টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৮.৭ শিশুশ্রম নিরসনে অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা
গত ২৫ জুন ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৮.৭: শিশুশ্রম নিরসনে অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।
যাঁরা অংশ নিলেন
সাকিউন নাহার বেগম, এনডিসি: অতিরিক্ত সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
টুমো পোটিআইনেন: কান্ট্রি ডিরেক্টর, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)
মো. রুহুল আমিন: উপসচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
সালমা আলী: মানবাধিকার আইনজীবী ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক, মহিলা আইনজীবী সমিতি
আবদুছ সহিদ মাহমুদ: পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম
মোস্তাফিজুর রহমান: যুগ্ম মহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর
সামিউর রহমান খান: এসডিজি কো–অডি৴নেটর, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন (বিইএফ)
শাবনাজ জাহেরীন: চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার, ইউনিসেফ
রাফেজা শাহীন: সমন্বয়কারী, শিশু সুরক্ষা বিভাগ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
মো. জাফরুল হাসান: যুগ্ম মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ, বিলস
এ কে এম মাসুদ আলী: নির্বাহী পরিচালক, ইনসিডিন বাংলাদেশ
আবদুল্লাহ আল মামুন: পরিচালক, শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকারবিষয়ক সুশাসন, সেভ দ্য চিলড্রেন
সাবিরা নুপুর: ডেপুটি ডিরেক্টর, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড জাস্টিস ফর চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন
সুরাইয়া বানু: ন্যাশনাল প্রজেক্ট কো–অর্ডিনেটর, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা
িনশিতা ইসলাম: অফিসার, চাইল্ড স্পনসরশিপ, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনায় সুপারিশ
■ শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন
■ তৃণমূল পর্যায়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করতে হবে
■ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া দরকার
■ মালিক সমিতির সবাইকে শ্রম আইন মেনে চলতে হবে
■ কর্মজীবী িশশুদের জন্য টেকসই বিকল্প ব্যবস্থা করা প্রয়োজন
■ স্থানীয় সরকার শিশুশ্রম নিরসনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে
■ সব শিশুর জন্য সামাজিক সুরক্ষাবলয় সৃষ্টি করতে হবে
■ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার
■ কর্মজীবী শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে মানসিক সহযোগিতার ব্যবস্থা থাকা উচিত
■ ২০১৩ সালের শিশুশ্রম আইন পর্যালোচনা করে সময়োপযোগী করতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রম নিরসনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। িশশুশ্রম নিরসনের জন্য তাদের আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পরিবার যেন বেঁচে থাকতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এখন এ বিষয়ে আলোচনা করবেন টুমো পটিআইনেন।
টুমো পটিআইনেন
শিশুশ্রম নিয়ে এ দেশের সার্বিক অবস্থা ভালো নয়। এ ক্ষেত্রে সবার স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সমাজে শিশুশ্রম বিষয়ে কোন ধরনের সামাজিক চুক্তি ও মতামত প্রচলিত আছে, তা বিবেচনায় আনা দরকার। শিশুদের উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
আজকের আলোচনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। শিশুশ্রম নিয়ে আমরা কোন অবস্থানে আছি, তা বুঝতে এই আলোচনা সাহায্য করবে। শিশুশ্রম নিরসনে আমরা এগিয়ে যেতে চাই কি না, তা দেখতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সক্ষমতা আছে কি না, সেটাও যাচাই করা দরকার।
২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অবশ্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইনফরমাল (অপ্রচলিত) খাতের পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এ ব্যাপারে আমাদের কর্মপরিকল্পনা সুনিদি৴ষ্ট নয়।
শিশুশ্রম কীভাবে শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে বাংলাদেশে গবেষণা হওয়া দরকার।
এ ব্যাপারে আমাদের কার্যকর কর্মপরিকল্পনার অভাব আছে। শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করলে আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিশুদের ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবার ও সমাজের অন্তর্ভুক্তি থাকতে হবে। কোন খাতগুলোতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা–ও দেখতে হবে।
সরকার শিশুশ্রম নিরসনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আইএলও সরকারকে অনুরোধ করবে, সরকার যেন আইএলও কনভেনশন ১৩৮ র্যাটিফাই (অনুস্বাক্ষর) করে। শিশুশ্রম নিরসনে এই কনভেনশন অনেক বেশি গুরুত্বপূণ৴।
আইএলও–সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগীরা শিশুশ্রমের বিষয়ে কী ভাবছে, তা শুনতে চায়।
সাকিউন নাহার বেগম, এনডিসি
কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চিলড্রেন (সিআরসি) অনুস্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। সিআরসির ধারাসমূহ পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হলে শিশুশ্রম নিরসন পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে। আমাদের দেশে শিশুশ্রমের মূল কারণ দারিদ্র্য ও পিতামাতার অসচেতনতা।
আমি বিশ্বাস করি, সরকারি উদ্যোগ, বেসরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত করা সম্ভব।
অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তির হার অনেক ভালো। প্রায় ১০০ ভাগ। সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে অবৈতনিক করেছে। কিন্তু ভর্তির পর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পূর্বেই অনেক শিশু ঝরে (Dropout) পড়ে। ঝরে পড়া শিশুরাই বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত হয়।
২০১৩ সালের পর শিশুশ্রম বিষয়ে কোনো জরিপ হয়নি। শিশুশ্রমের বিষয়ে আইএলও এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। এই জরিপ সম্পন্ন হলে শিশুশ্রমের বর্তমান পরিস্থিতি জানা সম্ভব হবে। এ সমস্যা সমাধানের জন্যও বাস্তবসম্মত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে।
শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৬ পর্যালোচনা দরকার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শিশুশ্রম নিরসনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। শিশুশ্রম বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরসনে জেলা, উপজেলা ও গ্রামের বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গঠিত কমিটি আছে। একইভাবে শিশুশ্রম নিরসনে বিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে।
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনেক পরিবর্তন ও উন্নয়ন হবে।
২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম নিরসন হবে, এই বিশ্বাস ও প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা এবং সবার সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশন ১৮২ র্যাটিফাই (অনুস্বাক্ষর) করেছে। আমরা আইএলও কনভেনশন ১৩৮ নিয়ে কাজ করছি। শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
আবদুছ সহিদ মাহমুদ
শ্রমজীবী শিশুদের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সব শিশুকে সরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শ্রম থেকে শিশুদের মুক্তি দেওয়া হবে। এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু এর জন্য অনেক কাজ করতে হবে।
২০১২ সালে শিশুশ্রম নিরসনে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছিল। এটির মেয়াদ ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। তারপর এটিকে বাড়িয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত শিশুশ্রম নিরসনে কোনো জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নেই।
বর্তমানে ৩৮ ধরনের কাজ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। এ ছাড়া আরও অনেক কাজ আছে, যেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত নয়। ইনফরমাল খাতকেও এর আওতায় আনতে হবে। এই খাতগুলোর কোনো পরিসংখ্যান নেই।
শিশুশ্রমের বিষয়ে মূল কাজ করে শ্রম মন্ত্রণালয়। কিন্তু বর্তমানে এখানে প্রায় সবাই নতুন কর্মকর্তা। কোনো লক্ষ্য স্থির না থাকলে তা অর্জন করা যাবে না। এর জন্য ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। কিন্তু কিছুদিন পরপর কর্মকর্তা পরিবর্তন করলে কাজের ধারাবাহিকতা থাকে না। কর্মপরিকল্পনায় নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা না থাকলে শিশুশ্রম নিরসন হবে না।
সালমা আলী
আমাদের দেশের নিয়মকানুন অন্যান্য দেশের মতো কাজ করে না। একজন নতুন কর্মকর্তা এলে তাঁকে নতুন করে সব ফাইল আবার পাঠাতে হয়। এই ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে।
শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনে আমাদের কাঠামো কাজ করছে কি না, তা দেখতে হবে। এর জন্য তৃণমূল পর্যায়ে যাওয়া লাগবে। তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করা দরকার। এখানে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে। রাজনৈতিকভাবে শিশুশ্রম নিরসনের ধারণাটি উৎসাহিত করতে হবে।
অনেক অল্প বয়সী মেয়েকে যৌনকর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে। এদের নিয়েও কাজ করতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব না। এতে সামাজিক সংগঠনসহ সবার সহযোগিতা থাকতে হবে।
শিশুশ্রম নিরসনকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে নিতে হবে। এর জন্য স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। গণমাধ্যমের উচিত শিশুদের কর্মস্থলের ছবি তুলে পত্রিকায় দেওয়া। এতে সবার নজরে আসবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে।
নিশিতা ইসলাম
আজকের আলোচনা অনুষ্ঠান অত্যন্ত সময়োপযোগী। গৃহে, রেস্টুরেন্টে শিশু শ্রমিকের চাহিদা অনেক। ফলে বিপুলসংখ্যক শিশু সেখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। এখানে সচেতনতার অভাব রয়েছে।
সচেতনতার অভাবে পরিবারগুলো তাদের শিশুসন্তানদের এসব কাজে পাঠাচ্ছে। অভিভাবকদের মধ্যে শিশুশিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। শিক্ষা শিশুশ্রম নিরসনে অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।
সামাজিকভাবে এই বার্তা সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের সংগঠন থেকে আমরা শিশুশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি। সাধারণ মানুষের কাছে শিশুশ্রমবিরোধী আইন, নীতিমালা তুলে ধরতে হবে। তাহলে অনেকেই তাদের ছেলেমেয়েকে কাজ থেকে সরিয়ে আনবে।
সামিউর রহমান খান
একটি বিদেশি সহায়তা সংস্থায় শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করেছি। তৃণমূল পর্যায়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। বাবা-মায়েরা কেউই তাঁদের সন্তানকে শিশু বয়সে কাজে পাঠাতে চান না। মা–বাবাকে প্রণোদনা দিতে হবে, যেন তাঁরা তাঁদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে উৎসাহী হন।
তা ছাড়া কর্মজীবী ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহী হয় না। তারা বিদ্যালয়ে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে ঝরে পড়ে। এরপরে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ে।
মা–বাবাকে তাঁদের সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাহলে তাঁদের শিশুসন্তানকে কাজে না পাঠিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠাবেন। এখানে শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের আদর্শ শিক্ষক হতে হবে।
শিক্ষকদের শিক্ষাদানের বাইরে আরও অনেক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেমন ভোটার তালিকা তৈরি করা। এতে তাঁদের শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে।
মালিক সমিতির সবাইকে শ্রম আইন মেনে চলতে হবে। তাঁদের উচিত বিভিন্ন সভা, আলোচনা অনুষ্ঠান করে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।শিশুশ্রম নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা অনেক বেশি জরুরি।
সাবিরা নুপুর
ওয়ার্ল্ড ভিশন দুটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। প্রথমত, আমরা চেষ্টা করি কীভাবে শিশুদের কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। দ্বিতীয়ত, নতুন করে কোনো শিশু যেন কাজে না যায়, এটা নিশ্চিত করা।
২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ১২ লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে উঠিয়ে আনতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাদের জন্য টেকসই বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন যেসব শিশুকে কাজ থেকে ফিরিয়ে আনে, তাদের প্রথম ১ বছর প্রতি মাসে ১ থেকে ২ হাজার টাকা করে দেয়। পরবর্তী সময়ে তাদের পরিবারকে এককালীন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে টেকসই কোনো কিছু করার ব্যবস্থা করে দেয়। এই পদ্ধতি ফলপ্রসূ হয়েছে। তা না হলে এই শিশুরা আবার কাজে ফিরে যেত।
কর্মক্ষেত্র থেকে ফেরত শিশুরা বিদ্যালয়ে গুরুত্ব পায় না। ফলে বিদ্যালয় তাদের কাছে মানসিক যন্ত্রণার জায়গা মনে হয়। বিদ্যালয়ে তাদের মানসিক সহযোগিতা করতে হবে।
শিশুশ্রম নিরসনে স্থানীয় সরকার অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কাজে নিয়োজিত প্রায় সব শিশু শ্রমিক গ্রাম থেকে আসে। সেখানে তাদের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করা দরকার। তাই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী হতে হবে।
শাবনাজ জাহেরীন
জাতিসংঘের বিভিন্ন কনভেনশন ও সিআরসি (কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড) থেকে সরকার ও মন্ত্রণালয়ের জন্য সব সময় কিছু সুপারিশ আসে। কিন্তু সরকার গুরুত্ব দেয় না। ফলে বিভিন্ন কনভেনশন রেটিফিকেশন অর্থবহ হচ্ছে না।
শিশুশ্রম নিরসনে তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অনেক মন্ত্রণালয় জড়িত। এর জন্য মন্ত্রণালয়ে দক্ষ জনবল লাগবে, যেন তারা সমন্বয় করতে পারে।
শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন খাতে আলাদা বাজেট দেওয়া হয়। সব বাজেটকে এক করতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা লাগবে। এই কর্মপরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নও দরকার। এ জন্য অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ড প্রয়োজন।
বেসরকারি খাত ও মালিক সমিতিকে আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার। কর্মক্ষেত্রে শিশু শ্রমিকের চাহিদা কমে গেলে তার জোগানও কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে।
সুরাইয়া বানু
১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের শিশুরা পোশাকশিল্পে কাজ না পেয়ে অন্যান্য কাজে ঢুকছে। অনেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহানুভূতি দেখিয়ে ১৮ বছর না হলেও ১৮ বছর দেখিয়ে সনদ দিচ্ছে। এর ফলে অনেক শিশু কাজে ঢুকছে। এটি বন্ধ করতে হবে।
শিশুদের বিকল্প সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন শিশুশ্রমমুক্ত এলাকা ঘোষণা করা যায় কি না, তা দেখতে হবে।
পোশাকশিল্পে ৩৫ বছর হলে আর কাজে রাখছে না। ফলে কর্মীরা আবার বয়স কম দেখিয়ে কাজে যোগ দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা বিদেশে যাচ্ছেন কাজ করতে। এ কারণে তাঁদের শিশুরা বিভিন্ন কাজে শিশু শ্রমিক হিসেবে যোগ দিচ্ছে।
জাতীয় কর্মপরিকল্পনা, আইন ইত্যাদির বাস্তবায়ন থাকতে হবে। আমরা আইএলও কনভেনশন ১৮৯ অনুস্বাক্ষর করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছি। তা ছাড়া শিশুশ্রম দূরীকরণে আইএলও কনভেনশন ১৩৮ র্যাটিফাই করতে হবে। এগুলো র্যাটিফাই করার জন্য আমাদের সক্ষমতাও থাকতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান
গত ১২ জুন শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছে। এবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিশুশ্রম নয়, শিশুর জীবন হোক স্বপ্নময়’। কর্মজীবী শিশুদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার দরকার।
শিশুশ্রম বন্ধ করা সরকারের অন্যতম পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি ‘নারী ও শিশুশ্রম’ নামে একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। এটি আগে ছিল না। শিশুশ্রম বন্ধে আরও বেশি কাজ করা যাবে।
কোনো মা–বাবাই চান না, তাঁদের শিশুসন্তানেরা কাজ করুক। তাহলে শিশুরা কেন কাজে ঢুকছে, কেন শিশুদের কাজে নিয়োগ করা হচ্ছে—সেটা খুঁজে বের করতে হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে সব শিশু বিদ্যালয়ে থাকবে। কাজটা কয়েকটা ধাপে করতে হবে। শিশুশ্রমের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে এটা করা সম্ভব।
িশশুশ্রম বন্ধ করতে এলাকাভিত্তিক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা দরকার, যেন তারা সেখানে শিক্ষা লাভ করে কাজে যোগ দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে।
মো. রুহুল আমিন
শিশুশ্রমের ওপর ২০০৩ ও ২০১৩ সালে দুটি জরিপ হয়েছে। সর্বশেষ জরিপমতে, মোট শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুর সংখ্যা ১২ লাখ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে আইএলও কনভেনশন ১৩৮ র্যাটিফিকেশনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
শিশুশ্রম নিরসনে বিদ্যমান জাতীয় কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। যে কাজে ঝুঁকি রয়েছে, পর্যালোচনা করে তা বিদ্যমান তালিকায় যোগ করার সুযোগ রয়েছে।
শিশুশ্রম নিরসনে সরকার ২০১০ সালে শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা এবং গৃহকর্মী সুরক্ষায় ২০১৫ সালে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি প্রণয়ন করেছে। শিশুদের জন্য শিশু বাজেট রয়েছে। ১ লাখ শিশুকে শ্রম থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২৮৪ দশমিক ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত সংশ্লিষ্ট কমিটিসমূহ শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে। সেই সঙ্গে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ২৩টি আঞ্চলিক কার্যালয় সারা দেশে শিশুশ্রম নিরসনে দায়িত্ব পালন করছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি। শিশু শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস করার বিষয়ে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
রাফেজা শাহীন
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে ১ লাখ ২৭ হাজার শিশুর জন্য কাজ করেছে।
শিশুশ্রম ও শিশুর কাজকে এক করা যাবে না। শিশুরা শিশু অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। প্রতিটি বিভাগে, জেলায় শিশুশ্রমবিরোধী কর্মসূচি পালন করতে হবে।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রথম শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। এরপর ১৯৮৯ সালে কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড (সিআরসি) গৃহীত হয়। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এটি র্যাটিফাই করে। এরপর ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করে। ২০১৩ সালের শিশুশ্রম আইনের পর্যালোচনা করে একে সময়োপযোগী করতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে ১২ লাখ ৮০ হাজার শ্রমজীবী শিশুর হিসাবটি ২০১৩ সালের। এটিকে এখন বিবেচনায় আনতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা আরও বড় করা প্রয়োজন। এই তালিকার বাইরে আরও অনেক খাতে শিশুরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।
এ কে এম মাসুদ আলী
আমরা জানি আমাদের সমস্যা কী। রাজনৈতিক নেতাদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ‘বিশ্বাসযোগ্য বিশ্বাস, প্রয়োগযোগ্য পরিকল্পনা’ নিয়ে শিশুশ্রম প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা কি ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম বন্ধ হবে বলে বিশ্বাস করি? বিশ্বাস না করলে হবে না।
প্রায় ১৮ লাখ শিশুকে ২০২১ সালের মধ্যে শিশুশ্রম থেকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। শিশুদের বিনা শর্তে শ্রম থেকে মুক্তি দিতে হবে। যৌনকর্মীদেরও এর আওতায় আনতে হবে।
রাষ্ট্রের হাতে শিশুশ্রম নিরসন করার জন্য তিনটি উপায় আছে। প্রথমত, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করতে হবে। প্রান্তিক পরিবারগুলোর জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। সঠিক কারিগরি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা দরকার। তৃতীয়ত, আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ থাকতে হবে। আইন যেন শিশুর বিরুদ্ধে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করে কারখানা থেকে শিশুকে সরিয়ে আনলে শিশুটি ও তার পরিবার বিপদে পড়বে। রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রাত্যহিক আলোচনায় শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কথা থাকতে হবে। তাহলেই ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
আবদুল্লাহ আল মামুন
আমরা কি বিশ্লেষণ করে দেখেছি, কেন শিশুরা কাজে যায়? বাবা-মায়েরা কেন তাঁদের শিশুসন্তানদের কাজে পাঠায়? লেগুনায় প্রতিদিন একটি শিশু ৮০০ টাকা পায়। তাহলে মাসে প্রায় ২৪ হাজার টাকা আয় হয়। এই রকম লোভনীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে আনতে আমাদের প্রস্তুতি আছে?
শিশুশ্রম নিয়ে আমাদের পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এর জন্য তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে। শিশুদের নিয়ে খাতভিত্তিক, নাকি এলাকাভিত্তিক কাজ করব, তা ঠিক করতে হবে।
শিশুশ্রম থেকে শিশুদের ফিরিয়ে আনার মূল দায়িত্ব শ্রম মন্ত্রণালয়ের। শিশুরা যেন কাজে না যায়, তা দেখার দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিশুরা যেন সামাজিক সুরক্ষা পায়, তা দেখার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। সুতরাং এই কাজ সবার। সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। তাহলেই শিশুদের শ্রমে আসা বন্ধ হবে।
গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দিকেও নজর দিতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিশুশ্রম নিরোধের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মো. জাফরুল হাসান
ফরমাল (আনুষ্ঠানিক) খাতে শিশুশ্রমের পরিমাণ কমেছে। কিন্তু ইনফরমাল (অনানুষ্ঠানিক) খাতে অনেক শিশু শ্রমিক রয়েছে।
এক জরিপে দেখা যায় ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১৮২ জন গৃহশ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৪৬ জন আহত হয়েছেন। এটাকে কি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে ফেলব না? এই খাত শ্রম আইনের বাইরে থাকলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সংজ্ঞা কী? এই সংজ্ঞা নির্ধারণ করা না থাকলে লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করা যাবে না। আইনের অনেক বিধান আছে। সে অনুযায়ী শিশুরা কিছু কাজ করতে পারবে না। কিন্তু এই বিধানগুলোর বাস্তবায়ন নেই। আইনের বাস্তবায়ন দরকার।
ইনফরমাল খাতে আমরা দুটি পরীক্ষামূলক কাজ করছি। প্রথমত, টঙ্গীতে একটি মোটর মেকানিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। এখানে শ্রমজীবী শিশুদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দিচ্ছি। দ্বিতীয়ত, কেরানীগঞ্জে একটি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুরা সেলাই শিখছে।
আব্দুল কাইয়ুম
আমরা শিশুদের কী চোখে দেখি, সমাজ তাদের কীভাবে দেখে, তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের পেছনে ব্যয় করলে সেটা হবে বড় বিনিয়োগ।
এ ক্ষেত্রে সমাজ, পরিবার, সরকার—সবার সহযোগিতা থাকতে হবে। আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম অালোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।