যাবে? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের এতটা সমৃদ্ধি ঘটে থাকলে মূল দলের নেতারা সবাই কি সাধু-সন্তের মতো সংযম সাধনা করেছেন? তাঁরা কেন আলোচনায় নেই? এখন পর্যন্ত যাঁরা আটক হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, অনেকেই নির্বাচনে মনোনয়নের লড়াইয়ে ছিলেন এবং ভবিষ্যতে নির্বাচন করাই তাঁদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। বলা চলে, তাঁদের এই টাকার পেছনে দৌড়ানোর অন্যতম একটি কারণ নির্বাচন।
গত মাসের ২৯ তারিখে ‘সংসদ নির্বাচনে আ.লীগের চেয়ে ব্যয় বেশি বিএনপির, সবচেয়ে বেশি ব্যয় ইসলামী আন্দোলনের’ শিরোনামে প্রথম আলোতেই একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটিতে নির্বাচন কমিশনের সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে বলা হয় যে রাজনৈতিক দলগুলো গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের যেসব হিসাব বিবরণী জমা দিয়েছে তাতে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৬৩৮ টাকা আর বিএনপির ১ কোটি ১১ লাখ ৩৯ হাজার ১২০ টাকা। সবচেয়ে বেশি ২ কোটি ১৪ লাখ ৮ হাজার ২১২ টাকা ব্যয় করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। আর ওয়ার্কার্স পার্টির ব্যয় ১ কোটি ১৪ লাখ।
প্রতিবেদনটির শিরোনামে অবশ্য বোঝার কোনো উপায় নেই যে বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন জোটের বড় শরিক আওয়ামী লীগের চেয়ে ছোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি খরচের বেলায় বেশি উদার। কথিত খেটে খাওয়া মানুষের দলের এই উন্নতিও কম অর্জন নয়। তবে প্রধান প্রধান দলের নির্বাচনী ব্যয়ে অবিশ্বাস্য সংযম বা কৃচ্ছ্রতা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির গতিধারার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, এমন কোনো প্রশ্ন কেউ করেছেন বলে এখনো শুনিনি। অথচ রাজনৈতিক দলের নেতাদের ব্যক্তিগত জৌলুশ ও দুহাত খুলে খরচ করার যে স্বভাব আমরা নিত্যদিন প্রত্যক্ষ করি, তার সঙ্গে এই নির্বাচনী ব্যয়ের ছবিটা কোনোভাবেই মেলানো যায় না।
নির্বাচনী ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা বোঝার জন্য অতীতের হিসাবে নজর দিলে বিস্ময় আরও বাড়ে। ২০১৪-এর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন এ ক্ষেত্রে খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়, কেননা ক্ষমতাসীনেরা ছাড়া প্রধান দলগুলোর প্রায় সব কটিই সে নির্বাচন বর্জন করেছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি এ ক্ষেত্রে বেশ প্রাসঙ্গিক হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত শেষ ওই নির্বাচন ছিল অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ২০১০ সালের ৮ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘গত নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করেছে বিএনপি’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপি ২৫৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এবং দলীয়ভাবে মোট ব্যয় করেছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর আওয়ামী লীগ ২৬৩টি আসনে প্রার্থী দিয়ে খরচ করেছে ৩ কোটি ৬০ লাখ ২৬ হাজার ৯৭৪ টাকা।
এই দুটি নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব পাশাপাশি রাখলে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির খরচ হয়েছে আগের নির্বাচনের তুলনায় ৪ ভাগের ১ ভাগ। আর আওয়ামী লীগের ৩ ভাগের ১ ভাগ। গত ১০ বছরে জীবনযাত্রায় ব্যয় বা জিনিসপত্রের দাম কোনো বছরেই আগের বছরের তুলনায় কম ছিল না। আমরা কোনো ধরনের মন্দার মুখোমুখি হইনি। বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ৫ শতাংশের মতো ছিল। অর্থনীতির সূচকগুলো যথার্থ হলে রাজনৈতিক দলের প্রচার ব্যয় বাড়া ছাড়া কমার কথা নয়। এ রকম বাস্তবতায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এ রকম অবিশ্বাস্য ব্যয় সংকোচনের ব্যাখ্যা কী?
অবশ্য, আইন করে প্রচারের পরিধি এবং ধরন বদলে দেওয়া হলে হয়তো ব্যয় কিছুটা কমতে পারত। যেমনটি কমেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায়—যখন রঙিন পোস্টার ও ব্যানার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮-এর নির্বাচনে প্রচারের ধরন-ধারণে আইনগত কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এ বিষয়ে সর্বশেষ সংশোধনী আনা হয়েছিল ২০০৮ সালে। সেই সংশোধনী অনুযায়ী, ২০০ আসনের ওপরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল সর্বোচ্চ সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারে। ১০০-এর বেশি ও ২০০-এর কম আসনের জন্য এই ব্যয়সীমা নির্ধারণ করা আছে তিন কোটি টাকা। আর ১০০ আসনের নিচে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা ব্যয় করতে পারবে। স্পষ্টতই, আইনে নির্ধারিত সীমায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এসব দল খরচের ক্ষেত্রে চরম সংযম দেখিয়েছে। সংযমের এই প্রতিযোগিতায় ক্ষমতাসীন দল নিশ্চয়ই বিশ্বে নতুন নজির গড়ে রোল মডেলে রূপান্তরিত হয়েছে।
নির্বাচনী আইনে কমিশনের এসব ব্যয় যাচাই করে দেখার কথা। কিন্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনই একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আইনে নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্নে অসত্য তথ্য দেওয়ার দায়ে প্রার্থীর অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু কখনো কারও দণ্ড হয়নি। দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো অনেক দূরের কথা। নির্বাচন আয়োজন ও পরিচালনায় কমিশনের অযোগ্যতা, দলীয় পক্ষপাত ও নানা ধরনের অনৈতিক আচরণ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু সমালোচনার পরিধি সেখানেই সীমিত রাখা মোটেও কাজের কথা নয়। সমস্যার গোড়ায় আছে রাজনৈতিক দলের আচরণ এবং সেখানে পরিবর্তনের কথা না বললে এ রকম অবিশ্বাস্য নজির আরও অনেকবারই আমাদের দেখতে হবে।
২.
নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সম্প্রতি বিপদে পড়েছেন ক্ষমতাসীন জোটের ছোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন। ১০ বছর ক্ষমতার ভাগীদার হলেও দলটির মাঠপর্যায়ের কর্মীদের অনেকেরই ভাগ্যে খুব একটা হেরফের হয়নি। যাঁরা সাংসদ হয়েছেন, তাঁদের আয়রোজগারে উন্নতি হয়েছে, সম্পদ বেড়েছে, রোশনাই বেড়েছে। দেশের অর্থনীতিতে যেমন বৈষম্য প্রকট হয়েছে, এই বামপন্থী দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যেও তেমনটিই ঘটেছে। বৈষম্য অসন্তোষের জন্ম দেয় এবং দলীয় কংগ্রেসের আগে তা এখন এতটাই তীব্র হয়েছে যে ভিন্নমত এবং ক্ষোভ আর দলের মধ্যে সীমিত থাকেনি। এসব উপদলীয় দ্বন্দ্ব-বিবাদের মধ্যে নিজের অবস্থানকে সংহত করতে তিনি যে ক্ষোভ-অসন্তোষের গতিমুখটা ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন, তা বেশ কিছুদিন ধরেই বোঝা যাচ্ছিল।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি যে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল সে কথা তিনি এর আগে যখন সংসদেই বলেছিলেন, তখনই ওই কৌশলের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়ে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, এমন কথার মধ্যে সুবিধাবাদিতার সাক্ষ্য মেলে। ৩০ ডিসেম্বর যে জনগণ ভোট দিতে পারেনি, নিজেকে তার সাক্ষী দাবি করে মিস্টার মেনন ১৯ অক্টোবর বরিশালে বললেন যে মানুষ এরপর উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদেও ভোট দিতে পারেনি। অতীতে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংগ্রাম করার কথা জানিয়ে তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সংকোচনের অভিযোগও করেছেন। নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে না পারার সাক্ষী হওয়ার পরও সাংসদ হিসেবে তাঁর শপথ নেওয়া বা সেই পদ আঁকড়ে থাকার বিষয়টি তাই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
নির্বাচন-সম্পর্কিত এই ভিন্নমতের মেঠো বক্তৃতায় দলের ভেতরে লাভবান হওয়ার আশা থাকলেও তাঁর মহাজোট ও সরকার যে তা ভালোভাবে নেবে না, সেটা সম্ভবত তিনি বুঝতে পারেননি। ফলে ঢাকায় ফেরার পরই শুরু হয় তাঁর একের পর এক গোলমেলে ব্যাখ্যা। ব্যাপারটা এখন ‘হ্যাঁ-কিন্তু-না-কিন্তু’ (বিবিসির ইয়া বাট নো বাট কমেডি সিরিজ)-এর মতো রঙ্গব্যঙ্গে পরিণত হয়েছে। তবে ১৪ দল তাঁর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা চাওয়ায় এখন নিশ্চয়ই তিনি বুঝতে পারছেন কী নিষ্ঠুর এই ভিন্নমত দমন! প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, বিপদে পড়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর দোষ চাপানোর অভ্যাসটা রাজনীতিকদের ত্যাগ করা প্রয়োজন। স্মার্টফোন এবং মোবাইল সাংবাদিকতার যুগে ভুলভাবে উদ্ধৃত করার অজুহাতটা খুবই আত্মঘাতী।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক