শিশুর আগ্রাসী আচরণ
তিন থেকে চার বছর বয়সের শিশুরা যেকোনো কিছু ধরতে, ছুঁতে, গন্ধ নিতে, শুনতে ও স্বাদ নিতে চায়। ওরা সব সময় নতুন কিছু শিখতে চায়। এই বয়সেই আমরা শিশুদের আগ্রাসী আচরণ করতে দেখি। শিশুদের এই আগ্রাসী আচরণ মানসিক এবং আচরণগত বিকাশের একটি সাধারণ অংশ। প্রায় সব শিশু ভীষণভাবে আবেগতাড়িত হয়ে চিৎকার করে, লাথি মারে বা আঘাত করে। তবে সাধারণত শিশুরা তাদের চারপাশের পরিবেশে আগ্রাসী আচরণ করতে দেখলে নিজেরাও আগ্রাসী আচরণ করতে শেখে।
শিশুরা এগুলো কেন করে? কারণ, তাদের উদ্বেগ বা হতাশাগুলো মোকাবিলা করতে অসুবিধা হয়। অনেক সময় বড়দের মতো করে নিজেদের অনুভূতির কথাগুলো বলতে না পারলেও শিশুরা আগ্রাসী আচরণ করে। আরও কিছু কারণ আছে, তবে শিশুর আচরণের যেকোনো অস্বাভাবিকতায় একজন মনোচিকিৎসাবিদের কাছে গেলে আচরণ সম্পর্কে আরও চমৎকার বিশ্লেষণ জানতে পারা যায়।
শিশুর এই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণকে মোকাবিলা করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন শিশু আগ্রাসী আচরণ করলে তাৎক্ষণিকভাবেই বোঝাতে হবে যে তার এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পরে কোনো সময় বুঝিয়ে বলার জন্য কখনোই অপেক্ষা করা উচিত নয়। শিশুকে কখনোই আঘাত করা বা মারধর করা উচিত হবে না। শিশুকে দেখাতে হবে যে অভিভাবক হিসেবে আমরা কীভাবে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করি। যেমন ‘আজ আমি নীল রঙের একটা জামা পরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জামাটা ময়লা। আমাকে অন্য একটা জামা পরতে হচ্ছে।’ একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, আগ্রাসী আচরণের বেলায় শিশুরা যাতে সব সময় একই প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়। কখনো মন ভালো বলে কিছুই বললাম না, আবার মেজাজ খারাপ তাই আঘাত করলাম; এমনটা করা উচিত নয়। আরও একটি বিষয় হলো শিশু যেন মনে না করে যে এই ভালো আচরণ সে কেবল অভিভাবকের ক্ষেত্রেই করবে। কারণ, বন্ধু বা অন্য কারও সঙ্গেও এ ধরনের আচরণ করা একেবারেই সঠিক নয়। অর্থাৎ, আচরণের বেলায় একটা সাধারণ নিয়ম থাকতে হবে।
আগ্রাসী আচরণের পর শিশু অনেকটা শান্ত হলে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলতে হবে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে কেন সে এ রকম করেছিল। তার মনের পুরো অবস্থাটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে হবে। শিশুর সঙ্গে কথা বলেই তাকে বোঝাতে হবে যে কোনো কারণে সে রেগে যেতেই পারে, তবে রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কাউকে সে কখনোই আঘাত করতে পারে না। তবে এ বিষয়ে শিশু কথা বলতে না চাইলে কখনো জোর করা ঠিক হবে না, বরং গল্পের ছলে এ বিষয়ে কথা বলা যেতে পারে বা বিষয়ভিত্তিক কোনো গল্প পড়ে শোনানো যেতে পারে।
শিশুকে তার দায়িত্বের জায়গাগুলোও বুঝিয়ে বলতে হবে। যদি সে কারও খেলনা ছুড়ে ফেলে, তাহলে তাকে খেলনা তুলতে শেখাতে হবে। তাকে দুঃখ প্রকাশ করার জন্যও বলতে হবে। তাকে আরেকজনের মনের অবস্থা সম্পর্কেও বুঝতে শেখাতে হবে। কাউকে আঘাত করলে সে ব্যথা পায়, এই বোধ তার মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। তবে শিশু একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত কখনোই তার প্রতিবারের আগ্রাসী আচরণের জন্য সত্যিকার অর্থে দুঃখ প্রকাশ করার অভ্যাস আশা করা ঠিক হবে না।
শিশুর আগ্রাসী আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য অতিরিক্ত টিভি দেখা, ভিডিও গেমস খেলা, মোবাইলে সময় কাটানো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টেকনোলজির সঙ্গে কাটানো অতিরিক্ত সময় কমিয়ে আনতে শিশুকে খেলায় মনোযোগী করে তুলতে হবে। সময় নিয়ে শিশুর সঙ্গে খেলতে হবে। খেলাধুলার আনন্দ বোঝাতে হবে। টেকনোলজির বাইরে যে চমৎকার একটা জগৎ আছে, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তাকে কৌতূহলী করে তুলতে হবে। খেলার ধরনে নিত্য পরিবর্তন আনতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি খেলাধুলার পাশাপাশি শিশুর মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়। তবে চারপাশ ভুলে শুধু বই পড়ার অভ্যাসও ঠিক নয়! কারণ, কল্পনার চাইতে আমাদের বাস্তব জগৎ টিকে থাকার ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
শিশুর চারপাশের পরিবেশকেও শিশুবান্ধব রাখা চাই। অভিভাবকেরা যদি নিজেরাই টেকনোলজির প্রতি আসক্ত থাকেন, তাহলে শিশুদের ক্ষেত্রে ‘না’ বলাটা মুশকিল হবে। টেলিভিশন দেখার সময় শিশুদের সামনে আগ্রাসী চ্যানেল বা সিনেমা দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমি নিজে ৮ বছর বয়সের থেকে কম বয়সী শিশুদের জন্য স্পাইডারম্যান সিনেমা উপযুক্ত বলে মনে করি না। তা ছাড়া সিনেমাটি ১৩ বা কম বয়সী শিশুদের জন্য উপযুক্ত নয়, এমনটাই নির্মাতারা বলেছেন। কাজেই বয়স উপযোগী সিনেমাই শিশুদের সামনে বা সঙ্গে নিয়ে দেখা উচিত। বিভিন্ন গবেষণা বলে যে প্রাক-শৈশব পর্যায়ে আগ্রাসী সিনেমার প্রতি আসক্তি থাকলে পরবর্তী সময়ে সাবালক হলে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব থাকে।
আগ্রাসী আচরণ মোকাবিলার ক্ষেত্রে ‘টাইম আউট’, এই কনসেপ্ট বেশ ভালো। বাড়িতে এই প্রয়াস চালু করা যেতে পারে। আসলে মূল বিষয়টি হলো ‘সময়’। সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া। সময় না দিলে সন্তানকে বোঝা বা বোঝানো সম্ভব নয়। কারণ, সন্তান তার কথাই শুনতে চাইবে, মানতে চাইবে, যাকে সে সবচেয়ে আপন বা কাছের মানুষ বলে মনে করে। এই কাছের মানুষটি যদি অভিভাবক হয়, তাহলেই সবচেয়ে ভালো হয়, তা–ই নয় কি? আর একটা বিষয় সবচেয়ে জরুরি, তা হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রাখা। সন্তানের সুন্দর বেড়ে ওঠার জন্য ‘টেবিল টক’ যেমন কার্যকরী, ঠিক তেমনি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ‘বেডরুম টক’ থাকাই ভালো। কারণ, সুন্দর পরিবেশ মানেই সুন্দর আচরণ।
ফারহানা মান্নান : শিশু বিষায়ক লেখক