আওয়ামী লীগ সরকার যেসব বিষয়ে নিজেদের সাফল্যের কথা জোরগলায় প্রচার করে থাকে, তার মধ্যে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি। তাদের দাবি, ২০০৯ সালে যখন তারা দেশের দায়িত্বভার নেয়, তখন সাক্ষরতার হার ছিল ৫১ শতাংশ। বর্তমানে সেই হার প্রায় ৭৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু যে কথাটি তারা বলে না তা হলো এখনো সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে অনেক পেছনে আছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। আজ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ। নির্ধারিত সময় পাঁচ বছর আগেই চলে গেছে। আওয়ামী লীগ একটানা সাড়ে ১০ বছর ক্ষমতায় আছে। তারপরও কেন প্রতিশ্রুতি পূরণ হলো না?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, দেশের এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ এখনো নিরক্ষরতার অভিশাপ বহন করে চলেছে। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর গবেষণা বলছে, প্রকৃত সাক্ষরতার হার ৫৭ শতাংশ। বছরে সাক্ষরতার হার বাড়ছে ১ শতাংশ কিংবা তারও কম। এই ধারা চলতে থাকলে দেশ নিরক্ষরতামুক্ত হতে আরও ৩০ বছর লেগে যাবে। অথচ জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি কম হওয়ায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সাক্ষরতার হার বাড়াতে তিনি গত আট মাসে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে।
সাক্ষরতার বর্তমান হার প্রমাণ করে যে শিক্ষা খাতে সরকারের কথা ও কাজে বিস্তর ফারাক রয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি হিসাবের গরমিলের বিষয়টিও উপেক্ষা করার মতো নয়। বিবিএসের মতে, একজন ব্যক্তি পড়তে ও নিজের নাম লিখতে পারলেই সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংজ্ঞানুযায়ী, সাক্ষরতা হলো পড়ার পাশাপাশি অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে ও লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা, যোগাযোগ স্থাপন করা এবং গণনা করার দক্ষতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেউ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলে সাক্ষরতাসম্পন্ন ধরা হয়। যদিও গণসাক্ষরতা অভিযানের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে পঞ্চম শ্রেণি পাস করা অনেক শিক্ষার্থী সাক্ষরজ্ঞান হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাটুকুও অর্জন করতে পারে না। তাহলে নামমাত্র সাক্ষরতার হার বাড়িয়ে কী লাভ?
সরকার স্বীকার করতে চায় না দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরক্ষরতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্যের হার প্রায় কাছাকাছি। সরকারি হিসাবে ২৬ শতাংশ নিরক্ষর আর দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশ। যে মানুষকে পরিবারের সদস্যদের ভাত-কাপড়ের জোগাড় করতে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়, তিনি সন্তানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি না করে কাজে পাঠান বাড়তি উপার্জনের জন্য। এসব দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনা নিশ্চিত করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
সাক্ষরতার হার বাড়ানো নিয়ে পূর্বাপর সরকার একের পর এক প্রকল্প নিয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু সেসব প্রকল্প যে খুব বেশি সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০১৯ সালের শেষার্ধে এসে নীতিনির্ধারকেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের পাঠকক্ষে ধরে রাখতে দুপুরের খাবার ও পোশাক দেওয়ার কথা ভাবছে। কয়েকটি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রকল্প চালুও আছে। উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু এটিকে সফল করতে হলে শুধু সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের ওপর ভর করলে হবে না; স্থানীয় জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।
দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করতে প্রয়োজন একটি বাস্তবমুখী, টেকসই ও সমন্বিত পদক্ষেপ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন।