তিউনিসিয়ার ভোট ও আরব বসন্তের শেষ স্বপ্ন
তিউনিসিয়া আরব বসন্তের সূতিকাগার। বিপ্লব-পরবর্তী উত্তাল দিনগুলোতে ইসলামপন্থী আর সেক্যুলারদের ক্ষমতা ভাগাভাগিতে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরেছে তিউনিসিয়া। যদিও আরব দুনিয়ায় ক্ষমতার ভাগাভাগির এই দৃশ্য বিরল—নেই বললে অনুচিত হবে না। বর্তমান রাষ্ট্রপতি বেজি এসেবসির মৃত্যুতে নির্দিষ্ট সময়ের আগে, ১৫ সেপ্টেম্বর আবারও জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে তিউনিসিয়ায়। গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনে আগের মতো সেক্যুলার-ইসলামপন্থী জোট নেই, নেই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের সহাবস্থানের পাটাতন তৈরির ইচ্ছা। বরং আছে ক্ষমতা দখলের লড়াই। মোর্চাবিহীন, একচ্ছত্র শাসনে তিউনিসীয় সমাজের অপ্রস্তুতি ও সংশয়ের মাঝেই রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে তুরস্কের একেপি আর তিউনিসিয়ার আন নাহদা বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামোয় জায়গা করে নিতে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে। সেই সূত্র ধরেই আফগানিস্তান-ইরাক যুদ্ধ আর আরব বসন্ত-পরবর্তী সময়ে একেপির আর আন নাহদার সর্বব্যাপী উন্নয়নের ধারণা আর সমাজের সব শ্রেণির অংশগ্রহণ সমেত রাজনৈতিক ভিত্তি গঠনের উদ্যোগ ছিল পাশ্চাত্যে প্রশংসিত। বিশেষভাবে বসন্ত-পরবর্তী সেক্যুলার সরকারে আন নাহাদার প্রকাশ্য সমর্থন, মিলেমিশে কর্মপন্থা বানানোর প্রয়াস গতানুগতিক রাজনৈতিক অবয়বে বেশ পরিবর্তন আনে। যে পরিবর্তনে সাধারণ মানুষ সেক্যুলার- ইসলামপন্থীদের বিভেদ মীমাংসার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
আরব বসন্ত-পরবর্তী তিউনিসিয়া ব্যতিক্রমীভাবেই কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। ঐকমত্যের জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনা শেষে নির্বাচনের আয়োজন করে। জাতীয় নির্বাচনে সেক্যুলার এসেবসির নিদা তুনিস জয় পায় আর দ্বিতীয় হয় ইসলামপন্থী আন নাহদা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নাহদা প্রার্থী না দিলে এসেবসি জয় পায় সহজে কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী ক্ষমতার ভাগাভাগিতে এসেবসির নীতি নিরাশ করে নাহদাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ার চলমান যুদ্ধ, আর মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা নাহদার নিরাশাকে বিচ্ছেদে রূপ দেয়নি, বরং প্রেসিডেন্ট এসেবসির সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করেছে । তবে আসন্ন এই নির্বাচনে সেক্যুলার আর ইসলামপন্থীদের জোট আর থাকছে না। নির্বাচনে আন নাহদা আর নিদা তুনিস উভয় দলই নিজস্ব প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে।
১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পর তিউনিসিয়া দ্বিতীয়বারের মতো একটি স্বাধীন ও সমাজের সব অংশের অংশগ্রহণে নির্বাচনে যাচ্ছে। তিউনিসিয়ার নির্বাচন কমিশন শ খানেক আবেদন যাচাইয়ের পর ২৬ জনকে ১৫ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে উপযুক্ত ঘোষণা করে। নতুন, পুরোনো, লোকরঞ্জনবাদী, লিবারেল, বামপন্থী, রক্ষণশীল, স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ সবাই আছে এই তালিকায়। নানান কিসিমের প্রার্থীর বাহারি ও আশাপ্রদ নির্বাচনী প্রচারণা প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর ভোট কাটতে পারে। এই আশার পেছনের কারণ, গত বছরের স্থানীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে বিশাল জয়।
গত বছরের স্থানীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩৩, নাহদা ২৯ আর নিদা তুনিস ২৩ শতাংশ ভোট পায়। স্বতন্ত্র পন্থায় নির্বাচিতদের অর্ধেকই তরুণ, যাঁরা নিজেদের আগামীর রাজনৈতিক গুণগত পরিবর্তনের একমাত্র ভরসাস্থল হিসেবে আবির্ভূত করেছেন। যদিও রাজনীতির মাঠের এই নবীনেরা এখন অবধি এক মঞ্চের ঘোষণায় একমত হতে পারেননি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তরুণদের এই জয়কে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলার ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনতার পরিবর্তনের ডাক ও বিকল্প রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে আগ্রহ হিসেবে দেখছেন।
গতানুগতিক রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে জোয়ানদের আশাজাগানিয়া উত্থানে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বেশ অসুবিধায়। আর সেই অসুবিধা আরও বেশি বৃদ্ধি করেছে প্রেসিডেন্ট এসেবসির সদ্য প্রয়াণ। কারণ সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এসেবসির অবিরাম চেষ্টা আন নাহদা আর নিদা তুনিসেকে এক জোটে বেঁধেছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি আর পারস্পরিক আস্থাহীনতা মোর্চার রাজনীতির সমাপ্তি টানে।
প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়ে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিলেন বামপন্থীরা। কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তী অগোছালো কর্মকাণ্ড আর নির্বাচনে একক প্রার্থী ঘোষণায় ব্যর্থ হওয়ায় বামপন্থীদের জনপ্রিয়তায় স্থবিরতা এসেছে। এখন পর্যন্ত চারজন বামপন্থী প্রার্থী দৃশ্যমান, তবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওয়ার্কার্স পার্টির হামমা হামেমি। হামেমি গত নির্বাচনে প্রায় ১০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু বামপন্থীদের আরেক প্রার্থী মৌনগি রাহুই বামপন্থী দল আল ওয়াতাদ এবং আল তালিয়ার সমর্থন নিয়ে হামেমির বিরুদ্ধে প্রার্থিতা ঘোষণায় বামপন্থীরা কারও জন্য আর হুমকি হতে পারছে না।
পশ্চিমা সেক্যুলার ধারণাকে ভিত্তি করে সুশীল সমাজকে নিয়ে ২০১২ সালে এসেবসি গড়ে তোলেন নিদা তুনিস। আরব বসন্তের পর কর্মদক্ষতা প্রদর্শন নিদা তুনিসকে স্থানীয় ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জিতিয়ে দেয়। কিন্তু ক্ষমতার লড়াই, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি আর ইসলামপন্থীদের সঙ্গে জোটে আপত্তিসহ নানান কারণে বেশ কয়েকবার ভাঙনের কবলে পড়ে এখন বিপর্যস্ত তারা। এসেবসির ছেলেকে পার্টির ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ঘোষণার পরিকল্পনায় প্রথম সারির প্রভাবশালীরাও ভিন্ন দল গঠন করেছেন। এঁদের মধ্যে ইউসুফ চাহেদ আর মারজউকের নতুন রাজনৈতিক দলের ভালো করার সম্ভাবনা অনেক।
বিগত কয়েক বছরে জনপ্রিয়তায় লক্ষণীয় ধসের পরও বামপন্থীদের এই দুর্দিনে, ইসলামপন্থী দল আন নাহদা সুদিনে ফিরেছে। একক প্রার্থী হিসেবে আন নাহদা ঘোষণা করেছে বর্তমান সংসদের অন্তর্বর্তীকালীন স্পিকার আবদেল ফাত্তাহ মৌরকে। মৌর তিউনিসিয়ার সমাজে পরিচিত নাম এবং ইসলামপন্থীদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়। শুরুর দিকে নাহদা বিগত নির্বাচনের মতোই মধ্যমপন্থী কাউকে সমর্থন দেওয়ার চিন্তায় থাকলেও দলের মধ্যের প্রভাবশালী একটি অংশের বিরোধিতায় তা থেমে যায়। বয়স আর অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য অবশ্য নাহদার একটি অংশেরও আপত্তি মৌরির প্রার্থিতায়। নিদা তুনিস আর বামপন্থীদের দলাদলিতে মৌরির পরিচিতি কাজে লাগিয়ে প্রথম ভাগেই নির্বাচন জেতার আশা করছে আন নাহদা।
মধ্যপ্রাচ্যের খণ্ডিত রাজনৈতিক অবস্থায় নাহদার একক প্রার্থী ঘোষণায় অবাক হয়েছেন চিন্তকেরা। নাহদার জয় অথবা শক্ত অবস্থান তুরস্ক-কাতার ব্লকের অনুকূলে শক্তি বৃদ্ধি করবে আর সৌদি-আমিরাত ব্লককে চিন্তিত করবে। সুদান, ইথিওপিয়ার মতো তিউনিসিয়ায়ও কাতার ও সৌদি ব্লকের ক্ষমতার লড়াই শুরু হলে, তিউনিসিয়ার সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কেউ হবে না। আর সংঘাতের এই সম্ভাবনার পাল্লাও বেশ ভারী।
প্রথম দফায় কোনো প্রার্থীর একচেটিয়া জয় না পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই নিশ্চিত। মিশ্র এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় পর্বের ভোটে টিকে থাকার সম্ভাবনায় কাতারে অন্ততপক্ষে ছয়জন প্রার্থী। দ্বিতীয় পর্বের ভোটে জোটবদ্ধ লড়াই ভবিষ্যতের স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির কাঠামোর ভিত্তি গড়বে। তবে এককভাবে কোনো প্রার্থীর জয় আবার আদর্শিক সংঘাতের সূচনা করতে পারে, যে সংঘাতের লাগাম টেনে ধরা সেক্যুলারদের অথবা ইসলামপন্থীদের ক্ষমতার বাইরে, যার প্রমাণ সিরিয়া আর প্রতিবেশী লিবিয়ার প্রায় দশকব্যাপী যুদ্ধ।
রাহুল আনজুম: লেখক- ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষার্থী।