ক্রিকেটারদের দাবি আদায় হয়, শিক্ষক খান লাঠিপেটা
ক্রিকেটাররা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাবি তুললে মানা হয়, কিন্তু যাঁরা তাঁদের শিক্ষা দিয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই শিক্ষকদের করা হয় লাঠিপেটা।
আমার মতো এ দেশে অনেকেই আছেন, যাঁরা এখন প্রাথমিক স্কুলের আপা-স্যার কিংবা দিদিমণিদের মনে রাখেন। শিক্ষক বলতে তাঁদের পোড়খাওয়া মুখের চিত্রই বারবার ভেসে আসে। সেই শিক্ষকদের অনেকেই আমাদের ‘তুই’ করে বলতেন। জীবনে একবারের জন্যও মনে হয়নি এ ডাকে কোনো অসম্মান আছে, বরং আদরমাখা ছিল বলে আজও বুকে বাজে। তাই যখনই সেই শিক্ষকদের পুলিশি নিপীড়নের শিকার হতে দেখি, আমার মনে হতে থাকে, আমার সেই প্রাথমিক জীবনের শিক্ষক অতিথা চাকমা, লুৎফুর রহমান, খেলার শিক্ষক নুরুল ইসলাম, মোতালেব কাঁদছেন।
শিক্ষক হিসেবে তাঁদের কাঁদার কথা নয়। কারণ, শিশুকে শিক্ষামুখী, মানবিক করার প্রথম দায়িত্বটি তাঁরাই নেন। নিজে শিক্ষক হয়েও এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। অনেক দিন ধরেই এ দেশে শিক্ষক আন্দোলন চাঙা হলেও রাষ্ট্রীয় দমননীতির অংশ হিসেবে মারধর, কাঁদানে গ্যাস কিংবা গরম পানির নিপীড়ন এই শিক্ষক আন্দোলনের ওপর দিয়েই গেছে অনেকটা। ২৩ অক্টোবরও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
এদিন শিক্ষকেরা ‘শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য মানি না মানব না’, ‘দাবি মোদের একটাই আদায় ছাড়া যাব না’, ‘দাবি মোদের একটাই ১০-১১ গ্রেড চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়েছেন। দফায় দফায় শিক্ষকেরা সমবেত হয়ে স্লোগান দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষকদের পূর্বঘোষিত মহাসমাবেশ পুলিশি বাধায় করতে পারেননি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। পরে তাঁরা দোয়েল চত্বরে অবস্থান নেন। সেখান থেকে দাবি পূরণ করার জন্য আগামী ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তাঁরা। শিক্ষকদের ওপর পুলিশ লাঠি নিয়ে হামলা করে। এতে সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়।
এই আন্দোলনের মূল জায়গা হলো সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের জন্য দশম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষকদের জন্য ১১তম গ্রেডের ঘোষণা ২০১৭ সালে দেওয়া হয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন না হওয়ায় সারা দেশ থেকে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকেরা ঢাকায় সমবেত হয়েছেন মহাসমাবেশ করার জন্য। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকেরা ১৪তম গ্রেডে ও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকেরা ১৫তম গ্রেডে বেতন পান। আর প্রশিক্ষণ পাওয়া প্রধান শিক্ষকেরা ১১তম গ্রেডে এবং প্রশিক্ষণবিহীন প্রধান শিক্ষকেরা ১২তম গ্রেডে বেতন পান।
এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ দিয়ে হামলা করাই নয়, সরকারি পক্ষ থেকে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার জন্য হুংকারের আলামতও আছে। বেতনবৈষম্য নিরসনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন নিয়ে কঠোর অবস্থানে মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যেই চাকরিবিধি ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘনকারী শিক্ষকদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে (ডিপিই)। এই মহাসমাবেশকে ঘিরে সরকার ইতিমধ্যেই একটি চিঠি ইস্যু করেছে, যেখানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অধিদপ্তরকে (ডিপিই)। সে চিঠিতে ২৩ অক্টোবর যাঁরা অনুপস্থিত থাকবেন, তাঁদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনে যাওয়া শিক্ষকদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইত্যাদি।
এই যখন রাষ্ট্রের অবস্থা, তখন আর শিক্ষা নিয়ে হায় হায় করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। শিক্ষক আন্দোলন কোনোভাবেই শিক্ষা আন্দোলনের বাইরে নয়। আমরা এ-ও জানি, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষার বাইরে গিয়ে ভোটার তালিকা তৈরির কাজও দিয়েছে সরকার বেশ কয়েক বছর থেকেই। সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয় এই প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকদের। কিন্তু যখনই তাঁরা তাঁদের যৌক্তিক আন্দোলন নিয়ে দাঁড়ান, তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়।
বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষক, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও এক হয়ে দাবি জানাতে পারেন না। কারণ, এখানে তাঁরা সবাই সমমর্যাদার মনে করেন না হয়তো। আর এই মনে না করাকে পুঁজি করেই সহজে শিক্ষকদের ওপর নিপীড়ন চালানো যায়। শিক্ষকের অধিকার, দাবি অগ্রাহ্য হয় পুলিশি লাঠির তোড়ে। এ জীবন জেনে গেছে, এ দেশে শিক্ষা ওপর পীড়ন বেশি, আদর্শের ওপর নির্যাতন বেশি। তাই ওরা শিক্ষক নিপীড়ন করে শিক্ষার বড়াই করে।
অথচ সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, কানাডার মতো দেশে, যেখানে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন দেওয়া হয়, তারা কি ভুল করে? শিক্ষকদের ঠকিয়ে শিক্ষার উন্নতি করেছে, এমন কোনো দেশ নেই পৃথিবীতে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]