সাংসদ বুবলী ও হারুন: কেউ কারও চেয়ে কম না
তিন বছর আগে আইন কমিশনের এক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ন্যায়বিচার দিতে না পারলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, ন্যায়বিচার কে দেবে? এটা শুধু বিচার বিভাগের কাজ নয়। অথচ এই ধারণাই সমাজে তৈরি করা হচ্ছে। সরকার বা সরকারি দলের যে যখনই ন্যায়বিচারের কথা বলেন, তখনই তাঁদের মনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা মনে আসে। সবাই ধরেই নেন যে যাঁর যা দায়িত্ব সেটা তাঁরা পালন করবেন না, সবটা করবেন আদালত।
আমরা চলতি সপ্তাহে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ ও সংরক্ষিত আসনে সরকারদলীয় নারী সাংসদ তামান্না নুসরাত বুবলীর দুটি নৈতিক স্খলন দেখলাম। শুল্কমুক্ত দামি গাড়ি আমদানি করে তা শর্তভঙ্গ করে বেচে দেন হারুনুর রশীদ। তাঁর পাঁচ বছরের দণ্ড ঘোষিত হওয়ার পরে বিএনপিও নীরব। অন্যদিকে তামান্না নুসরাত পরীক্ষায় চূড়ান্ত অসাধু উপায় অবলম্বনের অভিযোগে অভিযুক্ত। নীরব তাঁর দলও। অবশ্য হারুন ও বুবলীর মধ্যে মিল আছে। সেটা হলো ষড়যন্ত্র–তত্ত্বে। উভয়ে বিশ্বাস করেন তাঁরা ষড়যন্ত্রের শিকার। এদিকে কাকতালীয় হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো দুই বড় দলীয় দুই সাংসদ একত্রে স্খলন ঘটার প্রমাণ দিয়েছেন।
কিন্তু আমরা চাই, জাতীয় সংসদ এই দুই সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক। হারুন শাস্তি পেলেন, বুবলী রেয়াত পাবেন তা হয় না। নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। সংসদের সামনে অনেকগুলো বিকল্প রয়েছে। প্রথম দরকার সংসদনেতার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাষ্ট্রপতি এই বিষয়ে সংসদনেতাকে পরামর্শ দিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির এই সাংবিধানিক এখতিয়ার অন্তর্নিহিত। ব্রিটেনে ১৬৬৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ৬০ জন এমপি হাউস অব কমন্স থেকে অপসারিত হন। ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স অনুসৃত এই নীতি ভারতীয় সংসদ গ্রহণ করেছে। আর সেটাই সংসদীয় রীতি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। সুতরাং বাংলাদেশ সহজেই তা বিবেচনায় নিয়ে দুই সাংসদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে।
সংসদের পক্ষ থেকে প্রায়ই আইনের শাসনের কথা বলা হয়। নেতারা কোনো কিছু হলেই জনগণকে বুঝিয়ে থাকেন যে কাজ কেবল আদালতের। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। সংসদ এই উদ্যোগ নিলে রাজনৈতিক সমাজে ভালো প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের সংসদ যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলেও সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তাঁদের বলা দরকার, কেন আপনার কাজটা সারছেন না। নির্বাচনে জালজালিয়াতি বেড়ে যাওয়ার এটাও অন্যতম কারণ। তাঁরা সবকিছু নিয়ে রাজনীতি করেন। আপিল একটা ঠুকে তাঁরা বছরের পর বছর পার করেন। মন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেন আদালতের দোহাই দিয়ে। দুই বছর দণ্ডের ঘোষণা কখন থেকে ধরা হবে, এই বিষয়ে সংসদে কোনো আলোচনা হয় না। এর থেকে বড় কপটতা আর কী হতে পারে?
সাংসদ জড়িত আছেন, এমন বিষয়ে তাঁরা আপ্তবাক্য আওড়ান। সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন: এটা তদন্তের বিষয়, তদন্ত না করে কিছু বলা যাবে না বা এটা বিচারাধীন, বিচার না করে বলা যাবে না। এসব খোঁড়া যুক্তির জায়গা থেকে তাঁদের বেরোতে হবে। তাঁরা প্রায়ই দায়মুক্তি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাঁরা বলেন, দেশে খুনের বিচার বিলম্বিত হয়। কিন্তু খুনি সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংসদকে কখনো দেখিনি। সাংসদেরা সংসদীয় দায়মুক্তি ভোগ করে চলেছেন। টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যার প্রধান আসামি আমানুরকে নিয়ে বর্তমান সংসদ যা দেখিয়েছে, তাতে কোনোভাবেই এটা মনে করার কারণ নেই যে তারা আইনের শাসনে বিশ্বাস করে। কিংবা তারা মনে করে যে ন্যায়বিচার না দিতে পারলে গণতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে। বুবলী আওয়ামী লীগের বড় ধরনের কোনো প্রভাবশালী নেতা নন। ক্যাসিনো–কাণ্ডে যুবলীগ ডিলেমা তাঁদের বেলায় আসবে না। বিএনপির নেতাটিও জিয়া পরিবারের বিশেষ কেউ নন। তাই রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার হওয়ার অভিযোগ খুব জমবে না। যদি একই সঙ্গে এই দুই সাংসদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, তাহলে বিরোধিতার ভিত্তি থাকে না।
জানি, প্রথমেই অপসারণের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। কিন্তু নীরবতা ভাঙতে হবে। ১৯২০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বনাম বারবার মামলায় ব্রিটিশ হাইকোর্ট বলেছিলেন, প্রয়োজনে সাংসদকে নিন্দা, তিরস্কার বা অপসারণ করা যাবে। বিলাতি দৈনিক ‘গার্ডিয়ান’–এ বাংলাদেশের বুবলীর বর্ণাঢ্য আলোকচিত্র মনে করিয়ে দিল, এমন খবর ফলাও করে কেন এ খবরটা ছাপাতে হবে। কারণ, সেটা সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশের পত্রিকা।
সাংসদ বুবলী পরীক্ষায় নকল করার জন্য তাঁর মতো দেখতে আরও আটজন বুবলী ভাড়া করেছিলেন। দুর্দান্ত মেধার ছাপ। এদিকে হারুনুর রশীদ তাঁর বিলাসবহুল হামার গাড়িটা বিলাত থেকেই এনেছিলেন। বিলাতি গাড়ি নেব, বিলাতি ঐতিহ্যের ধারকবাহক হবো, রাজনৈতিক আশ্রয়দানের জন্য কৃতজ্ঞ থাকব; অথচ বিলাতি তেতো জিনিসগুলো, যা আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর তা নেব না। সেটা কেমন কথা!
সুতরাং অনেকেই আশা করবেন যে পরীক্ষায় নজিরবিহীন দুর্নীতির দায়ে তামান্না নুসরাত বুবলী ও দুর্নীতির দায়ে হারুনুর রশীদকে সংসদে অন্তত তিরস্কার করা হোক। আমি ব্যক্তিগতভাবে উভয়ের বহিষ্কার আশা করি। বুবলী তাঁর প্রয়াত জনপ্রিয় স্বামীর ভাবমূর্তি পুঁজি করে রাজনীতিতে পা রেখেছেন। গৃহবধূ থেকে অনেকেই রাজনীতিতে সফল হয়েছেন। সুতরাং তাঁরও অধিকার রয়েছে। এমনকি তিনি পরীক্ষায় দুর্নীতি করেছেন বলে ক্ষমা চাইছেন, আবার সে জন্য অন্যের ঘাড়ে দোষও চাপাচ্ছেন। চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরকে দেওয়া সাক্ষাৎকার দেখলাম, ক্ষমা চাওয়া এবং দুঃখ প্রকাশ করাটা অন্তর থেকে এসেছে বলে মনে হয়নি। বরং বলেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। এ জন্য তিনি তাঁর এপিএসকে দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। বুবলীর জন্য তাঁর এলাকার নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত কোনো মিছিল বা প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। হারুনুর রশীদের জন্যও মানুষ রাস্তায় বোরোয়নি।
বুবলী ও হারুন উভয়ে প্রায় একই ধরনের জটিল পারিবারিক আবহ মোকাবিলা করছেন। আমাদের দেশে হিন্দি ছবির কুটনামিনির্ভর সিরিয়ালগুলো নাকি জনপ্রিয়। এর দুটি কাহিনি বুবলী ও হারুনের সঙ্গে মেলে।
মেয়র লোকমান জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর মেয়রের সিংহাসন নিয়ে দেবর–ভাবি লড়াইয়ে নামেন। ভাবি দেবরের কাছে হারেন। দেবর মেয়র হন। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করেও বুবলী হারেন। এরপর দেবরের অন্তর্দলীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলান। এভাবে সাংসদ হন। অথচ দেবর–ভাবির মূল পুঁজি লোকমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ২০১১ সালে লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর আট বছর কাটল। অভিযোগপত্রে নারাজি দিলেন এজাহারকারী মেয়র। বুবলীর অবস্থান জানতে পারিনি। স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে তিনি আন্দোলনে আছেন, তা জানা যায় না। যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা জনপ্রিয় মেয়রের ঘাতকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, সেই ব্যবস্থা খুব সহজেই তাঁর বিধবা স্ত্রীকে সংসদে এবং ভ্রাতাকে মেয়র নির্বাচিত করতে পারে, সেই ব্যবস্থা ঘাতকদের খুঁজে পায় না, বিচার করতে পারে না। বরং ভ্রাতা ও স্ত্রী সেই ব্যবস্থারই সেবক বনে যান।
সাংসদ হারুনও কিন্তু পারিবারিকভাবে জটিল অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা কণ্টকিত, তারও একটা নজির হারুন পরিবার। হারুনের ভাই সাবেক সাংসদ। বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুদকীয় ফরমান জারি হয়েছে। তাঁর পরিবারের নামে প্রায় ৩০০ দলিলের নাকি খোঁজ মিলেছে। এ ক্ষেত্রেও কি সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান তাঁদের ছাড় দিয়ে এগোবে?
সংসদই হওয়া উচিত সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নৈতিকতার উৎস। মাও সেতুং বলেছেন, পলিটিকস মাস্ট বি ইন কমান্ড। রাষ্ট্রের সব অঙ্গের জন্য এটা সত্য। তবে এই পলিটিকস একচোখা, পক্ষপাতদুষ্ট নয়। সংসদকেই দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা না করে আমরা দুদক ও আদালতের কাছে প্রতিকার চাইলে তো হবে না। একটি রাষ্ট্রের সংসদে রাজনৈতিক নৈতিকতা থাকবে না, সেই ঘাটতি বাংলাদেশের কোনো বিচারব্যবস্থা, কোনো আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা, কোনো কিছুই পূরণ করতে পারবে না। তাই বলি কি, আরও বিলম্ব হয়ে যাওয়ার আগেই অন্তত সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে তিরস্কার করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। বিলাতি রেওয়াজ কিন্তু বলছে, সংসদ যে কারণে ব্যবস্থা নেবে, সেই কারণে ফৌজদারি অন্য প্রকারের ব্যবস্থা নেওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত হবে না।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]