কেবল ক্ষোভ প্রকাশে আমাজন বাঁচবে না
পৃথিবীর সবুজ ফুসফুস জ্বলছে। এই ফুসফুস হচ্ছে চিরহরিৎ অরণ্য আমাজন, যা কিনা বিশ্বের অক্সিজেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ উৎপাদন করে। এখন বিশাল এই অরণ্য আগুনে এমনভাবে পুড়ছে, যা আমরা বহু বছর দেখিনি। সারা বিশ্ব ক্ষোভ প্রকাশ করলেও আগুন নেভানোর ব্যাপারে কেউ যথেষ্ট কিছু করছে না। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এই বাস্তুব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে অনেক কিছু করতে হবে। ভয়াবহ এই দাবানল নেভাতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ার বলসোনারো এখন আন্তর্জাতিক সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর আক্রমণাত্মক বক্তৃতা মানুষকে অস্ত্র তুলে নিতে, আগুন জ্বালাতে এবং আইনকে নিজের হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত করে। তিনি নানা ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন, নামীদামি পণ্ডিতদের গবেষণা অপছন্দ হলে তিনি তাঁদের বরখাস্ত করেন এবং ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অন্য কোনো দেশ মন্তব্য করলে তিনি তা সহ্য করেন না এবং দেশগুলোর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। তিনি ইতিমধ্যেই বলেছেন, এ নিয়ে বহির্বিশ্বের দেশগুলোর নাক গলানোর প্রয়োজন নেই।
তবে বলসোনারোর এই বক্তব্য কি সত্যিই অবাক হওয়ার মতো? লোকরঞ্জনবাদী চরম ডানপন্থী এই নেতার কাছ থেকে আমরা আর কী আশা করতে পারি? আমাজনে আগুন লাগার ঘটনায় যত ক্ষোভ ও উত্তেজনা বাড়ছে, ততই সরকার এ নিয়ে কোনো আলোচনায় বসতে অনীহা প্রকাশ করছে। সরকারের এ আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।
আমাজনের অনেক অংশ এখন আগুনে জ্বলছে, তবে বনের ধ্বংসপ্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছিল এবং আজও তা অব্যাহত। এই ধ্বংসপ্রক্রিয়া কেবল কৃষি, গবাদিপশু এবং সয়াবিন চাষের জন্য জমি পুনরুদ্ধার নয়, বহু বছর ধরে এখানে অবৈধ সোনা অনুসন্ধানকারীরা সক্রিয়। দিন দিন এদের সংখ্যা বাড়ছে। সোনার খনির সন্ধানে তারা বন উজাড় করছে। এ ছাড়া বিগত দশকে আমাজন নদী অববাহিকায় নির্মিত হয়েছে বিশাল বিশাল সব বাঁধ। ২০২৩ সালের মধ্যে সেখানে আরও ২০টির বেশি বাঁধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখনই এসব বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প স্বাক্ষরিত হয়। পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও এসব প্রকল্প তখন পাস হয়। এখন এসব বাঁধ নির্মাণের জন্য আমাজনের বিশাল এলাকা প্লাবিত হবে, বড় বড় জলাধার তৈরি করতে হবে জৈব জ্বালানির পচনের জন্য। এ থেকে তৈরি হবে মিথেন গ্যাস, যা পরিবেশের জন্য কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়েও বেশি ক্ষতিকারক।
২০১২ সালে আমি একবার মাদেইরা নদীর ওপর নির্মিত একটি নতুন বাঁধ পরিদর্শনে গিয়েছিলাম এবং তখন এই অবকাঠামোর প্রাথমিক পরিবেশগত প্রভাব দেখেছি। বাঁধটি রোনদোনিয়া রাজ্যের রাজধানী পোর্তো ভেলহো শহরে অবস্থিত, যা কিনা ব্রাজিলের অন্যতম কৃষিক্ষেত্র। মাদেইরা নদী আমাজনের অন্যতম পুষ্টিদায়ক উপনদী, যা আন্দেজ থেকে পলি বহন করে। যখন নদীটিতে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল, তখন পোর্তো ভেলহো শহরটি পানিতে তলিয়ে যায়। তারপর থেকে পরিস্থিতি কেবল খারাপই হয়েছে, এখন সেখানে কোনো বিমান অবতরণ করতে পারছে না। কারণ, আগুন লাগার ফলে সৃষ্ট ঘন ধোঁয়ার কারণে পাইলটরা নিচের কোনো কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না।
আমাজনের ধ্বংস বন্ধ করতে ব্রাজিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে কোনো কাজ হবে না। অন্যদিকে জলবায়ু এবং বন সুরক্ষা উদ্যোগের জন্য তহবিল স্থগিত করার বিষয়টি (জার্মানি ও নরওয়ে ইতিমধ্যে ব্রাজিলকে তহবিল দেওয়া বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে) এখন ব্রাজিলের সরকার এবং কৃষিবিষয়ক লবিস্টদের হাতে। এটি আমাজনকে সুরক্ষিত করার জন্য কাজ করছে এমন মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে। কেননা, তারা সাহায্যের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে পারছে না। জলবায়ু এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ব্রাজিলের সরকারি তহবিলের পরিমাণ গত বছর উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
দীর্ঘ মেয়াদের জন্য আমাজন বনকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও বেশি অর্থ সরবরাহ করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠন করতে হবে, যা আমাজনের অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার না দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি পূরণে অর্থ সরবরাহ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলন। ওই সম্মেলনে জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচ্যসূচির শীর্ষে থাকবে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষে সেখানে এটা দেখানোর একটি সুযোগ হবে যে তারা কেবল ক্ষোভ প্রকাশই নয়, সত্যিকার অর্থেই পদক্ষেপ নিতে পারে।
ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ভ্যানেসা ফিশার: ডয়চে ভেলের কলামিস্ট