নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে: নুরুল
বুয়েটের ছাত্রহত্যা ও ছাত্ররাজনীতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রিয়াদুল করিম।
প্রথম আলো: বুয়েটের একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। একজন ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে আপনি এই বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
নুরুল: বর্তমানে সামগ্রিকভাবে এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা চিত্র। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের যে দখলদারি চলছে, যে নির্যাতন–নিপীড়ন চলছে শিক্ষার্থীদের ওপর, এটি তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর আগেও অনেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মারা গেছে। এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আবু বকর মারা গেছে। এসএম হলের শিক্ষার্থী ছিল হাফিজুর মোল্লা, ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়ে, গেস্ট রুম নির্যাতনের শিকার হয়ে বারান্দায় থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এসএম হলের আরেকজন ছাত্র এহসান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সামান্য একটা ক্যালকুলেটর ধার দিয়েছিল, সেটা চাইতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী সেই ছাত্র কষ্টে দেশ ছেড়েছে।
বুয়েটের ঘটনাটা আজ ভালোভাবে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক ঘটেছে। সেদিক থেকে আমি বলব, এটা হলো সামগ্রিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের একটা কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা চলছে, সেখানে যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রথম আলো: দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এই ধরনের নির্যাতন চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে গেস্টরুম কালচার আছে। এটা বন্ধ করার জন্য ডাকসুর কোনো উদ্যোগ আছে কি না?
নুরুল: আমি একজন সাধারণ ছাত্র থেকে এই ডাকসুর প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমে আমিও থেকেছি, গেস্টরুমে নির্যাতিত হয়েছি। সুতরাং ওই জায়গা আমি খুব ভালোভাবে জানি এবং ব্যথাটা অনুভব করি। সেই জায়গা থেকে নির্বাচনে আমাদের প্রধান একটা অ্যাজেন্ডা ছিল, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করব। গণরুম, গেস্টরুম, ভিন্ন মত দমনে নির্যাতন–নিপীড়ন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেব। ভিন্নমতের ছাত্ররা যাতে পরিপূর্ণভাবে কাজ করতে না পারে, সে জন্য একটি বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে, যে নির্বাচনের ফলাফল হয়েছে ভোর রাতে। সে কারণে সাধারণ ছাত্ররা ভোট দিয়ে অনেককে নির্বাচিত করেছে, কিন্তু তাদের ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। আমরা দুজন, আমি ও সমাজসেবা সম্পাদক ভিন্ন মতের থেকে নির্বাচিত হয়েছি। আমরা কাজ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই যে ছাত্রলীগের একটা দখলদারি, এটা শুধু ছাত্রলীগের দখলদারি নয়; এটা বাংলাদেশের পলিটিকসের একটা বৈশিষ্ট্য।
৯০-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তাদের ছাত্রসংগঠন এই ক্যাম্পাসগুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার মধ্যে ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এখন ছাত্রলীগ করছে। যেহেতু আওয়ামী লীগ একাধিকবার ক্ষমতায়, তাই তারা একটু বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের এই অপকর্মের সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দলকানা প্রশাসন। কারণ, এখন তো প্রশাসক হিসেবে যাঁরা দলীয় আনুগত্য ভালো পালন করতে পারেন, তাঁদেরই দেওয়া হয়। গত ৩১ মার্চ এসএম হলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিল অছাত্র বহিরাগতদের বিতাড়নের। ডাকসু নির্বাচনের পরে তারা ভেবেছিল হয়তো অন্তত এটার একটা পরিবর্তন হবে। সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ফরিদ নামে উর্দু বিভাগের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থীকে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিচার চাইতে গিয়ে আমি, শামসুন্নাহার হলের ভিপি ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত ও হামলার শিকার হয়েছি। সেই হলের প্রভোস্টও ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। সে ঘটনার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাত দিনের সময় নিয়েছিল। এখন পর্যন্ত করেনি। এই যখন বাস্তবতা এখান থেকে ভিপি হয়ে বা সমাজসেবা সম্পাদক হয়ে দুজনের কাজ করাটা খুবই কঠিন। কারণ, আমরা বলেছি যে ক্ষমতাসীন দল যারাই থাকে তাদের এই অপকর্মের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করে এই দলকানা প্রশাসন। সেই জায়গা থেকে আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও যে কদিন দায়িত্বে আছি, করে যাব। দীর্ঘদিন এই অপরাজনীতির চর্চা, শিক্ষার্থীরা ভয়ে অনেক সময় কথা বলতে পারে না। কিন্তু যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, যেমন আবরারের মতো ঘটনা দেখে শিক্ষার্থীরা কিন্তু শৃঙ্খল ভেঙে প্রতিবাদ করতে মাঠে নেমেছে। এ ধরনের ঘটনাগুলো যখন হয় তারা প্রতিবাদ করে। আমরা তাদের প্রতি আহ্বান জানাই শিক্ষার্থীদের জাগতে হবে, অন্যায় অনিয়ম–নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে। তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। অন্যথায় শুধু একজন ভিপি বা একজন সমাজসেবা সম্পাদক কখনো ওইভাবে পরিবর্তন করতে পারবে না।
প্রথম আলো: মত প্রকাশের কারণে বুয়েটের মতো একটি শীর্ষ বিদ্যাপীঠের একজন ছাত্রকে পিটিয়ে মারা হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ধরনের অভিযোগ আছে। এই অসহিষ্ণুতা কেন বলে মনে করেন?
নুরুল: এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটা বাংলাদেশের যে রাজনীতিক ধারা চলছে, যে ভিন্ন মতের মানুষ শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা নয়, ভিন্নমত প্রকাশ করে সাংবাদিকেরা নির্যাতিত হচ্ছেন, বুদ্ধিজীবীরা হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। আর ছাত্ররা এর বাইরে থাকবে না। এই যে একটা নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা চলছে, সেখানে যারাই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, ভিন্নমত পোষণ করছে, তাদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। সেখানে ছাত্ররা যেহেতু সব সময় এই উপমহাদেশে পরিবর্তনের সূচক হিসেবে কাজ করেছে, সে জন্য ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা যারা কথা বলছি মানুষের মুক্তমতের পক্ষে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য, তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রাটা একটু বেশি হচ্ছে।
রাজনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এর সর্বোচ্চ নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েও চারবার ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের হাতে হামলার শিকার হয়েছি। কোনো একটি ঘটনায় একটি জিডি নেয়নি, কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। প্রকাশ্যে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। বগুড়াতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার এলাকা গলাচিপাতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। সব ঘটনায় তারা বলে যে লিখিত দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা কি এগুলো দেখছে না? মিডিয়াতে আসছে। সে জন্য বলছি, রাষ্ট্রই এই সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছে।
নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করার জন্যই আমরা মনে করি যে, এই ধরনের অপরাজনীতির চর্চা করা হচ্ছে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দমন–পীড়নের মাধ্যমে অন্যদের বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে যেখানে ছাত্রদের রেহাই দেওয়া হচ্ছে না, অন্যদেরও কোনো ধরনের রেহাই দেওয়া হবে না। এর বিরুদ্ধে আজকে শুধু ছাত্রসমাজ নয়, জনগণকেও জাগতে হবে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে।
প্রথম আলো: আপনি একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে আলাদা প্ল্যাটফর্মে গেলেন। এই পর্যন্ত কতবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন?
নুরুল: এই পর্যন্ত গত বছরের ৩০ জুনের কথা আমি বলব, প্রথম বর্বর আক্রমণটা গত বছরের ৩০ জুন হয়। সেখান থেকে আজ পর্যন্ত ছাত্রলীগের হাতে আটবার হামলার শিকার হয়েছি। প্রতিটি হামলার ভিডিও ফুটেজ, ছবি আছে। মিডিয়া একাধিকবার নিউজ করেছে তথ্যপ্রমাণসহ। একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। এমনও হয়েছে যে জিডি করতে গিয়ে পুলিশ আমাদের বসিয়ে রেখেছে। আমাদের জিডিও নেয়নি।
প্রথম আলো: এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হলের সিটকেন্দ্রিক রাজনীতিকে কীভাবে দেখেন?
নুরুল: সিটকেন্দ্রিক রাজনীতি এখন চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে কিন্তু এই রাজনীতির পিছে আরও কারণ আছে। বাংলাদেশে যখন স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় ছিল, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ হতো। কিছু মেধাবী ছাত্র নেতৃত্বে থাকত, ছাত্রদের জন্য কাজ করতে পারত। পরে গণতান্ত্রিক মুখোশে যারা এল, তারা প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়–কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রেখেছে। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছিল, এই ছাত্ররা যেকোনো সময় একটা পরিবর্তনের সূচক হয়ে যেতে পারে। ক্ষমতায় থেকে যারা অপকর্ম করবে, জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে পারে, তাতে তাদের শাসনব্যবস্থা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। সে কারণে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেজুড়বৃত্তিক একটি ছাত্ররাজনীতি চালু করল।
এখন ছাত্ররা কিছুটা হলেও ভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজপথে প্রতিবাদ করছে। আমরা প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, এই ছাত্রদের মাধ্যমেই সিটকেন্দ্রিক, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির পরিবর্তন আসবে। সে জন্যই তারা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে।
প্রথম আলো: ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি বিশেষ করে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল যে রাজনীতিটা করে সেটা ছাত্রদের জন্য কতটুকু উপকারী?
নুরুল: ক্ষমতাসীন দল হিসেবে যারা নব্বইয়ের পর থেকে ক্ষমতায় ছিল, তাদের রাজনীতিতে আমি শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় খুব একটা দেখি না। তারা রাজনীতি করে মূল দলকে ক্ষমতায় নেওয়ার জন্য বা যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা ক্যাম্পাসগুলোতে ভিন্নমত দমন করে ক্যাম্পাসগুলো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য। আবার যারা বিপরীতে থাকে, তারা ক্যাম্পাসগুলো অস্থিতিশীল করা কিংবা বিশেষ করে নানা অপতৎপরতার মাধ্যমে ছাত্রদের অসৎ কাজে ব্যবহার করার একটা প্রবণতা থাকে। সে জন্য আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোর দিকে যদি তাকান, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন এই ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ তারা বড় বড় ছাত্রসংগঠন, তারা কি একটা প্রতিবাদ করেছে যে আমরা রাজপথে নামব। ছাত্রদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব। করেনি। সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের তাগিদে একত্র হয়েছিল।
একইভাবে গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলন, এটা ছাত্রদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। সে আন্দোলনে ক্ষমতাসীন দলই নির্যাতন–নিপীড়ন চালিয়ে আন্দোলন দমনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করেছে। শিক্ষার্থীরাই আবার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাদের দাবি আদায় করেছে। সেখানে আমরা নির্যাতিত হয়েছি। সেখানে ছাত্রলীগ–ছাত্রদল বড় বড় সংগঠনের দৃশ্যমান ভূমিকা ছিল না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা আমরা দেখেছি হেলমেট পরে আন্দোলনে হামলা করতে। এই যে তাদের অপরাজনীতি সেটা স্পষ্ট যে তারা ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে রাজনীতি করে না।
প্রথম আলো: বুয়েটের শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে আপনার মত কী?
নুরুল হক: বুয়েটের শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি তুলেছেন, সেগুলো যৌক্তিক। হত্যাকারীদের বিচার, ক্ষতিপূরণ, প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করা—এই দাবিগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি আসা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। একজন ছাত্রকে পিটিয়ে মারার পরও উপাচার্য কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি, শিক্ষার্থীদের সান্ত্বনা পর্যন্ত দেননি। আর হলের প্রাধ্যক্ষেরও পদত্যাগ দাবি করা উচিত। তিনি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দিতে গড়িমসি করেছেন। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধেরও দাবি তুলেছেন। যে ছাত্ররাজনীতির অতীত গৌরবোজ্জ্বল, সেটা নিষিদ্ধের দাবি কেন উঠল, সেটাও ভাবতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ না থাকায় অর্থ, পেশিশক্তি ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে। সে কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন। আমার মনে হয়, তাঁরা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন।
প্রথম আলো: ডাকসুতে বেশির ভাগ ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত। এখানে আপনি কতটুকু মত প্রকাশ করতে পারেন?
নুরুল: এখানেও একই চিত্র। অনেক সময় মতামত দিলেও সেটা নেওয়া হচ্ছে না। ডাকসুর সর্বোচ্চ পদে থেকেও দেখা যাচ্ছে মতামত উপেক্ষা করে অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অজুহাতে এবং প্রশাসন যেহেতু তাদের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করছে সেখানেও বিশেষ করে যারা সংখ্যায় বেশি আছে, তাদের জন্য বলা চলে সুবিধামতো সিদ্ধান্ত নিতে তাদের সুবিধা হয়।
প্রথম আলো: আবরার হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে আপনারা কী করবেন?
নুরুল: আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সাময়িকভাবে লোকদেখানো কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, সেগুলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। সে জন্য আমরা বলেছি, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব। এবং আমরা সারা দেশের শিক্ষার্থীদের আবরার হত্যার বিচারের দাবি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্রঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছি। আশা করি, আমাদের এই আহ্বানে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার ছাত্ররা সাড়া দেবে। যার মাধ্যমে আমরা সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্রঐক্য গড়ে তুলতে চাই। যারা শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবে।
প্রথম আলো: এই আহ্বান কি ডাকসুর আহ্বান?
নুরুল: অবশ্যই। আমি যেহেতু ডাকসুর ভিপি অবশ্যই এটা ডাকসুর আহ্বান। আমি যেহেতু ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদও করি অবশ্যই সে সংগঠনকেও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে আমি মনে করি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি, ডাকসুর ভিপি হিসেবে আমি সাধারণ ছাত্রদের সে আহ্বান জানিয়েছি, নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে। সাধারণ ছাত্রদের প্রতি আমার জোরালো অনুরোধ থাকবে, আজকে যে ঘটনা ঘটেছে, এ ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি, এ ধরনের ঘটনা আবারও ঘটবে।
প্রথম আলো: ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ কী দেখেন? মত প্রকাশের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ কী দেখেন?
নুরুল: বর্তমানের যে একটা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা, এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা কথা বলতে শিখেছে, ছাত্ররা প্রতিবাদ করতে শিখেছে। সেটা আপনারা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে দেখেছেন। তার আগে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে দেখেছেন। ক্ষমতাসীন দলের যুবলীগ, ছাত্রলীগ মিলে ছাত্রদের আন্দোলনে হামলা করেছে। কিন্তু ছাত্রদের প্রতিবাদ থামাতে পারেনি। ছাত্ররা প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। আজকেও আমরা যখন এক দিকে আন্দোলন করছি তখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কাছ থেকে নানান ধরনের হুমকি–ধমকি আসছে যে তারা দেখে নেবে। হামলা–টামলা চালাবে। ছাত্ররা কিন্তু সেটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজপথে আছে। আমরা আশা করি, ছাত্রদের এই জাগ্রত প্রতিবাদী চেতনা ভবিষ্যতেও জাগ্রত থাকবে এবং প্রতিবাদমুখর হবে প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সে জায়গা থেকে ছাত্ররাজনীতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে এবং ছাত্ররাজনীতির এই ইতিবাচক পরিবর্তনই জাতীয় রাজনীতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
প্রথম আলো: আন্দোলন কত দিন চালাবেন?
নুরুল: আবরারের হত্যার ন্যায়বিচার যত দিন নিশ্চিত না করা হয়। আমরা বলেছি, আবরার হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। যারা এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করবেন এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বিচার নিষ্পত্তি করতে হবে। এই বিচার নিয়ে যত কালক্ষেপণ করা হবে, ছাত্র আন্দোলনকে তত ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বিচার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ছাত্রসমাজের নানা ধরনের কর্মসূচি, প্রতিবাদ চলবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
নুরুল হক: ধন্যবাদ।