গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। তবে গত এক দশকে এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি কিছুটা মন্থর হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমে এসেছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে। যেমন, ‘স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১৯’ শিরোনামে জাতিসংঘের এক সর্বসাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০০৪-২০০৬ সালে অপুষ্টির শিকার মোট মানুষের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার, আর এক দশক পর ২০১৮ সালে তা সামান্য বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ৪২ লাখ। অর্থাৎ, গত এক দশকে মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হিসাব বিবেচনায় রেখে এখনকার অপুষ্টির শিকার মানুষের মোট সংখ্যা হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের অপুষ্টি দূরীকরণের গতি হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতি ৬ জন মানুষের মধ্যে একজন অপুষ্টির শিকার। ৫ বছরের কম বয়সী ৩৬ শতাংশ খর্বকায় (উচ্চতা কম), ৩৩ শতাংশ কৃশকায় (ওজন কম)। জন্মের সময় শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম হলে তারা খর্বাকৃতি ও কৃশকায় হয়ে বেড়ে ওঠে; অনেক শিশুর অকালমৃত্যু ঘটে। স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শিশু জন্মের হার একটা সময় কমতে শুরু করেছিল, কিন্তু এখন তা আবার বাড়ছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে। প্রসূতি মা অপুষ্টির শিকার হলে সন্তানের জন্মের সময় ওজন কম হয়ে থাকে। মায়ের অপুষ্টির কারণে সদ্যোজাত শিশুর বুকের দুধ প্রাপ্তি অনিশ্চিত হতে পারে; বাংলাদেশে ৪৫ শতাংশ শিশু জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শুধু বুকের দুধ পায় না। ২২ শতাংশ কিশোরীর উচ্চতা কম। এ ছাড়া নারীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার হারও অনেক বেশি।
এই পরিস্থিতি দুঃখজনক; বিশেষত আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যখন ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে বলা হচ্ছে। এটা জাতীয় অর্থনীতির আরও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকও বটে। কারণ, অপুষ্টির শিকার মানুষের ভারে সার্বিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। কোনো কোনো বছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য খাতের কোনো কোনো সূচকের কিছু অগ্রগতি দেখা যায় বটে, কিন্তু সব সূচকে ধারাবাহিক অগ্রগতি না হলে সার্বিক বিচারে তাকে টেকসই অগ্রগতি বলা যায় না। তাই আমরা ‘অপুষ্টির চক্র’ থেকে বেরোতে পারছি না—এমন কথাও যথার্থভাবেই বলা হয়ে থাকে।
কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির ধারাবাহিক অগ্রগতি সত্ত্বেও আমরা কেন অপুষ্টির চক্র থেকে মুক্ত হতে পারছি না? বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, অপুষ্টির চক্র থেকে বেরোতে হলে পুষ্টি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ালে শুধু যে অপুষ্টিই দূর হবে তা নয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আইওআই) বিষয়ে ডেনমার্কের সংস্থা কনসেনসাস সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, পুষ্টি খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের ফলে জিডিপি ৩ থেকে ৮ শতাংশ বাড়তে পারে।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে কি পুষ্টি খাতে বিনিয়োগ কম? মোটেও তা নয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুষ্টি খাতের মোট বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। সরকারের ১৩টি মন্ত্রণালয় ২৯১টি প্রকল্পের পেছনে ব্যয় করেছে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা।
কিন্তু ফল কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সূচকেও দেখা যাচ্ছে, ফল সন্তোষজনক নয়। কারণ, এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া অনুসরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র ঘাটতি আছে। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুবিবেচনা, সঠিক নজরদারি ও জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।