ফেসবুকে ফাঁসি চাওয়া কেমন আক্রোশ
তেলের ডিপোতে আগুন লাগা ভয়াবহ। মানুষের মনেও রাগের ডিপো আছে। সইতে সইতে তাতে বিপুল জ্বালানিশক্তি জমা হয়। তখন একটা সামান্য স্ফুলিঙ্গ থেকেও ভয়াবহ রাগের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এমন রাগের খপ্পরে পড়ে এ সপ্তাহেই গাজীপুরে বাবার মাথায় রডের আঘাত করে ছেলে হয়ে পড়েন পিতৃঘাতক। সুনামগঞ্জে প্রতিপক্ষের প্রতি হিংসায় শিশুপুত্রকে হত্যা করে বাবা–চাচা। আর সাভারে প্রতিবেশীর বাগান ধ্বংস করে গৃহিণী হন হাজতবাসী। বেশুমার ঘটনা, ঘটছেও ঘনঘন।
সাভারের এক নারী যে দশার ফেরে পড়ে প্রতিবেশীর ছাদবাগানে দা চালিয়েছেন, তার নাম ‘রাগে-দিশাহারা’। কোনো কারণে তাঁর রাগের ডিপোতে আগুন লেগেছে। সে আগুন তিনি সামলাতে পারছেন না। ফেসবুকে সেই তেজস্ক্রিয় ভিডিও দেখে আরও অনেকে যে খেপা খেপলেন, বাপ রে। ভরপুর রাগের ডিপো নিয়ে আমরা হয়ে পড়ছি আপন আক্রোশের বন্দী। অনলাইনবাহিত সেই আক্রোশের দাবানল মন থেকে মনে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ নারীটির ফাঁসিও দাবি করে বসলেন। ফাঁসির নিচে আমরা যেন কোনো বিচারই মানি না! ওদিকে কারা যেন ওই মহিলার বাসা ঘেরাওয়ের ইভেন্ট ঘোষণা করে দিল। মনে হলো, জাতির প্রধান শত্রু পাওয়া গেছে। পরিস্থিতির আতিশয্যে র্যাব-পুলিশ সেই মহিলার বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। অনেকের ভাবটা এমন, বিরাট গডফাদার বা কোনো সিরিয়াল খুনিকে ধরা পড়েছে।
ইতিমধ্যে হারাতে বসলো বুয়েট ও ভোলার হত্যাকাণ্ডগুলো।
এটা বৃক্ষপ্রেম নয়। এটা হলো রাগের প্রকাশ ঘটাবার এক নিরাপদ উপলক্ষ। অমূল্য সুন্দরবন ধ্বংস হচ্ছে, সমতলে ও পাহাড়ে হাজার হাজার একর বন ধ্বংস হচ্ছে প্রতিবছর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নের নামে কাটা হচ্ছে অপরূপ বৃক্ষের সারি। তখন তো এমন রাগের জোয়ার দেখা যায় না! যাঁরা এমন রাগ দেখিয়েছেন, তাঁরাও যে সবাই বিরাট বৃক্ষপ্রেমী তাও না। মানুষ মূলত মহিলার দা–মূর্তিধারী আচরণে ক্ষুব্ধ।
একজনের রাগ দেখে রেগে গিয়ে রক্তপিপাসু হয়ে পড়া যে গাছ কাটার চাইতে বেশি মারাত্মক, কে তা বোঝাবে? এমন রাগের বশেই তো নিরীহ মানুষেরা ছেলেধরা সন্দেহে অন্য নিরীহদের মেরে ফেলে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৬ জন। সপ্তম মাসে মাত্র ৭ দিনেই নিহত আরও ৭ জন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারী, মানসিক রোগী, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধাসহ নিরীহ মানুষ গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন। ওই সময়ই রাজধানীর বাড্ডায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে জীবন দিতে হয় সন্তানের জননী তাসলিমা বেগমকে। সবই রাগের বশে, ভয়ের বশে।
গণপিটুনির মতো গণবিদ্বেষও ভয়াবহ। বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগমের সন্তানেরা জানে, গুজবের গণবিদ্বেষের শিকার ব্যক্তিরা জানেন গণরোষ কতটা ভয়াবহ। যুক্তরাষ্ট্র যখন টুইন টাওয়ারে বোমা হামলার অভিযোগে আফগানিস্তানকে বোমায় ধ্বংস করে দিচ্ছিল তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কথা উঠল যে, আমেরিকার প্রতিক্রিয়া ছিল ‘অ্যাসিমেট্রিক’ বা সামঞ্জস্যহীন। অনুপাত জ্ঞান লুপ্ত হলে একদল সন্ত্রাসীর জন্য একটা জাতিকে শাস্তি দেওয়া যায়। ঠিক যেমন একজনের সাম্প্রদায়িক আচরণের বদলায় শাস্তি দেওয়া হয় পুরো সম্প্রদায়কে। সবই রাগের বশে, ঘৃণার বশে।
প্রতিবেশীর গাছ কাটা দোষের কাজ, দা হাতে তড়পানো সহিংস আচরণ; কিন্তু জনমনে যে বিপুল অসহিষ্ণুতার মজুত, তার ধ্বংস করার ক্ষমতা ওই নারীর চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ফেসবুকে যেভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে, তাতে করে কি তাঁর ও তাঁর পারিবারের জীবন ও সম্মান হুমকিতে পড়ল না? আইন হাতে তোলা যদি অপরাধ হয়, তাহলে ফেসবুকের ‘বিচারক’দের কী বলব? ভোলায় রহস্যজনক অভিযোগে যে তাণ্ডব ঘটল, মানুষের উত্তেজনা যেভাবে পুলিশের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে চারটি মৃত্যু ঘটাল; তা কি আমাদের টনক নড়াবে না? এসব কি স্বাভাবিক সমাজের আচরণ?
আক্রোশ ও গুজব যে সমাজকে তাড়িয়ে বেড়ায়, সেই সমাজে মুহূর্তের রাগে বিরাট হানাহানি লেগে যেতে পারে। সমাজটা হয়ে উঠেছে ভীমরুলের চাক। দিশেহারা ও বিপন্ন মানুষের আচরণ লুকাতে পারছি না। বহু রকম সমস্যায় ভুগছে দেশ। হয় আমরা জানি না সমস্যার গোড়া কোথায় অথবা দায়ী কে বা কারা। জানলেও গোড়ায় হাত দেওয়ার, দায়ীদের মোকাবিলার সাহস তলানিতে। বছরের পর বছর এমন চলতে থাকলে স্নায়ু ভেঙে পড়ে, যুক্তিবোধ লোপ পায়। হতাশায় নিজেকে খাওয়া আর হিংসার বশে অপরকে হত্যা করায় একদিকে থাকে মৃত মানুষ, অন্যদিকে থাকে মানবতা মরে যাওয়া খুনি।
অবস্থাটা ভয় পাওয়া বিড়ালের মতো। শান্ত বিড়ালটা আর হুলো বিড়ালের খামচানি নিতে পারছিল না। একদিন সেও সহিংস হয়ে উঠল। কিন্তু শত্রু বিড়ালটাকে নয়, সে খামচাতে গেল তার মেন্টরকে, যে তাকে খেতে-শুতে দেয়, আদর করে। রাস্তার রাগ ঘরের বউ-বাচ্চার ওপর ঝাড়ার মতো ব্যাপার। সমাজ মনস্তত্ত্বের ভাষায় একে বলে রিডিরেক্টেড অ্যাগ্রেসন বা ‘দিশাহারা আক্রোশ’। বন্দীরা কারাগার ভাঙতে না পারলে মাথা ভাঙে নিজের বা সহবন্দীর। স্বচক্ষে দেখেছি, অসহায় এক বন্দী কিছুদিন দেয়ালে মাথা ঠুকল, তারপর একসময় ঝাঁপিয়ে পড়ল তার সহবন্দীর ওপর। ওই বিড়ালের মতোই তখন সে দিশেহারা।
আপন আপন আক্রোশের বন্দী যারা তারা অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়াতেই খুশি হবে, রক্তপিপাসু হবে। সমাজটা এতে করে আরও ‘ক্যানিবালিস্ট’ বা ‘মানুষখেকো’ হয়ে পড়ছে কি না, ভদ্রমহোদয়গণ সে দিকে যেন একটু খেয়াল রাখেন। মনে রাখা ভালো, গণহিংসার আগুন একবার জ্বলে উঠলে তা নেভানোর সাধ্য কোনো দমকল বাহিনীর নেই।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]