গণতন্ত্রের সংকট বনাম ভোটের সংকট
জার্মান জরিপ প্রতিষ্ঠান ডালিয়া রিসার্চ সম্প্রতি এক জরিপ করেছে অ্যালায়েন্স অব ডেমোক্রেসিজ ফাউন্ডেশন ও রাসমুসেন গ্লোবালের সহযোগিতায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর প্রতি জনগণের আস্থার জায়গাটা কতটুকু, গণতন্ত্রের অবস্থা কী, গণতন্ত্রের ব্যাপারে জনগণ কী মনে করে, বাক্ বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কী দশা, এসব জানতে-বুঝতে এই জরিপ করা হয়েছিল। বিশ্বের ৫৪টি দেশের ১ লাখ ৭৭ হাজারের বেশি লোক এই জরিপে অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশ এই তালিকায় নেই। উপমহাদেশের দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের জনগণ এই জরিপের অংশ। ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ৬ জুন সময়ের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়েছিল। বলা হচ্ছে, বিশ্বে এটা এ ধরনের সবচেয়ে বড় জরিপ।
এই জরিপে অনেক কিছু বের হয়ে এসেছে। তবে মূল প্রাপ্তি হিসেবে যা প্রচার পেয়েছে তা হচ্ছে, গণতন্ত্র নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। এমনকি পশ্চিম ইউরোপের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলোর বেশির ভাগ জনগণ সেখানকার গণতন্ত্রকে যথেষ্ট গণতান্ত্রিক মনে করছে না। গণতন্ত্রের যে ধারণা, সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। জরিপের ফলাফল বলছে, বিশ্বে অর্ধেক জনগণ মনে করে যে তাদের সরকারগুলো কাজে-কর্মে অগণতান্ত্রিক। তবে আশার দিক হচ্ছে, বিশ্বের ৭৯ শতাংশ মানুষ তাদের দেশের জন্য গণতন্ত্রকে জরুরি বলে মনে করে। গ্রিসের ক্ষেত্রে যা ৯২ শতাংশ (সর্বোচ্চ), ইরানের ক্ষেত্রে তা ৫৫ শতাংশ (সর্বনিম্ন)।
জরিপ প্রতিষ্ঠান ডালিয়া রিসার্চের সিইও ও সহপ্রতিষ্ঠাতা নিকো ইয়াসপার্স জরিপের ফলাফল প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্বের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অসম্ভব দ্রুতগতিতে বদলাচ্ছে, গত ৩০ বছরে এমন দেখা যায়নি। তিনি বলেছেন, কেন তা ঘটছে এবং সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা বোঝার জন্য বৈশ্বিক জনমত জানা জরুরি। তাঁর মতে, এই সময়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে জনগণ তাদের সরকারকে আর গণতান্ত্রিক মনে করছে না। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের সংকট এটা নয় যে জনগণ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বিষয়টি হচ্ছে জনগণ আরও গণতন্ত্র চায়।
জরিপ থেকে যে পর্যবেক্ষণগুলো পাওয়া গেছে, তার কিছু মূল দিক পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। প্রথমত, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ তাদের সরকারকে ব্যর্থ বলে মনে করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দেশগুলোর জনগণ এখন এ ব্যাপারে সন্দিহান যে তাদের সরকার আদৌ ‘জনগণের দ্বারা’ নির্বাচিত এবং ‘জনগণের জন্য’ কাজ করছে কি না। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি জনগণ মনে করে যে তাদের মতামত ও বক্তব্যের কোনো প্রভাব নেই এবং রাজনীতিতেও তাদের বক্তব্যের আদৌ কোনো দাম নেই। ৬০ ভাগ জনগণ মনে করে, সরকার তাদের স্বার্থ বিবেচনা করে কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জনগণের অসন্তুষ্টির মাত্রা বেশি। জরিপের ফলাফল বলছে, অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর জনগণের মধ্যে হতাশা কম এবং সরকারের সমালোচনাও কম। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ৬৪ শতাংশ মনে করে, তাদের সরকার কখনোই প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে সমুন্নত রাখতে পারেনি।
তৃতীয়ত, বিশ্বের অর্ধেকের বেশি জনগণ মনে করে, তারা যে খবর পড়ে তা আদৌ নিরপেক্ষ বা ভারসাম্যপূর্ণ নয়। একই সংখ্যক জনগোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক অবস্থান বা মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। অথচ পরিবেশটি এমন যে অধিকাংশ মানুষই ভিন্নভাবে চিন্তা করে।
চতুর্থত, কোন কোন বিষয় গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর ও উপকারী, এমন প্রশ্নের জবাবে যে ফল মিলেছে তা বেশ মজার। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো বাদে বাকি দেশগুলোর জনগণ মনে করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে অধিকাংশ পশ্চিমা দেশের জনগণ একই বিষয়গুলোকেই উল্টো গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
এই জরিপ থেকে বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছ থেকে যে মতামতগুলো পাওয়া গেছে, তা রাজনৈতিক গবেষক ও বিশ্লেষকদের ভাবাতে সহায়তা করবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বর্তমান হাল ও ভবিষ্যতের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে কাজে লাগবে। তবে গণতন্ত্রের সংকট এবং এ নিয়ে চরম হতাশার মধ্যে বিশ্বের ৭৯ শতাংশ জনগণ যে এখনো তাদের দেশের জন্য গণতন্ত্রকে জরুরি মনে করে, এটা গণতন্ত্রকামীদের জন্য এক আশাজাগানিয়া তথ্য। গণতন্ত্রের বর্তমান সংকটের মূল কারণ যে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের উত্থান, তা অনেকেই মানবেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েই তাঁরা ক্ষমতায় বসছেন এবং গণতন্ত্রের বারোটা বাজাচ্ছেন। ক্ষমতায় গিয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছেন। এখন বিশ্বের যে ৭৯ শতাংশ জনগণ তাদের দেশের জন্য গণতন্ত্র জরুরি মনে করছে, তাদের গণতন্ত্রের চাওয়া পূরণ হবে কীভাবে? অগণতান্ত্রিক কোনো পথের ওপর নির্ভর করে গণতন্ত্রে ফিরে আসা কঠিন। যথাযথ নির্বাচন ও নির্বাচনী ব্যবস্থাই সে ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা।
তুরস্কের গণতন্ত্রের অবস্থা আমরা জানি। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির ওপর ভর করে এরদোয়ান নির্বাচনে জিতে পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী শাসকে পরিণত হয়েছেন। তুরস্কের স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনের কিছু ফলাফল সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেড়েছে। স্থানীয় নির্বাচন হলেও তুরস্কের রাজনীতিতে এই নির্বাচন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে-বিপক্ষের গণভোট হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ‘হাই ইলেকশন কাউন্সিল’-এর কর্মকর্তারা সবাই এরদোয়ানের হাতে নিয়োগ পাওয়া এবং তাঁর অনুগত। গত ৩১ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর ৬ মে সেই কাউন্সিল ইস্তাম্বুলের সব গুরুত্বপূর্ণ মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন বাতিল করে দেয়। আপত্তির মুখে আবার ভোট নেওয়া হয়। নতুন ফলাফলে দেখা গেছে, বিরোধীদলীয় রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) ইস্তাম্বুলসহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মহানগরীতে জয়ী হয়েছে। দেশটির অর্থনৈতিক রাজধানী এবং সবচেয়ে জনবহুল শহর ইস্তাম্বুলে বিরোধীদের এই বিজয়ের প্রতীকী মাজেজা রয়েছে। ইস্তাম্বুল নিয়ন্ত্রণ থাকাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা এরদোয়ানের একটি পুরোনো মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়। তিনি বলেছিলেন, ইস্তাম্বুল জয় করা মানে তুরস্ককে জয় করা।
এই নির্বাচনের শিক্ষা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে কার্যকর পথ যথাযথ নির্বাচন অনুষ্ঠান। তুরস্ক ইউরোপের পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় শিক্ষা-দীক্ষায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশটির জনগণ খুব স্বাভাবিকভাবে নিজেদের প্রান্তিক হিসেবে বিবেচনা করত। এ ধরনের হতাশাজনক পরিস্থিতির সুযোগই নেন জনতুষ্টিবাদী নেতারা। এরদোয়ানও তাই করেছেন। তিনি ইসলামি জাতীয়তাবাদকে তাঁর হাতিয়ার বানিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। ১৭ বছর ধরে তিনি ক্ষমতায় আছেন এবং বলা যায়, সব নির্বাচনেই জয়ী হয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে তিনি কাজে-কর্মে পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী শাসক হয়ে উঠেছেন। তুরস্কের জনগণ দেখতে পেল, তাদের দেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনগুলো আর স্বাধীন নেই এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এরদোয়ানের অনুগত ব্যক্তিরা দখল করে ফেলেছেন। এই অবস্থায় ইস্তাম্বুলের নির্বাচনের এই ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তাঁর জনপ্রিয়তায় ধস নামতে শুরু করেছে। জনগণের মোহ কাটতে শুরু করেছে এবং কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে তারা এখন আবার গণতন্ত্রের দিকেই যেতে চাইছে।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা ঘটেছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। এ নিয়ে জনগণের মনেও নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছে এবং মনস্তত্ত্বেও বদল ঘটছে। ডালিয়া রিসার্চের জরিপে তার কিছু ইঙ্গিত মিলেছে। কিন্তু বদলে যাওয়া ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী, তা এক বড় প্রশ্ন হিসেবে হাজির হয়েছে। যে বদল ঘটছে, তা গণতন্ত্রের নামে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ঘটেছে। তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সূত্রে সেখানে যে বদলের ইঙ্গিত পাওয়া গেল, সেটা কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এসেছে। ভোট এরদোয়ানকে ক্ষমতায় এনেছে, রেখেছে এবং এখন হুমকির মুখে ফেলেছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি একপর্যায়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিণত হয়ে দেশটির নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
আমরা দেখছি, জনতুষ্টিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আগের মান-মর্যাদা ধরে রাখতে পারছে না। অথবা এসব প্রতিষ্ঠান তাদের মান-মর্যাদা ধরে রাখার সক্ষমতা হারাচ্ছে। এবারের ভারতে নির্বাচনে দেশটির নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা যতটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে, অতীতে তা কখনো হয়নি। এই অবস্থায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তন ঘটছে, তাকে আবার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বদলানোর সম্ভাবনাকে কঠিন করে দিচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনায় নিয়ে এরদোয়ান যদি এখন তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখতে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব আরও জোরদার করেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিশ্বের ৭৯ শতাংশ জনগণ তাদের দেশে গণতন্ত্র চায়। কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থাই যদি ঠিক না থাকে, তবে তাদের এই চাওয়া পূরণ হবে কীভাবে? গণতন্ত্র এখন হয়তো সংকটে আছে কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থা যদি ঠিক থাকে, তবে সেই সমস্যা দূর করার সুযোগ জনগণের সামনে থাকে। কিন্তু নির্বাচন বা ভোট যখন সংকটে পড়ে তখন গণতন্ত্রের সংকট কাটানোর সুযোগও নষ্ট হয়ে যায়। ভোটের সংকট না কাটাতে পারলে গণতন্ত্রের সংকট কাটবে না।
এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর উপ–সম্পাদক
[email protected]