ইলিশের আকাল বনাম গঙ্গা তুমি কার
‘ওদের জল দিইনি, তাই ওরা ইলিশ দিচ্ছে না।’ কথাটা যাঁর বলার কথা তিনিই বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য রহিমা বিবি ইলিশের মৌসুমে বাংলায় ইলিশের হাহাকার নিয়ে বিধানসভার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জবাবে আরও বলেন, ‘জল জল করলে কী হবে, আমাদেরই জল নেই, জল দেব কোথা থেকে?’ আজকাল প্রায়ই যেকোনো অজুহাতে মমতা পানি নেই জল নেই বলে তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তির বিষয়টি আমলে নিতে চাইছেন না। এবার তিনি বিষয়টিকে ইলিশের সঙ্গেও জুড়ে দিলেন। রটনা আছে আমাদের এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের এই মুখ্যমন্ত্রীকে তিস্তামুখী করার জন্য ইলিশ আর জামদানি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। রটনা যা–ই হোক, বাংলাদেশ কখনোই ‘জল দাও ইলিশ নাও’ এই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেনি। তবু মমতা জলের সঙ্গে ইলিশের অবাস্তব সওদার আভাস দিয়েছেন।
বিপুল জয়ের মালা নিয়ে নরেন্দ্র মোদি আবার গদিতে বসায় কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তাগিদে বাংলাদেশের অভিনন্দন না হয় মমতার নিরিখে একটু বেশি গদগদ হয়েছে, তাই বলে কি কথায় কথায় আবার আমাদের পানিতে মারার জিগির তুলতে হবে? তা ছাড়া এপারেও চলছে ইলিশের আকাল।
ইলিশের আকাল কেন?
রথযাত্রার আগেই আষাঢ়ের বাজারে ইলিশের যাত্রা শুরু হয়। এবার তা হয়নি। আষাঢ়ের বৃষ্টি চৈত্রে হয়ে গেছে। তার ওপর এবার বিলম্বিত বর্ষা। ইলিশের মিছিল তাই শ্রাবণেও ঠিকমতো আসে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ। ভারতীয় উপমহাদেশে যে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের হাত ধরে বর্ষা আসে, তা আসে দক্ষিণ থেকে। ভারতের সর্বদক্ষিণে কেরালায় বর্ষা নামে সবার আগে। মে মাসের শেষে বা জুনের শুরুতে। সেখান থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছাতে বর্ষার লাগে তিন-চার সপ্তাহ। এবার কেরালায় বর্ষা নামতে তিন–চার সপ্তাহ দেরি হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য সেটা ছয়–সাত সপ্তাহের ধাক্কা। ভালো করে বর্ষা না নামলে ইলিশের সরবরাহ বাড়বে না। আর ইলিশের সরবরাহ বাড়লে তার ভারত ভ্রমণ কোনো মান-অভিমান দিয়ে যে ঠেকানো যাবে না, সেটা মুখ্যমন্ত্রী মমতার চেয়ে ভালো আর কে জানেন? গরুর বদলে ইলিশ বন্ধ হলেও মাদক ফেনসিডিলের বদলে ইলিশ পাচার বন্ধ করবে কে?
গঙ্গার হিস্সার খবর কি কেউ রাখে?
তিস্তার পানিবণ্টনের না হয় চুক্তি হয়নি। চুক্তির ব্যাপারে কে কতটা আন্তরিক, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দায়ী না রাজ্য সরকারের একরোখা মনোভাব দায়ী, তা নিয়ে দিস্তা দিস্তা বিশ্লেষণ লেখা হয়েছে। আরও লেখা যায়। কিন্তু যে চুক্তি হয়েছে তা মানা হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে যাঁদের রাও কাড়ার কথা তাঁদের কী খবর? ‘মুরগি দেখিয়ে ডাল দিয়ে কাজ সারা’র নীতি অনুসরণের আলামত পাওয়া গেছে এক পিএইচডি গবেষণায়। নেদারল্যান্ডসের একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যৌথ পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই গবেষণায় ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য–উপাত্ত আর মাঠপর্যায়ের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত পানি বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি।
চুক্তি করেও কাজ হয় না
বাংলাদেশের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৭৫ সালে পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের অজুহাতে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার শুরু করে। দ্বিপক্ষীয় দেনদরবারে কাজ না হওয়ায় হতাশ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি উত্থাপন করে। সে সময় জনগণকে নিয়ে মাওলানা ভাসানীর ফারাক্কা পদযাত্রা বিদেশি মুরব্বিদের নজরে আসে। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অনুযায়ী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা কোনো একটা দেশ তার একক ইচ্ছায় বা ক্ষমতায় নদীর পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর ক্ষেত্রে নদীর শেষ প্রান্তে থাকা দেশগুলোর বিশেষ অধিকার এখন সংরক্ষিত। নদীপ্রবাহ রক্ষার স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। বাংলাদেশের উদ্যোগে এসব বিতর্ক যখন বেশ জমে উঠেছিল, তখন ভারতে এক বিস্ময়কর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। কংগ্রেস ক্ষমতা হারায়।
১৯৭৭ সালে ভারতের প্রথম অকংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বাংলাদেশের সঙ্গে পাঁচ বছরের জলবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেই চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার আর পুনর্নবীকরণ করা হয়নি। ১৯৮২ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আবার দুই বছরের জলবণ্টন নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮৫ সালের ২২ নভেম্বর আবার অন্য একটা এমওইউ হয়। কিন্তু চুক্তি আর হয় না। ভারত ক্রমাগতভাবে চুক্তি সম্প্রসারণ করতে অস্বীকার করে। বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী প্রবাহিত জলের পরিমাপ বৃদ্ধি নিয়ে কোনো চুক্তির ধারেকাছে না গিয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ১৯৯৩ সালের খরা মৌসুমে বাংলাদেশের দিকে জলপ্রবাহ পূর্বের ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেকের বদলে কমিয়ে ১০ হাজার কিউসেক করে দেয়। বাংলাদেশ আবার জাতিসংঘের সাধারণ সভাসহ নানা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে মাথা কুটতে থাকে, বিষয়টি তোলার চেষ্টা করে, কিন্তু তেমন একটা ফল হয় না।
দিল্লিতে আবার অকংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে একটি ৩০ বছরের সামগ্রিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা থেকে দুই দেশের মধ্যে জল বণ্টন করার কথা। পূর্ববর্তী ৪০ বছরের গড় মাত্রা অনুযায়ী ভারত গঙ্গার জলের ভাগ পেতে থাকে। যেকোনো সংকটের সময় বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক জল সরবরাহ করার কথা দেওয়া হয়। এই চুক্তিতে গঙ্গার জলের দীর্ঘকালীন বণ্টনব্যবস্থা ও অন্য সাধারণ নদীগুলোর ক্ষেত্রে একই রকমের জলবণ্টন ব্যবস্থা কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়, এই চুক্তির ফলে ভারতের গঙ্গার জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং গঙ্গার নিম্ন অববাহিকায় বাংলাদেশের অধিকারসহ জলের সমান ভাগ পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু কী পেলাম আমরা?
বাস্তবে সেটা হয়েছে কি? গঙ্গার জলপ্রবাহ ভারতের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেও নিম্ন অববাহিকার বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্সা পাচ্ছে না। এমনকি এটা নিয়ে হায় আফসোস করার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত পানি না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের একজন বাংলাদেশি সদস্যকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘শুকনা মৌসুমে হয়তো ওদের পানির ঘাটতি ছিল, তাই এদিকে পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে থাকতে পারে।’ এ যেন মুখ্যমন্ত্রী মমতার মুখপাত্রের বচন, ‘না থাকলে দেব কোথা হতে।’
ইলিশ নিয়ে বালিশ খেলা নয়, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন এবং তিস্তার চুক্তি প্রণয়ন নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে। তিস্তাসহ অন্যান্য নদী নিয়ে কথা বলার চুক্তি করার যে দরজা ১৯৯৬–এর চুক্তি খুলে দিয়েছিল, তার কপাট কেন বন্ধ হবে?
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী।