খাঁচায় বন্দী কাশ্মীর
উত্তেজনায় টগবগ করা আসামের পাশাপাশি এবার আগুনের হলকা ছড়াল কাশ্মীরে। আনুষ্ঠানিকভাবে অঞ্চলটির সাংবিধানিক স্বাতন্ত্র্য প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার।
গত দুই সপ্তাহে সেখানে প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় সৈন্য প্রবেশ করেছে। এটা ছিল এত দিনকার সামরিক উপস্থিতির অতিরিক্ত। কাশ্মীরকে ইতিমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিকায়িত এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়। নতুন করে সৈন্য মোতায়েনের পর অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে, সহজে বোধগম্য।
এই লেখা তৈরির সময় শ্রীনগরে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। স্কুল-কলেজ, ফোন ও ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেবল টিভি নেটওয়ার্কও বন্ধ। সরকার নির্দেশ দিয়েছে, কোনো ধরনের সভা–সমাবেশ ও মিছিল করা যাবে না। সৈয়দ আলী শাহ গিলানিসহ অনেক নেতা ইতিমধ্যে গৃহবন্দী সেখানে। সর্বশেষ আটক করা হয়েছে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহকে। দ্বিতীয় জনপ্রিয় নেতা ইয়াসিন মালিককে বন্দী রাখা হয়েছে দিল্লিতে তিহার কারাগারে। গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী কোনো রাজনীতিবিদই সেখানে আর মুক্ত অবস্থায় নেই।
সমগ্র কাশ্মীরে থমথমে অবস্থা এবং রাস্তাঘাট পুরোদস্তুর ফাঁকা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সামরিক বাহিনী ব্যারিকেড বসিয়ে রেখেছে। গত দুই সপ্তাহের আতঙ্কে সমগ্র ভ্যালিজুড়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম থমকে গেছে। নাজুক অবস্থায় রয়েছে বাজারব্যবস্থা। কেউ জানে না এই জঘন্য অবস্থার শেষ কোথায়। তরুণ রাজনৈতিক সংগঠক শেহলা রশীদ তাঁর টুইটার বার্তায় লিখেছেন ‘ভারত কাশ্মীরকে এক কৃঞ্চগহ্বরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ ঠিক এ রকম এক দিনে নয়া দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির সরকার সিদ্ধান্ত জানাল, জম্মু ও কাশ্মীরের মর্যাদার স্মারক সংবিধানের ‘অনুচ্ছেদ ৩৭০’ প্রত্যাহার চায় তারা। লোকসভায় সেই প্রস্তাবই তুলে ধরলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এর ফলে সংবিধানের ৩৫-এ অনুচ্ছেদও বাতিল হয়ে যাবে। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, মোদি নয়, অমিত শাহই কাশ্মীর বিষয়ে এ মুহূর্তে চালকের আসনে রয়েছেন।
নতুন ভারতীয় সিদ্ধান্তের তাৎপর্য
কয়েক মাস ধরে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার নজর ছিল আসামের দিকে। ৩১ আগস্ট সেখানে নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা ঘোষিত হবে এবং ধারণা করা হচ্ছে ৩০-৪০ লাখ মানুষ সেখানে রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে ভয়াবহ এই মানবিক দুর্যোগের আশঙ্কার মুখেই সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া কেঁপে উঠল কাশ্মীর বিষয়ে মোদি সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে।
শুধু ৩৭০ ধারাই তুলে দিল না মোদি সরকার, একই সঙ্গে কাশ্মীর থেকে ভেঙে আলাদা করে দেওয়া হলো লাদাখকে। এখন থেকে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। দুটি জায়গাতেই দুজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হবে। অর্থাৎ, কাশ্মীরের পতন হলো রাজ্যের মর্যাদারও নিচে।
ভারতীয় সংবিধানের আলোচ্য দুটি অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের বহু রকমের তাৎপর্য রয়েছে। সাধারণভাবে এটা কাশ্মীরকে সাধারণ একটা ভারতীয় অঙ্গরাজ্যে পরিণত করবে। অর্থাৎ, কাশ্মীরের ‘আজাদি’র বিষয়টি বহু দূর পিছিয়ে যাবে এর মাধ্যমে। তবে বিশেষভাবে ৩৫-ক অনুচ্ছেদ বাতিলের তাৎপর্য হবে সুদূরপ্রসারী। কাশ্মীর আর আগের মতো মুসলমানপ্রধান থাকবে না। জম্মুতেও অমুসলমানদের হিস্যা বাড়ানো হবে। মূলত জনমিতি পাল্টে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নতুন এক নিরীক্ষা হিসেবেই দোভাল-অমিত শাহ জুটি উদ্যোগটি নিচ্ছে। আরএসএসের অনেকেই মনে করেন, হিন্দুপ্রধান জম্মু এবং বৌদ্ধপ্রধান লাদাখকে পাশে রেখে কাশ্মীরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, যদি কাশ্মীরে অমুসলমান হিস্যা বাড়ানো যায়। কাশ্মীরি অমুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির আইনগত প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হলে ধীরলয়ে এটা একসময় পূর্ণ ভারতীয় রূপ নিয়ে নেবে। এ ছাড়া ৩৫-ক–এর অনুপস্থিতিতে কাশ্মীরের ভারতীয় করপোরেটদের সম্পদ ক্রয় ও বিনিয়োগেও বিশেষ সুবিধা হবে।
ভারতে এ মুহূর্তে যে আটটি প্রদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু, তার একটি জম্মু ও কাশ্মীর। প্রদেশের জম্মুতে হিন্দু রয়েছে ৬৩ ভাগ, লাদাখে ১২ এবং কাশ্মীরে ২ ভাগ। গড়ে পুরো রাজ্যে ৩৬ ভাগ। বিজেপি এই অবস্থারই পরিবর্তন ঘটাতে চায় ৩৫-ক পাল্টে। অর্থাৎ, ভ্যালিতে জনমিতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে। রাজ্যের সর্বশেষ মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিক গ্রেপ্তার হওয়ার আগে নয়া দিল্লির ‘পরিকল্পনা’কে আগুনে বারুদের গুঁড়া ছিটানোর মতো ভুল হিসেবে হুঁশিয়ার করেছিলেন। তাঁর মতে, এতে পরিস্থিতির ওপর কারোরই নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। মেহবুবার দ্বিতীয় বাক্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। ‘৩৫-ক’ কিংবা ‘৩৭০’ বাতিল হওয়া মানে কাশ্মীরি তরুণ-তরুণীদের কাছে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়া।
অতঃপর কাশ্মীরের সাংবিধানিক স্বাতন্ত্র্য শেষ হয়ে যাবে
কাশ্মীরের রাষ্ট্রনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক ভারতীয় সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদ। ‘অনুচ্ছেদ ৩৭০’ এবং ‘অনুচ্ছেদ ৩৫-ক’। ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার বাকি বিষয়গুলোতে জম্মু ও কাশ্মীরে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে ভারত সরকারকে স্থানীয় আইনসভার সঙ্গে আলাপ করে করতে হয়। প্রথমে এই অনুচ্ছেদ ছিল ৩০৬-এ আকারে। ১৯৫২-এর ১৭ নভেম্বর থেকে তা বর্তমানের ‘অনুচ্ছেদ ৩৭০’ পরিচয় পায়। আইন বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই অনুচ্ছেদ জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধান মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দেয়, এই অঞ্চলের ওপর ভারত সরকারের কর্তৃত্ব সীমিত করে এবং জম্মু ও কাশ্মীরের নিজস্ব আইনসভার শক্তিমত্তারও স্বীকৃতি দেয়।
ভারতের সংবিধান প্রণয়নকালে ভারত সংযুক্ত পূর্বতন প্রিন্সলি স্টেটগুলোকে প্রতিনিধি প্রেরণের অনুরোধ করা হলেও কাশ্মীরের মহারাজা তাতে কোনো প্রতিনিধি প্রেরণ করেননি। স্থানীয় ন্যাশনাল কনফারেন্স দল তাতে চারজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল। কাশ্মীরের মহারাজা প্রতিনিধি প্রেরণ না করার রাষ্ট্রনৈতিক ভিত্তি ছিল এই যে ভারতভুক্তি বিষয়ে তিনি দিল্লির শাসকদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন, তাতে (ধারা ৭) কাশ্মীরের ভারতীয় সংবিধান মেনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না, বরং নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের এখতিয়ার ছিল। এ রকম ঐতিহাসিক পটভূমিতেই ভারতীয় সংবিধান প্রণয়নকালে তাতে কাশ্মীর বিষয়ে ৩৭০ নম্বর ধারাটি যুক্ত হয়। ভারতভুক্ত প্রিন্সলি স্টেটগুলোর মধ্যে কেবল জম্মু ও কাশ্মীরই এইরূপ বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ভোগ করছে। প্রায় সম্পূরক আরেকটি সাংবিধানিক ধারা হলো ‘৩৫-এ’। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরে ‘স্থায়ী বাসিন্দা’দের বিশেষ মর্যাদা ও অধিকার দিতে পারে স্থানীয় আইনসভা। পাশাপাশি ‘৩৫-ক’ অনুযায়ী কাশ্মীরের বাসিন্দা নন এমন ভারতীয়দের সেখানে সম্পদের মালিক হওয়া ও চাকরি পাওয়ায় বাধা আছে। ১৯৫৪ সালের ১৪ মে ভারতের প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ অধ্যাদেশের মাধ্যমে কাশ্মীরের এই মর্যাদা নির্ধারণ করেছিলেন। কাশ্মীরিরা যাতে সার্বভৌমত্বের বোধ নিয়ে, সুখী মনোভাবের সঙ্গে ‘ভারত ইউনিয়ন’-এ থেকে যায়, সেই লক্ষ্যে নেহেরু সরকারের সুপারিশে প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশটি জারি করেন সে সময়। সংবিধানের ‘অনুচ্ছেদ ৩৭০’-এর আলোকে অধ্যাদেশটি জারি হয়।
৩৭০ এবং ৩৫-ক অনুচ্ছেদ এত দিন কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল বলে মনে করা হলেও এবার তার আনুষ্ঠানিক অবসান চাইছে ভারত সরকার। যদিও ইতিমধ্যেই অনেক কাগুজে বিষয় হয়ে গিয়েছিল রাষ্ট্রনৈতিক ওই স্বাতন্ত্র্য। বাস্তবে কাশ্মীর ছিল একটি অধিকৃত অঞ্চলের মর্যাদায়। নতুন প্রস্তাব অনুমোদিত হলে জম্মু ও কাশ্মীর একটি সাধারণ ভারতীয় রাজ্যের চাইতেও নিচে চলে যাবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসভার হাতে কোনো ক্ষমতাই থাকবে না। কাশ্মীর ও লাদাখ নিয়ন্ত্রিত হবে গভর্নরের দ্বারা।
এটা বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল
বিজেপি সরকারের দিক থেকে কাশ্মীর বিষয়ে সর্বশেষ পদক্ষেপ অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু ‘৩৫-ক’ এবং ‘৩৭০’ অনুচ্ছেদের বাতিল মোদি-অমিত শাহ জুটির নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল এবং শেষোক্তজনই আছেন এখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, সুতরাং এ রকমই হওয়ার কথা। তবে এসব অনুচ্ছেদ নিয়ে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে অন্তত সাতটি মামলা চলছে। বিজেপি সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সেটারও তোয়াক্কা করতে চাইছে না।
বিজেপি নেতাদের মতে, কাশ্মীরের মর্যাদাবিষয়ক উল্লিখিত অনুচ্ছেদসমূহ কাশ্মীরি তরুণদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার মনস্তত্ত্ব তৈরি করছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠকেরা বলছেন, সমগ্র ভারতের জন্য থাকবেÑ‘এক প্রধান-এক বিধান-এক নিশান’। অর্থাৎ, ভারতে থাকবে কেবল ‘একটি রাষ্ট্রীয় পতাকা, একজন সরকারপ্রধান এবং একটি সংবিধান।’
সৈয়দ গিলানির আর্তি ‘এসওএস’
বড় একটা গ্যারিসনের মতো কাশ্মীরের পরিবেশে এ মুহূর্তে স্বাধীন মতামত বা ভিন্নমত প্রকাশের কার্যত কোনো নিয়মতান্ত্রিক উপায় নেই। এক বছর হলো রাজ্যটিতে প্রথমে গভর্নরের শাসন এবং পরে প্রেসিডেন্টের শাসন চলছে। ২২ বছর পর সেখানে আবার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির চরম দুর্দিন নেমে এল। বিজেপি ছাড়া অন্যান্য দলের রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ। স্থানীয় সমাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা শাহ গিলানি এক টুইটার বার্তায় বিশ্ববাসীর কাছে তাঁদের রক্ষার আর্তি জানিয়ে লিখেছেন: ‘এই বার্তাকে এসওএস হিসেবে গণ্য করুন।’ তবে পাকিস্তান ব্যতীত বিশ্বের আর কোথাও থেকে কাশ্মীর নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি। মূল ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখাচ্ছে ন্যূনতম মাত্রায়—কেবল বক্তৃতা–বিবৃতির মাধ্যমে। পার্লামেন্টে তারা বিজেপির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কোনো সম্মিলিত অবস্থান নিতে পারবে বলেও মনে হয় না। কারণ, সাধারণভাবে বিজেপিবিরোধী শিবিরেও কাশ্মীর বিষয়ে নীতিগত ভিন্নতা আছে বিভিন্ন দলের মধ্যে।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক