১৭ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ১ কোটি লোক বিদেশে আয়–রোজগার করছেন এবং তাঁরা প্রতিবছর বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখছেন। তাঁদের পাঠানো অর্থ শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবারের কল্যাণেই ব্যয় হচ্ছে না, জাতীয় উন্নয়নেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের কথা। কিন্তু এই আনন্দের খবরের ভেতরে যে বেদনার উপাখ্যান আছে, সেটি আমাদের জন্য মহা দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে হাজির আছে। বাংলাদেশ থেকে এখনো যেসব শ্রমিক বাইরে যান, তাঁদের বিরাট অংশ অদক্ষ ও স্বল্প লেখাপড়া জানা। এর সুযোগ নিয়ে প্রতারক চক্র বিদেশে চাকরিপ্রত্যাশী হাজার হাজার মানুষকে যে সর্বস্বান্ত করে চলেছে, তা বিভিন্ন গবেষণা ও সরকারি–বেসরকারি পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।
বছর দুই আগে অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিদেশে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশই প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হন। এদের মধ্যে ১৯ শতাংশ মানুষ টাকা দেওয়ার পরও বিদেশে যেতে পারেন না এবং ৩২ শতাংশ বিদেশে গিয়ে নানা দুর্ভোগ পোহান।
বিদেশে যেতে আগ্রহী মানুষের প্রতারিত হওয়ার ঘটনা ওই সময়ের চেয়ে কমেছে, সে কথা বলা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রতারিত হয়ে শ্রমিকদের দেশে ফেরার ঘটনা প্রমাণ করে যে প্রতারণা কমেনি। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্ষেত্রবিশেষে প্রতারণা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয় নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও প্রলোভন দেখিয়ে। তাঁদের বেশির ভাগকে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়। অনেকেই ফিরে আসছেন লাশ হয়ে। যেগুলোর অধিকাংশই আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালানো হয়। বাস্তবে কী ঘটেছিল, তা জানার কোনো পথ থাকে না।
প্রতারিত হওয়ার সমস্যাটি যে গুরুতর, তা উঠে এসেছে গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও বক্তব্যেও। তিনি অভিবাসনবিষয়ক জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিদেশে যাওয়ার সময় এবং বিদেশে কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ যেন প্রতারিত না হন, সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন এই প্রতারণা বন্ধ করতে হলে প্রথমে যে কাজটি করণীয়, তা হলো প্রতারক চক্র ও তাদের নেপথ্যের কুশীলবদের খুঁজে বের করা। দেশে প্রতারণা বন্ধের আইন আছে, আইন প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা আছে। তারপরও কীভাবে প্রতারক চক্র দেশময় তাদের জাল বিছিয়ে রাখে? আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তাদের পাকড়াও করা মোটেই অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশন এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একযোগে কাজ করতে হবে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ তাসনীম সিদ্দিকী যথার্থই বলেছেন, এই প্রতারণার দায়ভার কেবল দালালদের কাঁধে দেওয়ার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রকেও এর দায় নিতে হবে। কোথায়, কীভাবে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, তা খুঁজে সমাধান করতে হবে তাদের। বিদেশে যেতে ব্যর্থ শতকরা ১৯ ভাগকে শূন্যতে নামিয়ে আনতে হবে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়া কেউ বিদেশে কাজের জন্য যেতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁরা বৈধ সংস্থার মাধ্যমে যাচ্ছেন, না অবৈধ সংস্থার মাধ্যমে যাচ্ছেন, সেটি পরীক্ষা করা কঠিন নয়। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটি তাদেরই করতে হবে। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হবে তাদের পাকড়াও করে বিচারের জন্য সোপর্দ করা। প্রায় সংবাদমাধ্যমে এ ধরনের প্রতারক চক্র ধরা পড়ার খবর আসে। কিন্তু এরপর তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই প্রবণতা কঠোর হাতে বন্ধ করতে হবে। দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের শান্তি নিশ্চিত করতে পারলে দালালদের দৌরাত্ম্য কমবে আশা করি।